সরকার কি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূ-খন্ডের নিয়ন্ত্রণ হারাতে যাচ্ছে?
এ এইচ এম ফারুক
সূত্রমতে, গত সোমবার আঞ্চলিক পরিষদ তথা পাহাড়ীদের প্রতিনিধিদের বিভক্ত তিন গ্র“পের একাংশের নেতাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ বাস্তবায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উচ্চ আদালতের রায় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রবল আপত্তিকে উপেক্ষা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১ এর ৬(১)(গ) এর শর্তাংশ বাতিলসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সংশোধনীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল (রিজার্ভ ফরেষ্ট), কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্প এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত সকল প্রকার ভূমির উপর সরকারের আর কোন কর্তৃত্ব থাকবে না। বৈঠকে সরকারের ভূমি সংশ্লিষ্ঠ ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও মন্ত্রনালয়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন ২০০১ সংক্রান্ত সভায় আইনটি সংশোধনের এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে আঞ্চলিক পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রচন্ড বাগ-বিতন্ডা হয়। সূত্রে আরো জানা যায়, বিদ্যমান আইনে ৬(১)(গ) এ উল্লেখিত সম্পত্তিতে পার্বত্য জেলা পরিষদের কোন কর্তৃত্ব নেই। কিন্তু এই ধারার শর্তাংশ তুলে দিলে তখন তাদের কর্তৃত্ব সৃষ্টি হবে। আইনের ৭(৫) ধারায় বলা আছে ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়টিসহ এর এখতিয়ারভুক্ত অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হলে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে। এটি সংশোধন করে আইনে থাকছে চেয়ারম্যানসহ সদস্যদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তই হবে কমিশনের সিদ্ধান্ত। পার্বত্য বাঙালীদের অভিযোগ চুক্তি অনুযায়ী গঠিত কমিশনে তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে। এ কমিশনের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালীদের কোন প্রতিনিধি অন্তরভূক্ত করা হয়নি। কমিশনের চেয়ারম্যানসহ মোট ৯ জন সদস্যের মধ্যে এই কমিশনে দু’জন সরকারী কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি এবং বাকি ৭ জন সদস্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের প্রতিনিধি এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ নেতা। উল্ল্যেখ্যযে: কমিশনের বিরোধ নিষ্পত্তির পৃথক ৩ জেলার ৩টি প্যানেল হলো প্রতিটিই চেয়ারম্যানসহ ৫ সদস্যের। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ তথা পাহাড়ে বসবাসকারী একাংশ পাহাড়ী জনগোষ্ঠি যে ভাবে চাইবে বা যা বলবে প্রকারান্তরে তাই হবে কমিশনের সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে সেখানে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণই থাকবে না।
জানা গেছে আঞ্চলিক পরিসদের প্রস্তাবিত সুপারিশের ১০টি ধারার ৪টিতে প্রচন্ড মতভেদ থাকা সত্ত্বেও তা সংশোধনের জন্য মন্ত্রি পরিষদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের রায়ও উপেক্ষিত হচ্ছে। ২০০০ সালের ২৬৬ নং রিট মামলার রায়ে উচ্চ আদালত আঞ্চলিক পরিষদ বাতিল করে দেয়। উচ্চ আদালত আঞ্চলিক পরিষদ বাতিল করলেও তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে এই কমিশন আইনের সংশোধনের কার্যক্রম চলছে। ২০১০ সালের ১৩ এপ্রিল দেয়া উচ্চ আদালতের এই রায়ে জেলা পরিষদের কতিপয় ধারা যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তাও বাতিল করা হয়। বিগত ২৮ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের আলোকে একটি সুপারিশমালা তৈরি করা হয়। এই বৈঠকে ১০টি সুপারিশের মধ্যে ৪টি ধারার বিষয়ে মতভেদ থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে গত ১২ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ বাস্তবায়ন কমিটির সভায় মতভেদ থাকা এই চারটি ধারাও অন্তর্ভুক্ত করে একটি সুপারিশ তৈরি করা হয়। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তৈরি করা এই সুপারিশ কোন পরিবর্তন না করে তা মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এই পার্বত্য চুক্তিতে সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। এটি সরকারের সঙ্গে কোন চুক্তি না হলেও এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য এলাকায় ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃত্ব হারাতে যাচ্ছে। তৎসময়ে সম্পাদিত এ চুক্তিকে সরকার ও জনসংহতি সমিতি শান্তি চুক্তি বললেও পাহাড়ে বসবাসকারী অধিকাংশ বাঙালী জনগোষ্ঠি, বিরোধীদল ও বেশ কয়েকটি জাতীয় রাজনৈতিক দল এ চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যা দিয়েছিল। অপরদিকে চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে পাহাড়িদের একাংশ। যারা সন্তু লারমার জন সংহতি সমিতি থেকে বের হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন এবং আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পার্বত্য এলাকা নিয়ে পৃথক ভূখন্ড গঠনের নীলনকশা বাস্তবায়নে নেমেছে একটি মহল। মূলত আড়াইশ বছরের অভিবাসী হয়ে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে তারা ৪ হাজার বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙালীদের বহিরাগত আখ্যাদিয়ে বিতারণের চেষ্টায় সক্রিয় রয়েছে। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে নিজেদের উপজাতীয় হিসাবে পরিচয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি নিয়েও আবার নিজেদের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠা নিতে উঠে পড়ে লেগেছে খোদ সন্তু লারমা তথা আঞ্চলিক পরিষদ। এটা প্রতিষ্ঠা পেলে পার্বত্য তিন জেলায় সরকার তার কর্তৃত্ব হারাবে। উঠে যাবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত আইনের শাসন। পাহাড়ীরা তাদের নিজস্ব আইনের শাসনে চলবে। ইচ্ছা করলেও অন্য কেউ জায়গা কিনতে পারবে না। একই সঙ্গে সরকারের অধীনে থাকা কাপ্তাই প্রকল্প, বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমিও তাদের অধীনে চলে যাবে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে পার্বত্য তিন জেলা নিয়ে আলাদা ‘এস্টেট’ গঠনের নেপথ্যে রয়েছেন স্বাধীনতা বিরোধী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের পুত্র রাজা দেবাশীষ রায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিদিব রায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টির প্রতিটি আসনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু এই ত্রিদিব রায়ের প্রভাবে ওই এলাকার ১টি আসনে হেরে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ অবস্থায় তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং বর্তমানেও সেখানে রয়েছেন। চাকমা রাজার ছেলে রাজা দেবাশীষ রায় নেপথ্যে থেকে পার্বত্য তিন জেলাকে বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে আলাদা করার পাঁয়তারা করছেন। সোমবারের ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেল চীপ রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথ্যাবিজ্ঞমহল বলে আসছেন, তাদের এ সব দাবি পূরণ হলে তিন পার্বত্য এলাকায় সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাঁদের দাবি অনুযায়ী ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পুরো কাপ্তাই লেক তাদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। হস্তান্তর করতে হবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলও (রিজার্ভ ফরেস্ট)। মূলত আদিবাসীর অধিকার চাচ্ছে পাহাড়ী গোষ্ঠীগুলো। জাতিসংঘের আদীবাসী সংজ্ঞায় উল্লেখ আছে, কোন আদিবাসী এলাকায় সেনা চলাচল করা যাবে না। এলাকার কোন জমি সরকার ব্যবহার করতে পারবে না। অনুমোদন ছাড়া আদিবাসী এলাকায় প্রবেশও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া আদিবাসী হলে অপরাধ করলেও তাদের রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে কোন বিচার বা গ্রেফতার করা যাবে না। তারা তাদের নিজস্ব আইনে অপরাধীদের বিচার করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম তথ্যাবিজ্ঞ মহল’র তথ্যমতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ নিজেদের আদিবাসীতে পরিণত করতে দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তদ্বির চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাঁদের পেছনে রয়েছেন তাঁদের নেতা চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায়। আদিবাসীর মর্যাদা আদায়ের পাশাপাশি ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করতে পারলে তাঁরা তাঁদের লক্ষ্য অর্জন করে ফেলবেন।
পাহাড়ের ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ভূমি জটিলতা নিরসনে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন প্রণয়ন ও কমিশন গঠন করা হয়। বিভিন্ন সময় সরকার অধিগ্রহনকৃত ভূমি ও বাঙালীদের নামে দেয়া বন্দোবস্তকৃত জমিও কমিশনের আওতায় আনতে চাচ্ছেন পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ।
গত বছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ভুল ব্যবহার হচ্ছে উল্লেখ করে তা না করার জন্য নির্দেশনা জারি করেন। তখন বলা হয়, বাঙালীরা আদি অধিবাসী হিসেবে বিগত ৪ হাজার বছর ধরে বসবাস করছে বলে বিভিন্ন ভাবে প্রতীয়মান হয়। অপরপক্ষে ঐতিহাসিক সূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের ভূখন্ডে তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৭২৭ সাল থেকে মাত্র দুই শ’ বছর বসবাস করছে বিধায় তাঁরা আদিবাসী নন।
লেখক: জন্মসূত্রে পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসী ও ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক