পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি জরুরি
২রা ডিসেম্বর ২০২৪, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২৭ বছর। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিবেশ নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের এ দিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জে এস এস) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি চার খণ্ডে বিভক্ত।
শান্তি চুক্তিতে ক খণ্ডে ৪টি, খ খণ্ডে ৩৫টি, গ খণ্ডে ১৪টি এবং ঘ খণ্ডে ১৯টি ধারাসহ সর্বোমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। ৭২টি ধারার মধ্যে বিভিন্ন সরকার এ পর্যন্ত ৬৫টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে।
সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, শান্তি চুক্তির ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, এর মধ্যে ক খণ্ডের ১, ২, ৩ ও ৪ ধারা বাস্তবায়িত; খ খণ্ডের ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৩ ধারা; গ খণ্ডের ১, ৭, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪ ধারা এবং ঘ খণ্ডের ১, ৫, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৯ ধারাসহ মোট ৪৮টি সম্পন্ন বাস্তবায়িত।
খ খণ্ডের ৪ (ঘ), ৯, ১৯, ২৮, ২৭ ও ৩৪ ধারা; গ খণ্ডের ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ ধারা; ঘ খণ্ডের ৪, ৬, ১৭ ও ১৮ ধারাসহ মোট ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে; এবং খ খণ্ডের ২৬, ২৯, ৩৫, গ খণ্ডের ১১, ১৩, ঘ খণ্ডের ২, ৩, ৭, ৯ ধারাসহ মোট ৯টি ধারা বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান। এই চুক্তির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হলেও বেশ কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শান্তি চুক্তি হবার দুই বছর পরে ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল। এই কমিশনের কাছে এখন প্রায় ১৬ হাজারের মতো আবেদন জমা পড়ে আছে। গত ২৫ বছরে এই কমিশন কোন কাজই করতে পারেনি। এবং ২০১৬ সালের পর থেকে এই কমিশন আর কোন আবেদনও গ্রহণ করেনি। খাগড়াছড়ি শহরে এই কমিশনের অফিস, বাস্তবে সেখানে কোন কর্ম তৎপরতা নেই।
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পতিত স্বৈরাচার সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড ও চুক্তি সংস্কারের জন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেক সম্প্রদায় এই চুক্তির সংশোধন দাবি করে আসছে, কারণ বর্তমান যে কমিশন কাজ করছে তাতে আনুপাতিক হারে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নেই। এই চুক্তি পরবর্তী পাহাড়ে ভাতৃ-ঘাতী সংগাত অনেক বেড়ে গেছে। বেড়েছে খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুমসহ নানান অস্থীতিশীলতা।
এই প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির সাবেক এমপি, বিএনপি নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূঁইয়া সম্প্রতি বিবিসিতে দেওয়া এক স্বাক্ষাতকারে বলেছেন, “এই ভূমি কমিশনে বাঙালিদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। একমাত্র বাঙালি হচ্ছেন চেয়ারম্যান। বাকি সবাই উপজাতি। তাহলে বাঙালিরা কিভাবে ন্যায়বিচার পাবে?”
তাছাড়া চুক্তি পরবর্তীতে আওয়ামী শাসন আমলে পাহাড়ে ৬টি সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে। যাদের খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুমসহ নানা অপকর্মে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ এখন অতিষ্ট। এখানে উল্লেখ্য যে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জে এস এস) এর সাথে সরকার এই চুক্তি সম্পন্ন করেছে সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জে এস এস) বিভিন্ন অজুহাতে এই পার্বত্য ভূমি কমিশনকে কোন ধরনের কাজ করতে দেয়নি, যার ফলশ্রুতিতে যে কয়টি ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে তার সব কয়টি ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৬ সালে পতিত স্বৈরাচার জে এস এস’র দাবির মুখে ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের একমাত্র বাঙালি সদস্য চেয়াম্যানের ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনটি সংশোধন করেছে, বর্তমান আইনে বাঙালিদের ভূমিতে তেমন কোন অধিকার নেই বললেই চলে। এই কমিশনকে কার্যকর করতে হলে সবার আগে আইন সংশোধন করে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জরিপের মাধ্যমে ভূমির সঠিক মালিকানা নির্ণয় করতে হবে। তারপর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির দিকে আগাতে হবে, ভূমি জরিপের মাধ্যমে বিরোধপূর্ণ ভূমি অবস্থান নির্ধারিত হলেই তার সামাধান সম্ভব। অন্যথায় এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন যেভাবে নিরলসভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তার প্রকৃত সুফল তখনই ঘরে আনা সম্ভব যখন পাহাড়ের সকল সম্প্রদায় আন্তরিক হবে। ভূমিসহ অমীমাংসিত যে সকল বিষয় এখনো মীমাংসার অপেক্ষায় আছে সে সকল ধারা উপধারা সকল সসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে এর সমাধানের পথ খুজে বের করবেন।
সবচেয়ে বড় কথা শান্তির জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্বাবোধ। তাহলেই ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর বর্ণবৈষম্য-উত্তর দেশে শান্তির জন্য আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু যে রেইনবো নেশন গঠন করেছিলেন, তেমনি পাহাড়ের সকল ধর্ম ও মতাদর্শের মানুষদের নিয়ে একটি ‘রেইনবো জাতি’ গড়ে তোলা সম্ভব।
‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার।’ এই মূলমন্ত্র আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেতে পারে। পারে পাহাড়ে শান্তির শ্বেত পাতাকা উড়াতে।
লেখক : সদস্য, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, কলামিস্ট ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
Email : [email protected]