মাদক ও পতিতার হাট কটেজ জোন, নিয়ন্ত্রণ দুইজনের হাতে

fec-image

কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোনের কটেজগুলোর অধিকাংশই পরিণত হয়েছে মাদক ও পতিতা ব্যবসার স্বর্গরাজ্যে। পর্যটকদের আনাগোনার প্রধান কেন্দ্রস্থলের এই কটেজগুলো রূপ নিয়েছে পতিতার হাটে। স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এসব অপকর্মের মূলহোতা জনৈক আসিফ ও জয়নাল। পতিতা ও মাদক ব্যবসার কারণে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, কটেজগুলোতে পতিতা ও মাদক ব্যবসার জন্য আসিফ ও জয়নালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। চক্রটির সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার নারীদের নানা কৌশলে ফাঁদে ফেলে নিয়ে আসে কটেজ জোনে। এরপর ওইসব নারীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানো হয়। এতে কটেজগুলোতে দিনে-রাতে চালানো হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। পাশাপাশি এসব কটেজগুলো যেন রূপ নিয়েছে মাদক সেবন ও বেচাকেনার নিরাপদ স্থান হিসেবে। পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত খদ্দেররা মাদক ব্যবসায়িদের মূল টার্গেট হলেও সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায়ও পাচার হচ্ছে ইয়াবার বড় বড় চালান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয়দের পাশাপাশি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারীদেরও টার্গেট করেছে চক্রটির সদস্যরা। প্রেম ও বিয়ের প্রলোভনে রোহিঙ্গা নারীদের কৌশলে নিয়ে আসা হয় কটেজগুলোতে। এক পর্যায়ে এসব নারীদের জোরপূর্বক বাধ্য করা হয় পতিতাবৃত্তিতে। কোন কোন নারীকে তুলে দেওয়া হয় পেশাদার পতিতা ব্যবসায়িদের হাতে সম্প্রতি ফাঁদে ফেলে রোহিঙ্গা নারীদের পাচারের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাচারকারি চক্রের ফাঁদে পাচার হওয়া এক রোহিঙ্গা নারীকে খুনের ঘটনাও ঘটেছে কটেজ জোনে। গত রমজান মাসে হোটেল-মোটেল জোনের হোটেল সীপার্ল-১ এর ষষ্ঠ তলার একটি কক্ষ থেকে এক নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ওই নারী ছিল রোহিঙ্গা।

এতে জানা যায়, দালালের খপ্পরে পড়া ওই রোহিঙ্গা নারীকে টেকনাফের ক্যাম্প থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে যায় পাচারকারিরা। সেখানে তাকে বাধ্য করা হয় পতিতাবৃত্তিতে। গত রমজানের আগে ওই নারীকে পাচারকারি চক্রের সদস্যরা তুলে দেয় কক্সবাজারের মোতাহের, আবু হুরাইরা ও বশিরের কাছে। যারা ওই নারীকে কক্সবাজার নিয়ে এসে হোটেল সীপার্লের একটি ফ্ল্যাটে রাখে। সেখানে গত রমজান মাসে পাচারকারিদের নির্যাতনে ওই নারী মৃত্যু ঘটে। আরো অনেক রোহিঙ্গা নারী পাচারের শিকার হয়ে জিন্মি অবস্থায় রয়েছে পাচারকারিদের হাতে। যারা নানাভাবে চেষ্টার পর চক্রটির কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কটেজ জোনে নারী পাচার ও পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত যে কয়জন সক্রিয় দালাল রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম আসিফ নামে পরিচিত এক ব্যক্তি। অন্ধকার জগতে তার নাম আসিফ হলেও আসল নাম মকসুদ মিয়া। সে মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকার মোহাম্মদ রশিদের ছেলে। মামলাসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকরিী বাহিনীর নজরদারি এড়াতে অন্ধকার জগতে ‘আসিফ’ হিসেবে ছদ্মনাম ধারণ করেছে। গত ৮ বছর আগে হত-দরিদ্র আসিফ আজ অঢেল ঠাকার মালিক।

মকসুদ মিয়া ওরফে আসিফ গত ৮ বছর আগে হোটেল জিয়া গেস্ট হাউজের রেস্টেুরেন্টে গ্লাসবয় হিসেবে ৬০০ টাকা বেতনে চাকুরি করত। পরে সেখান থেকে ‘কমপোর্ট’ নামের একটি কটেজে রুমবয় হিসেবে চাকুরি নেয়। ওই কটেজের মালিক ছিলেন কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার সৈয়দ আলম নামের এক ব্যক্তি। তার অধীনে ২/৩ বছর চাকুরির পর ওই কটেজটি আসিফ নিজেই ভাড়া নেয়। পরে জড়িয়ে পড়ে পতিতা ব্যবসায়। কয়েক বছরের পতিতা ব্যবসায় বদলে যায় আসিফের জীবন।

অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যদের বশীভূত করে আসিফ হয়ে ওঠেন কটেজ জোনের পতিতা ব্যবসার একচ্ছত্র অধিকারি। সেই সাথে কমপোর্ট কটেজটি হয়ে উঠে পতিতাদের মজুদাগার। এক পর্যায়ে সে ‘নায়মা’ নামের আরেকটি কটেজ জমিসহ কিনে নিয়ে তার পতিতা ব্যবসার বিস্তার ঘটায়। কটেজটি কিনতে তার খরচ হয় ৬০ লাখ টাকা।

সূত্র জানিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নায়মা ও কমপোর্ট কটেজে একাধিবার অভিযান চালিয়ে নারীসহ পাচারকারি চক্রের সদস্যরা আটক করার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলাও দায়ের হয়েছে। কিন্তু কৌশলী আসিফ প্রতিবারই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে রেহায় পেয়ে যায়। তারপরও কক্সবাজার সদর থানায় তার বিরুদ্ধে মানবপাচার মামলায় একটি মামলা রয়েছে। সেই মামলায় পুলিশ আসিফের কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেপ্তারও করেছিল।

আসিফের পতিতা কারবার ও নারী পাচার চক্রের অন্যতম সহযোগী চকরিয়ার হারবাং এলাকার জাহেদ ও ম্যানেজার সাইফুল। মূলত তারাই বিভিন্ন এলাকার নারীদের কৌশলে ফাঁদে ফেলে কটেজে নিয়ে আসে। বর্তমানে নায়মা রিসোর্টটি যেন পাচার হয়ে আসা নারীদের মজুদাগার। আর এসব নারীদের সুরক্ষার জন্য কমপোর্ট কটেজে সিসিটিভি স্থাপন করে মনিটরিং করা হয়। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কমপোর্ট কটেজের পিছনে রাখা হয়েছে একটি গোপন দরজা। যাতে অভিযানকালে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ঘটে।

আসিফের কটেজের চাকুরি করা সাবেক এক কর্মচারী জানিয়েছেন, হোটেল-মোটেল জোনের সীপার্ল-১ ও সীপার্ল-২ তে ফ্ল্যাট রয়েছে আসিফের। যেগুলোতে মজুদ রাখা পতিতাদের। ওইসব ফ্ল্যাটে যাতায়াত রয়েছে ভিআইপি খদ্দেরদের।

পাশাপাশি আসিফ একজন পেশাদার মাদকাসক্ত। কমপোর্ট কটেজে ইয়াবা সেবনের জন্য রাখা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট কক্ষ। ওই কক্ষে সে নিয়মিত তার সহযোগীদের নিয়ে ইয়াবা সেবনের আসর বসায়।

মাদক জগতে আসিফের অন্যতম সহযোগী জয়নাল নামের এক ব্যক্তি। জয়নালের বাড়ি রামু উপজেলার জোয়ারিয়ারনালায়। বিদেশ ফেরত জয়নাল শুরুতে ফাহিম নামের একটি কটেজ ভাড়া নেয়। ওই কটেজটিতে অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগ পাওয়ায় মালিকপক্ষ চুক্তি বাতিল করে। পরে জয়নাল ‘সাজ্জাদ’ নামের আরেকটি কক্ষ ভাড়া নেয়। সাজ্জাদ কটেজটি ভাড়া নেয়ার এক সপ্তাহের মাথায় এক তরুণী খুনের ঘটনা ঘটে। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।

পতিতা ব্যবসার সুযোগে আসিফের সঙ্গে জয়নালের সুসর্ম্পক গড়ে উঠে। এতে দুইজনেই জড়িয়ে পড়ে মাদক কারবারে। জয়নালের নেতৃত্বে ঢাকা ও চট্টগ্রামে রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তার কয়েকজন সহযোগীও আটক হয়েছিল। কক্সবাজার থেকে বিমান যোগে চক্রটি ইয়াবাপাচারে সক্রিয় রয়েছে।

স্থানীয়দের দাবি, আসিফ ও জয়নালকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে কটেজ জোনে আইন-শৃঙ্খালা পরিস্থিতির পাশাপাশি অনৈতিক কর্মকাণ্ডের লাগাম অর্ধেকটা টেনে রাখা সম্ভব হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন