বাংলাদেশে আদিবাসী স্বীকৃতির বিরোধিতা কেন: বৈশ্বিক মূল্যায়ন
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান মোতাবেক “আদিবাসী” শব্দের অর্থ “আদিম জাতি”, সঠিক ইংরেজি পরিভাষা “Aborigine”। যেটার ইংরেজি বিশদ সংজ্ঞার বাংলা অর্থ হলো “একটি ব্যক্তি, প্রাণী বা উদ্ভিদ যা আদিকাল থেকে একটি দেশে বা অঞ্চলে ছিল।’ ইংরেজি “Indigenous” শব্দের বাংলা অর্থও বুঝায় “আদিবাসী’, তবে এই শব্দের ইংরেজি বিশদ সংজ্ঞার বাংলা অর্থ হলো “একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত বা ঘটছে, স্থানীয়।” অর্থাৎ Indigenous শব্দটি নৃতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে ব্যবহার কম যুক্তিযুক্ত। কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে ঘটছে বা স্থানীয় মনে হলেই ঐতিহাসিক এবং গঠনগত উপাদান বিশ্লেষণ ব্যতিত সেটা ঐ স্থানের “Aborigine” হতে পারে কিভাবে? হ্যাঁ, এই ধরনের অসংখ্য মৌলিক এবং বৈধ যুক্তিগত বিরোধের কারণে জাতিসংঘ “Indigenous People” কারা আজ অবধি এর স্বীকৃত কোন সংজ্ঞা প্রদান করতে পারেনি। ইউএন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন ২০১৪ সালে যে ব্যাখা দাঁড় করাতে চেয়েছে, তা “আদিবাসী” এর সংজ্ঞাকে অত্যন্ত দূর্বল, প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত করে ফেলে। নিজেকে আদিবাসী দাবী করা এবং সম্প্রদায় কর্তৃক সদস্য হিসেবে মেনে নেওয়া, বসতি স্থাপনের পূর্ব হতে কোন স্থানে অবস্থান, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা, নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি আছে এবং সমাজের দূর্বল দলে অবস্থান কে “আদিবাসী” বলতে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বের কোথাও উপজাতি/ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেই বলে মেনে নিতে বলা হচ্ছে! অথচ অনেক বড় নৃ-বিশেষজ্ঞ না হয়েও সাধারণ মানুষ একজন আরেকজনের ভাষা, বর্ণমালা, শারীরিক গঠন, খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ, পোশাক এবং সংস্কৃতি দেখে ঠিকই বুঝতে পারে/অনুমান করতে পারে কে কোন অঞ্চলের/দেশের মানুষ, বা তাদের পূর্ব পুরুষরা কোন স্থান থেকে আগত। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ সমূহে ত্রিপুরা, মিজোরাম, আরাকান, নাগাল্যান্ড, আসাম, বিহার, কাচিন, শান, মণিপুর নামক রাজ্য/প্রদেশ রয়েছে। গারো পাহাড়, লুসাই পাহাড় ইত্যাদি নামের স্থান রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার কে আগে ডাকা হতো ব্রহ্মদেশ বা মগদেশ বলে। আদিবাসী ইস্যু নিয়ে লিখতে গেলেই কোন এক অনলাইন নিবন্ধে পড়া একটি বাক্য মনে পড়ে যায়, “History built on blood, cannot be described in words!” প্রকৃত আদিবাসীদের উপর গণহত্যা ও নির্যাতনের ইতিহাস কয়েক শত বছরের পুরনো!
বিশ্বব্যাপী আদিবাসী নিধনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের উপর অত্যাচার ও গণহত্যাকে রাস্ট্রীয় আকার দিয়েছিলো ব্রিটিশ আধিপত্যের পাশাপাশি টিকে থাকা ইউরোপীয় রাজ শক্তি গুলো। মধ্যপ্রাচ্যে আদিকাল থেকেই এনাগাদ যা চলছে সেটা আমরা মূলত ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং গোত্রগত হানাহানি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করতে হবে শুধুমাত্র পঞ্চাশের দশক হতে ফিলিস্তিনিদের উপর অবৈধ দখলদার ইজরাইল এর নিপীড়ন ও গণহত্যা গুলো ব্যতিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় চারশো থেকে দুইশ বছর পূর্ব হতে পুরো উত্তর আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে ব্যাপকভাবে শোষণ ও নিধন করা হয়েছে পৃথিবীর ঐ সব অঞ্চলের ভূমিজ সন্তানদের।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর স্বতন্ত্র বৈশ্বিক প্রভাব খর্ব হতে থাকে, অতি দ্রুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র বিশ্ব মোড়ল হিসেবে আবির্ভূত হয়। যদিও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে রাখা হয় বিশ্বের সাবেক ১ নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাজ্য এবং অন্যতম পরাশক্তি ফ্রান্সকে। লক্ষণীয় বিষয় হলো উত্তর আমেরিকায় ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশকে একত্রিত করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ১৭৭৬ সালে যারা “যুক্তরাষ্ট্র” রাস্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাঁরা কেউ আমেরিকান ভূমিজ সন্তানদের বংশধর ছিলেন না, তাঁরা সবাই ছিলেন ইউরোপীয় অভিবাসীদের বংশধর, অত্যন্ত দূরদর্শী এবং জ্ঞানী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনসহ মোট ১৩ জনকে যুক্তরাষ্ট্রের “প্রতিষ্ঠাতা পিতা” হিসেবে বিবেচনা করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে মূল বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রক ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন এর নেতৃত্বে ইহুদি বুদ্ধিজীবীগণ এবং তাদের সর্বাত্মক সহায়তা করেন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ইহুদি ধনকুবেরগণ (এই যুক্তি নিখাঁদ ঐতিহাসিক দলিল দিয়ে প্রমাণিত না হলেও সত্য, আজও মার্কিন রাজনীতির মূল দুটি দল রিপাবলিকান দল ও ডেমোক্রেটিক দলের উপর উগ্রবাদী ইহুদি লবিং গ্রুপ AIPAC এর অলঙ্ঘনীয় প্রভাবের মূল কারণ হিসেবে সেটাকে প্রছন্নভাবে চিহ্নিত করতে গিয়ে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালীন মিনেসোটা এর ডেমোক্র্যাট দলীয় কংগ্রেস ওমেন ইহলান ওমরকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিলো)।
খ্রিষ্টান অধ্যুষিত ইউরোপে ইহুদিদের উপর জাতিগত নির্যাতন ও নিপীড়ন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে জার্মানিতে নাত্সি পার্টির উত্থানের মাধ্যমে শুরু হয়নি, এটা চলমান ছিলো আরো অনেক শতাব্দী পূর্ব হতে। আজকের দিনেও পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের গ্রামে গ্রামে যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যু দিবসে নাক লম্বা ইহুদির কুশপুত্তলিকাকে পিটিয়ে প্রতীকী প্রতিশোধ নেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে। ইহুদিদের উপর নির্যাতন মধ্যপ্রাচ্যে চলমান ছিলো কয়েক হাজার বছর পূর্ব হতে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত। উদারপন্থী চিন্তা ধারার ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের হাতে স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হলেও রাস্ট্র যন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো বর্ণবাদী শেতাঙ্গরা। যারা বৃহত্তর স্বার্থে বাধ্য হয়ে মার্কিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের প্রতি নমনীয়। একদিকে ইউরোপ থেকে দলে দলে সামর্থ্যবান ও দূরদর্শী ইহুদিরা যুক্তরাষ্ট্রে আসা শুরু করলো, যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের অভিবাসন ব্রিটিশরা চালু করেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার পূর্বে। অন্য দিকে দূরদর্শী শেতাঙ্গরা বিশাল আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ভূমিজ সন্তানদের নিধনে বিশেষ মনোযোগী হলো! এই নিধন পদ্ধতি গুলো ছিলো মারাত্মক নৃশংস, যেমন মূল্যবান চামড়ার জন্য বড় কুমির ধরতে টোপ হিসেবে আদিবাসী শিশুদের ব্যবহার করা হয়েছে, গুটি বসন্তের জীবাণুযুক্ত কম্বল আদিবাসীদের মধ্যে বিতরণের মতো সুপরিকল্পিত ভয়াবহ অমানবিক কার্যক্রমও ছিলো।
ঐতিহাসিকভাবে নথিভুক্ত হওয়া সবচেয়ে বড় অন্যায় এবং চক্রান্ত হলো ১৮৯৩ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকার পরও বিনা কারণে অবৈধভাবে দখল। যার জন্য মার্কিন কংগ্রেস পাবলিক ল ১০৩-১৫০ এর মাধ্যমে দখলদারিত্বের ১০০ বছর পূর্তিতে আদিবাসী হাওয়াইয়ানদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, তবে তাদের কে আলাদাভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া? সেটা মার্কিনীদের দ্বারা সম্ভব? ঐতিহাসিকদের মতে, ইউরোপীয় সেটেলাররা আগমনকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি আদিবাসীর বসবাস ছিলো, যা ১৯০০ সালের মধ্যে মাত্র ৩ লক্ষে নেমে এসেছিলো। অর্থাৎ অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে রাস্ট্রীয় আয়োজনে জাতিগত নিধন এবং অবৈধ বসতি স্থাপন করা হয়েছিলো।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে উপনিবেশ স্থাপন করে একই ধরনের বহুবিধ পরিকল্পিত গণহত্যা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছে আরো তিনটি অত্যন্ত বৃহৎ শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত দেশ। দেশগুলো হলো কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। কানাডায় হত্যাকাণ্ডের আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো, আবাসিক স্কুল সমূহে অধ্যয়নরত আদিবাসী শিশুদের উপর গণহত্যা চালানো, যার বিভিন্ন গণকবর এখন ক্রমান্বয়ে আবিস্কৃত হচ্ছে। কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াতেও পরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের মধ্যে রোগের জীবাণু ছড়ানো হয়। তবে নিউজিল্যান্ডে মাওরিদের বিরুদ্ধে রোগের জীবাণু ছড়ানো হয়নি এবং তুলনামূলক কম হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিলো। কারণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রায় ২০০০ সৈন্য হারিয়ে পরাজিত হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং সার্বভৌম মাওরি আদিবাসীরা Treaty of Waitangi এর মাধ্যমে আজ থেকে প্রায় ১৮০ বছর পূর্বে ব্রিটিশ রাজমুকুট এর নিকট নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা হস্তান্তর করেছিলো। যা তাঁরা আজও ফিরে পায়নি, তাদের হাজার হাজার বছর ধরে পূর্ব পুরুষের ভূমি অটিওরোয়া এর মধ্যেই গড়ে ওঠেছে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ “নিউজিল্যান্ড!’ প্রায় ৯০০০ বছর ধরে বসবাসরত নিজস্ব ভূমিতে কানাডিয়ান আদিবাসীরা এখন স্মৃতি চিহ্ন এর পর্যায়ে এসে ঠেকেছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ১০ জনে ৬ জন আদিবাসী বিলুপ্ত হয়ে গেছেন!
ব্যাপক ঘৃণা, নির্যাতন এবং বৈষম্যের স্বীকার সংখ্যালঘু ইহুদি সমাজের বুদ্ধিজীবী ও দূরদর্শী লোকজনের নেতৃত্বে ফরাসিদের সাথে জোট করে যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে স্বাধীন হলেও শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড শান্তিপূর্ণভাবে ব্রিটিশ রাজমুকুট এর নিকট হতে স্বাধীনতা লাভ করে, সংগত কারণেই এখন পর্যন্ত ঐ ৩টি দেশের সাংবিধানিক প্রধান হলেন ব্রিটিশ রাজা। বিপরীতে এখন পর্যন্ত আমেরিকায় বিশ্বের একমাত্র স্বঘোষিত ইহুদি রাস্ট্র ইজরাইল এর চেয়েও ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। বিশ্বব্যাপী বৃটিশ প্রাধান্যের পাশাপাশি ইউরোপীয় অন্যান্য শক্তি ফরাসী, ডাচ, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান, বেলজিয়ান ইত্যাদি জাতিসমূহ এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা মিলিয়ে বৈশ্বিক উপনিবেশ স্থাপন করে প্রাকৃতিক, কৃষি ও খনিজ সম্পদ লুন্ঠন করেছে, বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমিজ সন্তানদের ক্রীতদাস হিসেবে রপ্তানি করেছে ও নিজদের দেশে এনে শিল্প কারখানায় বিনা বেতনের শ্রমিক হিসেবে অমানবিকভাবে খাটিয়ে গোটা ইউরোপ কে গড়ে তুলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ মহাদেশ হিসেবে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় আফ্রিকান কাফ্রিদের আগমনের গোড়াপত্তন মূলত ক্রীতদাস হিসেবেই।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ইউরোপীয় ইহুদিগণ, বিশেষ করে জার্মানি-পোল্যান্ড-সোভিয়েত ইউনিয়ন এর অংশ হালের ইউক্রেন-হাঙ্গেরি প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক গণহত্যা ও ঘৃণার শিকার হয়ে পালিয়ে/মুক্তি পেয়ে ব্যাপকহারে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফিলিস্তিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়। ঐ ইহুদি নিধনকে “হলোকাস্ট” বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং ঐ গণহত্যায় ষাট লক্ষ ইহুদি নিহত হয়েছে দাবী করা হলেও ইউরোপের মাটিতে সেটা নিয়ে কোন গবেষণা এবং বিশদ আলোচনা আইনত নিষিদ্ধ। ফিলিস্তিনিরা সরল বিশ্বাসে নির্যাতিত ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিলো। অপরদিকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হতে আমেরিকান ও ইউরোপীয় ইহুদিদের মধ্যে ইহুদি ধর্ম মোতাবেক পূণ্য অর্জনের লক্ষে বনী ঈসরাইল ভূমি তথা ফিলিস্তিনে স্থানান্তরিত (আলাইয়া) হওয়ার হার অনেক বেড়ে যায়। তত্পরবর্তী ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে এবং আজ অবধি কী চলমান আছে, কম বেশ সবারই জানা। খোদ ইজরাইলেই সাবেক তিন বাহিনী প্রধান এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে বগি ইয়ালুন বলেছেন, “উগ্র ডানপন্থীরা ফিলিস্তিনিদের সাথে হলোকাস্ট ইন রিভার্স ঘটাতে চাচ্ছে!’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি পরপরই ল্যাটিন আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, এশিয়া ও আফ্রিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো স্বাধীনতার জন্য ফুঁসে ওঠেছিলো এবং ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। কিন্তু ইউরোপীয়রা উপনিবেশ ছেড়ে আসলেও নিজেদের শিল্প এবং অগ্রগতির চাকা সচল রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আঁতাত করে ঠিকই সাবেক উপনিবেশগুলোতে চরম অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বজায় রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র গোপন ও প্রকাশ্যে মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী ৭০০ এর অধিক সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে, পাশাপাশি বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে কূটনৈতিক মিশন চালু রেখে এক অভিনব কায়দায় সারাবিশ্বে আধিপত্য সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য জল, স্থল, আকাশ এবং ভার্চুয়াল জগত, সর্বত্র বিস্তৃত। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় চীন, রাশিয়া, ইরানসহ হাতেঘোনা কয়েকটি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আছে, তাদের এই বিরোধিতার কারণে সকল ক্ষেত্রে সীমাহীন বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা নিজেদের স্বার্থে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে যে কোন দেশের সামরিক জান্তা ও এক নায়কদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে ঐসব দেশের খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী পরোক্ষ উপনিবেশ তৈরি করে ইউরোপীয়দের এই অবিরাম প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন এবং নিরবচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সারা বিশ্বের আদিবাসী সম্প্রদায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, দেশে তেমন কোন স্বর্ণের খনি না থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ স্বর্ণ উত্পাদনকারী দেশ সমূহের মধ্যে অন্যতম! এভাবে পশ্চিমারা পুরো আফ্রিকা হতে লুট করছে ইউরেনিয়াম, কোল্টানসহ বহুবিধ মূল্যবান খনিজ। ফলশ্রুতিতে এই আধুনিক যুগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দোসর পশ্চিমারা, নব্য বেনিয়া চীন, সুযোগ সন্ধানী খ্রিষ্টান মিশনারি এবং গ্লোবাল কর্পোরেটগুলোর জন্য আমাজন থেকে আফ্রিকা, এশিয়া থেকে এন্টার্কটিকাসহ পৃথিবীর সর্বত্র আদিবাসী/ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সমূহের অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও জীবন যাপন হুমকির সম্মুখীন।
আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমূহের অধিকার সুরক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় সমূহের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক এবং মানবাধিকার কর্মীদের প্রয়াসে আইএলও আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমূহের অধিকার সুরক্ষায় Indigenous and Tribal Peoples Convention নামে ১৯৫৭ এবং ১৯৮৯ সালে দুটি কনভেনশন (নং ১০৭ ও ১৬৯) পাশ করে। যেগুলো প্রণয়নে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ এবং দল নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে চাওয়ার ফলে সুনির্দিষ্টভাবে কারা “আদিবাসী” এবং কারা “উপজাতি/ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” তার কোন সঠিক সংজ্ঞা প্রদান করতে সমর্থ হয়নি জাতিসংঘ। সঙ্গত কারণে উভয় কনভেনশনে খুবই নগন্য দেশ সমর্থন দিয়েছে। কালক্রমে আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় সমূহের উপর বিশ্বব্যাপী আধুনিক পদ্ধতিতে শোষণ এবং নির্যাতন আরম্ভ হওয়ায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এর চেয়েও আরো শক্তিশালী লিগালি নন বাইন্ডিং UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (UNDRIP) প্রস্তাবনা গ্রহণ করে। কিন্তু প্রস্তাবনা আরো শক্তিশালী করা হলেও পুরো বিষয়টি আগের চেয়ে আরো বেশি জটিল করে ফেলা হয়েছে, এবার উল্টো বিশ্বের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে প্রছন্নভাবে বুঝানো হয়েছে। কারা “আদিবাসী” কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান না করে বিপরীতে ঘোষণায় Tribal শব্দের অস্তিত্ব বিলীন করা হয়েছে। ১৪৩ টি দেশ প্রস্তাবনার পক্ষে ভোট দেয়, ১১ টি দেশ ভোট দান হতে বিরত থাকে ও ৩৪ টি দেশ ভোট দানে অনুপস্থিত ছিলো এবং ৪টি দেশ সরাসরি না ভোট দেয়। উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন ‘না’ ভোট প্রদানকারী দেশগুলো কারা! হ্যাঁ, যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড।
কী আছে UNDRIP-এ?
UNDRIP এ আদিবাসীদের ভূমির অধিকার, জীবনধারা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আত্মনিয়ন্ত্রণের উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণায় সর্বমোট ৪৬ টি অনুচ্ছেদ আছে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো হলো, অনুচ্ছেদ ৪ এর সারমর্ম- আদিবাসীরা আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য স্বায়ত্তশাসন বা নিজস্ব প্রশাসনের অধিকারী হবেন, অনুচ্ছেদ ১৮ এর সারমর্ম- আদিবাসীরা নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করবেন এবং পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণ সংক্রান্ত নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে পারবেন, অনুচ্ছেদ ১৯ এর সারমর্ম- আদিবাসী এলাকা/তাদেরকে প্রভাবিত করে এধরণের কোন আইনগত এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আদিবাসীদের সম্মতি নিতে হবে, অনুচ্ছেদ ২৬ এর সারমর্ম- আদিবাসীরা ব্যবহার করেছে স্বীকৃত এমন ভূমির উপরও তাদের প্রথা/রীতি অনুযায়ী অধিকার সংরক্ষিত হবে, অনুচ্ছেদ ২৮ এর সারমর্ম- আদিবাসীরা স্বাধীনভাবে ও স্ব-ইচ্ছায় সম্মত না হলে রাস্ট্র আদিবাসী এলাকার কোন ভূমি ব্যবহার/অধিগ্রহণ করতে পারবে না, অনুচ্ছেদ ৩০ এর সারমর্ম- আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় যে কোন সামরিক কার্যক্রমে তাদের পূর্বানুমতি নিতে হবে ও রাজি না হলে করা যাবে না (রাস্ট্র পর্যায়ে ঘোষিত যুদ্ধ ব্যতিত), অনুচ্ছেদ ৩২ এর সারমর্ম- আদিবাসী এলাকায় যে কোন প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং উন্নয়ন কার্যক্রম তাদের পূর্বানুমতি নিয়ে করতে হবে, অনুচ্ছেদ ৩৬ এর সারমর্ম- একই জাতির আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন আন্তর্জাতিক সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত হলে রাস্ট্রসমূহ তাদের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ দিতে হবে।
আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়সমূহ
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন এস আর ও নং-৭৮ -আইন/২০১৯, তারিখঃ ১৯ মার্চ ২০১৯ মোতাবেক বাংলাদেশে ৫০ টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় আছে। প্রয়াত বিরাজ মোহন দেওয়ান রচিত “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” গ্রন্থে তিনি অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে চাকমা জাতির দেশে দেশে রাজ্য স্থাপনের ইতিহাস বর্ণনা করে ৬৭ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “চাকমাদের পূর্বপুরুষেরা যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিজ সন্তান নহে তাহা এই আলোচনা হইতে স্পষ্ট।’ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein গ্রন্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সকল উপজাতির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য বিশদ বর্ণনা করেছেন। তিনি ২৮ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “A greater portion of the hill tribes, at present living in Chittagong Hills, undoubtedly came about two generations ago from Arracan. This is asserted both by their traditions and by records in the Chittagong Collectorate.” বিরাজ মোহন দেওয়ানসহ প্রবীণ চাকমা লেকখগণ শুধুমাত্র উপজাতি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বোমাং রাজপরিবার ও মং রাজপরিবারের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ভিজিট করলে পরিস্কারভাবে তাদের পাশ্ববর্তী দেশ মায়ানমার হতে স্থানান্তরিত হওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭’তে জনাব জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা “উপজাতি” শব্দটি বহাল রেখেই চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, যা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে “উপজাতি/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/নৃগোষ্ঠী” করা হয়েছে। এখানে তুলনামূলক উল্লেখ করা যায় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে চাকমারা বসবাস করলেও, ভারতের মেঘালয়, আসাম ও মিজোরামে Scheduled Tribe হিসেবে নথিভূক্ত আছেন। ভারতের ত্রিপুরায় ত্রিপুরাগণ Scheduled Tribe, এভাবে নাগাল্যান্ডসহ সেভেন সিস্টার্সে বসবাসকারী সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী Scheduled Tribe।
আদিবাসী ইস্যুর কূটনৈতিক বাস্তবতা
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে UNDRIP এখনো ঠিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা বৈধ, কিন্তু প্রকৃত গণহত্যাকারী ইজরাইল এর প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু’র বিরুদ্ধে অবৈধ এর ন্যায়। যেমন ছোট্ট এই বাংলাদেশের ৫০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে তারা আদিবাসী স্বীকৃতি দিচ্ছে এক বাক্যে!, কিন্তু নিজেরা এখনো UNDRIP লিগ্যালি নন বাইন্ডিং হিসেবেও সমর্থন করেনি! এটাই তাদের Rules Based World Orders, Democratic Values এবং unconditional support for Human Rights এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাদের ৫০ টি অঙ্গরাজ্যের ইতিহাস ২০ মিনিট পড়লেই সুস্থ মস্তিষ্কের একজন মানুষ নির্বাক থাকবে অনেকক্ষণ! ফিলিস্তিনি আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়ে তাদের অবস্থান কী জিজ্ঞেস করারও কোন ব্যবস্থা আমাদের আছে কি? বিশ্ব মানবতার প্রকৃত চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ড UNDRIP লিগ্যালি নন বাইন্ডিং হিসেবে সমর্থন করেও সরে আসার পথে আছে। তারা এটা Treaty of Waitangi এর ২০০তম বার্ষিকী ২০৪০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নন বাইন্ডিং হিসেবে সমর্থন করেছিলো। Treaty of Waitangi এর মাধ্যমে মাওরিদের “অটিওরোয়া’ এর মধ্যে গড়ে ওঠেছে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাস্ট্র “নিউজিল্যান্ড”, যে চুক্তির “মাওরি” রিড আউট এবং “ইংরেজি” রিড আউটে ভিন্নতা রেখে ঠকানো হয় ভূমিজ সন্তানদের। এখন কেন আবার সরে যেতে চাচ্ছে বর্তমান নিউজিল্যান্ড সরকার? কারণ বর্তমান সরকার দেখছে আস্তে আস্তে স্বাধীন মাওরি রাস্ট্র গঠনের গণভোটের দিকে যাবে UNDRIP এর প্রতি এই সমর্থন। অর্থাৎ প্রায় ২০০ আগে করা শাসকদের ভূলের মাশুল হিসেবে বর্তমান প্রজন্ম রাস্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা হুমকির মুখে ফেলতে নারাজ। এটা পরিস্কারভাবে প্রতীয়মান সমর্থন প্রত্যাহার না করলেও নিউজিল্যান্ডে UNDRIP আলোর মুখ দেখতে বহু দেরি আছে। অস্ট্রেলিয়া UNDRIP লিগ্যালি নন বাইন্ডিং হিসেবে সমর্থন করলেও বাস্তবায়ন বা আইনে পরিণত করার ধারে কাছেও নেই। কানাডা বহু আগে পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ রাস্ট্র হয়েছে ভূমিজ সন্তানদের ওপর সুপরিকল্পিত এবং নথিভুক্ত সব গণহত্যা চালিয়ে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তারা গত কয়েক দশক ধরে সারা বিশ্ব থেকে সাদরে অভিবাসী গ্রহণ করেছে, এখন পর্যন্ত অভিবাসীদের জন্য বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ রাস্ট্র হলো কানাডা। ব্রিটিশ কলম্বিয়া সহ কানাডার কোথাও এখন আর ভূমিজ সন্তানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়। তাই এখন তারা নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই টিকে থাকা ভূমিজ সন্তানদের সংরক্ষণের দিকে এগোচ্ছে, UNDRIP কে আইনে পরিণত করেছে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। অতি ছোট্ট দেশ ভূটানও UNDRIP কে তাঁর সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার জন্য হুমকি মনে করে ও সমর্থন করে না। UNDRIP স্বাক্ষরকারী চীনে শুধুমাত্র “উইঘুর মুসলিম” এর প্রকৃত অবস্থার বিষয়ে জানার চেষ্টা করলেই বাস্তবতা জানা যাবে! International Work Group for Indigenous Affairs এর তথ্য মতে, ” ভারত এই শর্তে UNDRIP স্বাক্ষর করেছে যে স্বাধীনতার পর সকল ভারতীয় আদিবাসী। সে জন্য ‘আদিবাসী ধারণা’ ভারতের উপর প্রযোজ্য হবে না। ভারতের নিজস্ব আইন ও নীতিমালার কোন পরিবর্তন হবে না।” ভারতের বর্তমান Scheduled Tribe তালিকাটির পিডিএফ কপির আকার ১৩ পাতা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নাম Ministry of Tribal Affairs।
প্রয়াত বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” বইয়ে স্পষ্ট লিখেছেন যে, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিজ সন্তান নয়। বিরাজ মোহন দেওয়ান মূলতঃ ক্যাপ্টেন টি.এইচ লুইন এর Hill Tracts of Chittagong and Dwellers Therein, প্রকাশকাল ১৮৬৯, বইয়ের দাবীর বিপরীতে চাকমারা একটি সভ্য জাতি, সুদীর্ঘ ঐতিহ্য এবং পথ পরিক্রমার অভিযাত্রী প্রমাণে ব্রতী হয়েছিলেন। অন্যদিকে আজ থেকে ১৫৫ বছর পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ব্রিটিশ ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন লুইন মূলত সেখানকার ‘অসভ্য’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত উপজাতিদের উন্নয়নে নিজের ও ব্রিটিশদের অবদান রেকর্ডভূক্ত করার মানসে তার অমূল্য বইটি লিখেছেন। তাই তাদের কারোর মধ্যে “আদিবাসী” ইস্যুতে পক্ষপাতিত্ব বা অসত্য তথ্য প্রদানের কোন প্রশ্ন আসে না। বিপরীতে নিজেদেরকে সভ্য এবং অভিজাত প্রমাণ করতে গিয়ে প্রয়াত বিরাজ মোহন দেওয়ান এতোটাই গভীর ও তথ্যবহুলভাবে লিখেছেন যে, কেউ চাইলেও সেখানে “উপজাতি” শব্দটি “আদিবাসী” দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা প্রায় অসম্ভব। সেটা করা হলে শুরু থেকে বইয়ের অংশ সমূহের ধারাবাহিকতা ও যথার্থতা নষ্ট হবে সম্পূর্ণভাবে।
এখন অনেকে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং কল্পিত আদিবাসী স্বীকৃতি একই সাথে দাবী করেন তখন অবাক হই! মানুষ এতো পল্টিবাজ, নীতিহীন হয় কিভাবে? মানবজীবন কী এমএস ওয়ার্ড ফাইল যে টাইপের মাঝখানে মন চাইলেই কন্ট্রোল Z বাটন প্রেস করবেন ইচ্ছে মতো? “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মূলতঃ পাহাড়িদের রাস্ট্রের অংশগ্রহণসহ স্বায়ত্তশাসনের নিশ্চয়তা দিচ্ছে এবং পাহাড়িদের বাড়তি সুবিধা দিতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালিদের কিছু কিছু সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে।” তাহলে এখন স্বার্থান্বেষী মহল কেন আদিবাসী হতে চান? সেটার মূল কারণ হলো UNDRIP! যা “কোন প্রকার রাস্ট্রের অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যতিত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এনে দিবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী মুক্ত করবে।” অর্থাৎ এটা মূলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নস্যাৎ করা বা ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টা! মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশদের স্কটল্যান্ডেও কিন্তু গণভোট হয়েছে, যেহেতু তারা “ইংলিশ” এর পরিবর্তে “স্কটিশ” হিসেবে স্বীকৃত।
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন সময় হতে মানব বসতির গোড়াপত্তন এবং আদৌও কোন ভূমিজ সন্তান আছে কিনা বা এই অল্প জায়গার মধ্যে ১১ থেকে ১৬ টি জনজাতির উত্পত্তি কিভাবে হতে পারে তা ব্যাপক গবেষণার বিষয়। দেশের সব স্বার্থান্বেষী মহল ও কিছু কিছু বিদেশি দূতাবাস একজোট হয়ে যে ভয়াবহ আয়োজন শুরু হয়েছে, তা দেখে কৌতূহলী মন জানতে চায় আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন এলাকা কোন সম্প্রদায়কে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য দেওয়া হবে? পার্বত্য বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ কি হবে? সেনাবাহিনীর অবস্থান তথা সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতা সুরক্ষার নিশ্চয়তা কী? পুরো দেশ মিলিয়ে ৫০ টি স্বায়ত্তশাসিত/ বিশেষ অঞ্চল এর রূপরেখা কী হবে?
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে পিজেএসএস (সন্তু লারমাপন্থী), পিজেএসএস(এমএনপন্থী), ইউপিডিএফ (মূল দল), ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক), কুকি চিন ন্যাশনাল পার্টি (কেএনএফ), মগ লিবারেশন আর্মি (এমএলএ) নামক ৬ টি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ভয়াবহ আন্তঃকোন্দলে লিপ্ত সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। এছাড়াও মুরং পার্টি সহ আরো বেশ কিছু পাড়া ভিত্তিক ছোট ছোট সশস্ত্র সংগঠন আছে, যাদের কথা সচরাচর মিডিয়ায় আসে না। এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মুখে যতই জাতিগত অধিকার আদায়ের কথা বলুক না কেন, এদের আসল উদ্দেশ্য ভিন্ন। মূল উদ্দেশ্য হলো এলাকা ভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার এবং আধিপত্য ধরে রেখে চাঁদাবাজি। যার ফলশ্রুতিতে চলছে ব্রাশফায়ার, গুম, খুন, আফিম/গাঁজার চাষ ও মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা এবং এখন নতুন করে যোগ হয়েছে ঘৃণ্য নারী পাচার।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো নিজেদের জাতি গোষ্ঠীর সাধারণ লোকজনেরা এখন পাহাড়ের এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ! কয় দলকে চাঁদা দিবে? কোন দলের মিছিলে যাবে? আবার এক দলকে চাঁদা দিলে অন্য দল এসে মারে! মিছিলে না গেলেও মারে, একদলের মিছিল গেলে অন্য দল এসে মারে। মাঝে মধ্যে রাতে এসে রান্না করা সব খাবার খেয়ে যায়, হাঁস-মুরগি, শাক সবজি নিয়ে যায়! সাধারণ পাহাড়িরা এসব কথা কাউকে কোনভাবে বলতেও পারে না, মুখ খুললেই আবার রাতে এসে মেরে রেখে যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ৬টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের মধ্যে পিজেএসএস (সন্তু লারমাপন্থী) ব্যতীত সবাই চুক্তি বিরোধী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন ও প্রশাসনে অংশীদারত্ব চায়।
১১ জুন ১৯৮৯ তারিখে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সঞ্জয় হাজারিকার প্রতিবেদনে পিজেএসএস মুখপাত্র বিমল চাকমার বক্তব্য থেকে জাতি কী জানতে পেরেছিলো? ২১ জুন ২০২৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত আলতাফ পারভেজ ও আশরাফ রণির নেওয়া সাবেক মিজো গেরিলা নেতা এবং মিজোরাম এর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গার সাক্ষাৎকার থেকে কেএনএফ ও সেভেন সিস্টার্সে নতুন করে শুরু হওয়া ‘কুকি-জো’ সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়ে আমরা কী ইঙ্গিত পেয়েছি? ২৫ নভেম্বর ২০১১ তারিখে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন এর শামীমা বিনতে রহমানকে দেওয়া জনাব সন্তু লারমার সাক্ষাৎকার থেকে জাতি কী নতুন তথ্য পেয়েছিলো? এসব অস্ত্রধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে নিরস্ত্রকরণের কথা না বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য তাড়াহুড়ো এবং UNDRIP এর পালে হাওয়া দেওয়া একজন প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশির পক্ষে কীভাবে সম্ভব হতে পারে?
দুটি রক্তক্ষয়ী দেশ বিভাজনের ফলে সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ রাস্ট্র সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার, আর্থসামাজিক, শিক্ষা, নাগরিক সচেতনতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সহ যাবতীয় মানদণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত এর ধারে কাছেও নেই। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি ও গ্রেট গেম, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার প্রতি অদৃশ্য হুমকি সমূহ, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস ও বাস্তবতা না জেনে ইউটিউব এবং ফেসবুকের ফলোয়ার/ভিউ বাড়ানোর জন্য পোস্ট করা হতে বিরত থাকতে হবে।
লেখক: খাগড়াছড়ি থেকে।
আমাদের সমতলবাসীদের বুঝতে হবে, এটা কোন সম্বোধনে সম্মান বা সরল উদ্দেশ্য চাওয়া কোন স্বীকৃতির দাবী নয়। আদিবাসী স্বীকৃতির দাবীর পিছনে আন্তর্জাতিক গ্রেট গেম জড়িত, যেটা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখন্ডতা হুমকির মুখে পড়বে। নিঃসন্দেহে আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমূহের সাথে অনেক অন্যায় হচ্ছে এবং হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক সরকার চাইলে জাতিসংঘের ঘোষণার চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা দিতে পারে তাদের উন্নয়নের জন্য। তবে কোনভাবেই ঐ ঘোষণার ফাঁদে পা দিয়ে ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক সত্যের বিপরীতে যাওয়ার সুযোগ নেই।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক