কল্পনা চাকমা অপহরণ: ২৮ বছর পর মামলা খারিজ
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমাকে অপহরণের মামলায় পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাদীর দেওয়া আপত্তি খারিজ করেছেন আদালত। মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) রাঙামাটির বিচারিক হাকিম ফাতেমা আক্তার মুক্তার আদালত এ আদেশ দেন।
বাদীর আইনজীবী জুয়েল দেওয়ান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিজ্ঞ আদালত বাদীর তদন্ত প্রতিবেদনের নারাজি আবেদন না মঞ্জুর করে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে ১১ জুন রাতে অপহরণ হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থিত ছাত্রী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কল্পনা চাকমা। এ ঘটনায় বাঘাইছড়ি থানায় মামলা করেন কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার।
২০১০ সালের ২১ মে পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দেয়। তখন মামলার বাদী ও অপহৃতার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা তা প্রত্যাখান করে ঘটনার পুনঃতদন্তের দাবি করেন। ২০১৬ সালে আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করে রাঙামাটির ওই সময়কার পুলিশ সুপার সৈয়দ তারিকুল হাসানকে এ মামলার তদন্তভার দেন। তিনি দুই বছর পর ২০১৮ সালে কারও বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ার তথ্য জানিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ প্রতিবেদনেও সেসময় নারাজি দিয়েছিলেন কল্পনার ভাই।
কল্পনার অপহরণের জন্য রাঙামাটিতে তখনকার কর্মরত সামরিক বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কল্পনার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়। পাহাড়িসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তিরও দাবি করা হয়।
মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা বলেন,‘আমি আদালতের রায় মানতে পারিনি। আমি আমার বোনের অপহরণের সুষ্ঠু বিচার চাই। বোনের অপহরণ বিচার পেতে আমি আরো উচ্চ আদালতে যাব।’
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাইল্যাঘোনার নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন। এই ঘটনাটি বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বহুল আলোচিত কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা নিয়ে সেই ১৯৯৬ সালে একটি স্বতন্ত্র তদন্ত করেছিল তৎকালীন মানবাধিকার কমিশন।
এ তদন্তের বিষয়ে ১৯৯৬ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তদন্তের নানা তথ্য, উপাত্ত, ভিডিও প্রদর্শন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট কে এম হক কায়সার বলেছেন, “পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তারই লোকজন দ্বারা কল্পনা চাকমা নিখোঁজ রয়েছে। লে. ফেরদৌস অথবা অন্য কোনো সামরিক বাহিনীর সদস্যই যে, এই ঘটনার সাথে জড়িত নয় তা কল্পনা চাকমার মা, আত্মীয় স্বজন ও স্থানীয় জনগণের বক্তব্যে প্রকাশ পায়।
তিনি আরো বলেন, কল্পনা চাকমা বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্যের গন্ডাছড়া মহকুমার শুক্রে নামক স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন, সংগঠনের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট কে এম হক কায়সার। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, সাইফুল ইসলাম দিলদার, মুনির উদ্দীন খান, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ইতরাত আমিন, মানবাধিকার গবেষণা সহকারী সাহেলা পারভীন লুনা।
বিভিন্ন তথ্য প্রমাণসহ লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, কল্পনা চাকমা শেষ কবে মার সাথে যোগাযোগ করেছে, এই প্রশ্নের জবাবে মা বাঁধনি চাকমা জানান, নিখোঁজ হওয়ার পর দুই বার যোগাযোগ করেছে, এবং সর্বশেষে যোগাযোগ হয়েছে ১ আগস্ট ’৯৬। এতে প্রমাণিত হয় যে, কল্পনা চাকমা বেঁচে আছেন এবং কোথায় আছেন তা তার মা বেশ ভাল ভাবেই জানেন।”(দৈনিক মিল্লাত ৯ আগস্ট, ১৯৯৬)।
এ প্রেস কনফারেন্সের পরদিন ৯ আগস্ট ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম দেখা যেতে পারে। ‘মায়ের স্বীকারোক্তি কল্পনা চাকমা এখন ত্রিপুরায়’- দৈনিক মিলাত, ‘কল্পনা চাকমা এখন ত্রিপুরায়: মা’র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে তার’- দৈনিক দিনকাল, ‘কল্পনা চাকমা জীবিত এবং কোথায় আছেন তা তার মা ভালোভাবেই জানেন’- দৈনিক ইনকিলাব, ‘কল্পনা চাকমা ত্রিপুরায় আছেন, অপহরণ সাজানো নাটক মানবাধিকার কমিশনের তথ্য প্রকাশ’- দৈনিক পূর্বকোণ, ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ভাষ্য কল্পনা চাকমা ত্রিপুরায়’- দৈনিক ভোরের কাগজ, ‘কল্পনা চাকমা ভারতে আছেন’- দৈনিক সংগ্রাম, ‘সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, কল্পনা চাকমা ভারতের ত্রিপুরায়।।
অপহরণ ঘটনার সাথে সামরিক বাহিনী জড়িত নয়’- দৈনিক আজাদি, ‘অবশেষে রহস্য ফাঁস কল্পনা চাকমা ভারতে’- দৈনিক দেশনেতা, ‘মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পরিকল্পিতভাবে কল্পনা চাকমাকে নিখোঁজ রাখা হয়েছে’- দৈনিক সবুজ দেশ, ‘সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার কমিশন, কল্পনা চাকমা এখনো বেঁচে আছেন’- দৈনিক লাল সবুজ, ‘কল্পনা চাকমা ত্রিপুরার গঙ্গাছড়া এলাকায় রয়েছে।
কল্পনা চাকমাকে গঠিত একটি তদন্ত কমিটির সদস্য ভারতের অরুণাচলে অবস্থিত কল্পনা চাকমার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কল্পনা চাকমাকে বাংলাদেশে ফিরে আসার আহŸঅবস্থান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। কল্পনা চাকমা ফিরতি চিঠিতে তাকে জানান, তিনিও দেশে ফিরতে আগ্রহী। কিন্তু তিনি দেশে ফিরলে তাকে পাহাড়িদের পক্ষ থেকে হত্যা করা হতে পারে আশঙ্কা করেন।