ভেঙ্গে পড়ার অপেক্ষায় গাউসপুর ব্রিজ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে তিনটি ইউনিয়ন

ব্রিজ নামের মরণ ফাঁদ

fec-image

যেকোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকিতে আছে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার বগাচত্তর ইউনিয়নের গাউসপুর ফরেস্ট অফিস এলাকার সেতুটি। জানা যায়, জনগণের সুবিধার্থে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে গত ৯০ দশকের শুরুতে উপজেলা সদরের সাথে তিনটি (ভাসান্যাদম, বগাচত্তর, গুলশাখালী) ইউনিয়নবাসীর সড়ক পথে যোগাযোগ গড়ে তুলতে গাউসপুর ফরেস্ট অফিস এলাকায় মাইনী খালের উপর সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

নির্মাণের পর কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে সেতুটি এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। মাইনী খালের প্রবল স্রোতে সেতুটির পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে নড়বরে হয়ে পড়েছে, একটি পিলার ভেঙ্গে গেছে। দুই পাশের রেলিংও ভেঙ্গে গেছে। পাটাতন থেকে কংক্রিটের ঢালাই উঠে গেছে। বর্তমানে সেতুটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই তিনটি ইউনিয়নে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষের বসবাস। এলাকাগুলোতে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিজিবি’র একটি জোনও রয়েছে। যেকোন সময় সেতুটি ভেঙ্গে গিয়ে হতাহতের মতো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বেশ কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই এর উপর দিয়ে চলাচল করছে মানুষজন।

স্থানীয়রা জানান, ‘আমরা দীর্ঘ বছর ধরে গাউসপুর সেতুটি সংস্কার করার জন্য আন্দোলন করে আসছি। সরকারি প্রতিষ্ঠান এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগিদও দিয়েছি। কারণ, তাদের দিয়ে সরকার সেতুটি নির্মাণ করেছিলো। কিন্তু তাদের কোনো পাত্তা নেই।’

গুলশালাখালী ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী সৈয়দ ইবনে রহমত এ প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে করা এক মন্তবে লেখেন, ‘সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন এ ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়বে, কিছু মানুষ হয়তো হতাহতও হবে। তখন নিশ্চয় অনেক জনদরদী নেতা এমনকি প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কেউ তাদের দেখতে আসবেন, শোকাহত আত্মীয়-স্বজনকে সান্ত্বনাও দেবেন, যত দ্রুত সম্ভব ব্রিজটা পুনঃনির্মাণ করে দেওয়ার আশ্বাসও দেবেন। কিন্তু আমরা তখন তাদের সেই সান্ত্বনা আর আশ্বাস ধুয়ে কি পানি খাব? পারলে এখনই কিছু করেন, না পারলে তাও জানিয়ে দিন, মানুষ দেখুক আপনাদের সামর্থ্য।’

সংবাদকর্মী সৈয়দ ইবনের হমতের পোস্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা এক মন্তব্যে জানান, ‘বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জেনেছি। সেতুটি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরি নয়। যে সংস্থাটি তৈরি করেছে তারাই এর সংস্কার করবে।’

এদিকে লংগদু উপজেলার বগাচত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আমরা আর কত আন্দোলন করবো? আমাদের দাবি কেউ পূরণ করছে না।’

তিনি আক্ষেপের সাথে আরও বলেন, ‘আমরা এলজিইডি’র উপজেলা কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগিদ দিয়েছি সেতুটির ব্যাপারে কিছু করার জন্য।কিন্তু তারা নামেমাত্র কয়েকবার পরিদর্শন করে চলে গেছেন। সেতুটি মেরামত বা তৈরিতে তারা আমাদের কাছ থেকে উৎকোচ দাবি করেন। দিতে না পারায় সেতুটির ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে না বলে যোগ করেন তিনি।’

লংগদু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার বলেন, ‘সেতুটি নিয়ে আমি নিজেও আন্দোলনে আছি। আমরা সেতুটি সংস্কার করার জন্য এলজিইডি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং রাঙামাটি জেলা পরিষদকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিত্তর পাইনি।’

চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘এলজিইডি কর্তৃপক্ষ কয়েকবার এসে সেতুটির মাপ নিয়েছিলো। এর পর তাদের আর দেখা যায়নি।’

তিনি জানান, ‘গত কয়েক দিন আগে বৃষ্টির প্রবল বর্ষণে মাইনী খালের স্রোতে সেতুটির দু’টি পিলার ভেসে গেছে। আমাদের এখন একটাই দাবি, সেতুটি সংস্কার নয়, নতুন সেতু নির্মাণ চাই।’

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল লংগদু উপজেলার নির্বাহী প্রকৌশলী রণি সাহা রোববার (১৯ জুলাই) বলেন, ‘উপজেলার গাউসপুর সেতুটি তৈরি করার জন্য আমরা চলতি বছরের জুন মাসে রুরাল ইফ্রেসট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আরআইডিপি-সিএইচটি) এর আওতায় একটি প্রকল্প তৈরি করে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। এবার সেখান থেকে প্রকল্পটি পাস হলে আমরা কাজ শুরু করতে পারবো।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোমবার (২০ জুলাই) রাঙামাটি জেলা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তালেব জানান, ‘লংগদু উপজেলার গাউসপুর ব্রিজটি সম্পর্কে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। এটি আগে এলজিইডি নির্মাণ করেছে নাকি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড করেছে সেটিও দেখতে হবে। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল লংগদু উপজেলার নির্বাহী প্রকৌশলী রণি সাহা নিশ্চিত করেছেন সেতুটি ইতোপূর্বে এলজিইডি নির্মাণ করেছিল এবং তিনি ইতোমধ্যে ব্রিজটি পুনঃনির্মাণের ব্যাপারে রুরাল ইফ্রেসট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আরআইডিপি-সিএইচটি)-এর আওতায় প্রকল্প তৈরি করে পাঠিয়েছেন এটা জানালে প্রকৌশলী আবু তালেব বলেন, ‘আমি খোঁজনিয়ে দেখব।’

সেতুটি যেকোনো সময় ধসে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে এর দায় কে নেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারছি না, বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’

রাঙামাটি জেলা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তালেবের সাথে মোবাইলে কথা বলার পাঁচমিনিট পর লংগদু উপজেলা প্রকৌশলী রণি সাহা প্রতিবেদকের মোবাইলে ফোন করেন। তিনি জানান, ‘উনার আগের দেওয়া তথ্যে কিছু ত্রুটি আছে, সেটা ঠিক করে দিতে চান।’

আগের তথ্যে কী ভুল আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্রিজটি যে আগে এলজিইডি নির্মাণ করেছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো তথ্য উনার কাছে নেই। আর তিনি এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো প্রকল্পও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরকাছে পাঠাননি।’

তাহলে আগে কেন বলেছিলেন যে, রুরাল ইফ্রেসট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আরআইডিপি-সিএইচটি)-এর আওতায় প্রকল্প তৈরি করে পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে রণি সাহা বলেন, ‘পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু সেটি আসলে হয়নি। সিএইচটি-আরডিপি-২ এবং ইউএইচবিপি নামে আরো দুটি প্রজেক্ট রানিং আছে, চেষ্টা চলছে তার কোনোএ কটাতে গাউসপুর ব্রিজটি ঢুকিয়ে দেওয়ার।’

সেটা কবে নাগাদ হতে পারে জানতে চাইলে রণি সাহা বলেন, ‘তিনি মূলত নানিয়ারচর উপজেলার দায়িত্বে আছেন, গত দুই মাস ধরে লংগদুতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে, ছয় মাস আগে লংগদু উপজেলার দায়িত্বে থাকা আগের অফিসার গাউসপুর ব্রিজটির প্রিলিমিনারি মেজারমেন্ট করে একটি প্রস্তাব তৈরি করেছিলেন। এখন ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনে ফাইনাল মেজারমেন্ট করে প্রজেক্ট তৈরি করতে হবে।’

রাঙামাটি আসনের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সেতুটির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। এরপর বিষয়টি জেনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।’

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন