২০১৯ সালে খাগড়াছড়ি জেলা ছিলো ঘটনাবহুল
বছরের শুরুতেই ১৪ জানুয়ারি পার্বত্য খাগড়াছড়ির রামগড়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে মোহন কুমার ত্রিপুরা (৩৫) নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমনএন লারমা) এক নেতাকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ২০১৯ সাল।
এছাড়া মানিকছড়িতে ৩৮০ রাউন্ড ৬২ মিমি (চায়না) গুলির খোসা উদ্ধারের ঘটনার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সাথে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়িতে। রামগড়ের দুই আলোচিত হত্যকাণ্ডের রায় ঘোষণা ছাড়াও খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে গেল বছরের শেষ দিকে। বছরের শেষ দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনের শুনানিকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি উত্তাল হয়ে উঠে।
দিঘীনালায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা, পাল্টা গুলিতে তিন ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী নিহত:
২৬ আগস্ট খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর টহলে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীদের হামলা, পাল্টা গুলিতে তিন সন্ত্রাসী নিহত হয়। এসময় বেশ কিছু ভারী আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। ঐদিন সকালে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার বড়াদমে সোনাবাহিনী টহলে সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে এ ঘটনা ঘটে।
সেনাবাহিনীর পাল্টা গুলিতে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) প্রসীত গ্রুপের তিন সন্ত্রাসী বুজেন্দ্র চাকমা, জ্যোতি চাকমা ও রশিল চাকমা নিহত হয়। ঘটনার দিন সকালে সেনাবাহিনীর একটি টিম হিসেবে দিঘীনালা উপজেলার বরাদম এলাকা থেকে আর ৬ কি. মি. গভীরে নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে মোতায়েন ছিলো।
এ সময় পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে ওঁৎপেতে থাকা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের একটি টিম সেনাবাহিনীর উপর অবিরাম গুলি ছুঁড়তে থাকে। সেনাবাহিনীও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। উভয়পক্ষে টানা ৪৫ মিনিট গুলি বিনিময়ের পর টিকতে না পেরে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে তিন উপজাতীয় সন্ত্রাসীর লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশের পাশ থেকে গুলিসহ একটি আমেরিকান এম-৪ অটোমেটিক কারবাইন রাইফেল ও দুটি পিস্তল উদ্ধার করে।
৩৮০ রাউন্ড (চায়না) গুলি উদ্ধার
খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনার একদিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে ৬২ মিমি ৩৮০ রাউন্ড (চায়না) গুলির খোসা ও ২ রাউন্ড তাজা গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনার দিন সকালে মানিকছড়ির বড়ডলু মুসলিমপাড়া এলাকা থেকে সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল এসব গুলি ও খোসা উদ্ধার করে।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফের (প্রসীত গ্রুপ) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ বড়ডলু এলাকায় অবস্থান করছে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে লক্ষ্ণীছড়ি জোনের সেনা সদস্যরা অভিযান চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। তখন আত্মরক্ষার্থে সেনা সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। এছাড়া গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জনপ্রিয় চাকমা (৪৫) নামে এক সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে আটক করে সেনাবাহিনী।
পরে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে একটি এসএমজি এবং ২৬ রাউন্ড গুলিভর্তি একটি ম্যাগজিন উদ্ধার করে তারা। ১ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি লক্ষ্ণীছড়িতে অভিযানে অস্ত্রসহ ইউপিডিএফ’র (প্রসীত) গ্রুপের ২ সন্ত্রাসীকে আটক করে যৌথবাহিনী। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়, আমেরিকার তৈরি এম-ফোর রাইফেল ১টি, ম্যাগজিন ১টি, তাজা ৫৩ রাউন্ড গুলিসহ চাঁদা আদায়ের রশিদ ও অন্যান্য কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।
জেএসএস-ইউপিডিএফ নেতা খুন
পার্বত্য খাগড়াছড়িতে প্রতিপক্ষের গুলিতে মোহন কুমার ত্রিপুরা (৩৫) নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমনএন লারমা) এক নেতা নিহত হয়েছেন। ১৪ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে রামগড়ের জগন্নাথ পাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত মোহন কুমার ত্রিপুরা জেএসএসের (এমএন লারমা) রামগড় উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক।
তিনি মাটিরাঙ্গা উপজেলার থলিচন্দ্র মহাজন পাড়ার কৃষ্ণ ত্রিপুরার ছেলে বলে জানা গেছে। রামগড়ের জগন্নাথপাড়ার বাসিন্দা প্রদেশ ত্রিপুরার বাড়িতে অন্যদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন জেএসএস নেতা মোহন কুমার ত্রিপুরা। এ সময় কতিপয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাড়ির ভেতর ঢুকে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার জন্য পার্বত্য চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) দায়ী করেছে জেএসএস (এমনএন লারমা)।
এ হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহ না পেরুতেই পিপলু বৈষ্ণব ত্রিপুরা (৪১) নামে এক ইউপিডিএফ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। ১৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে খাগড়াছড়ির গাছবান এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত পিপলু বৈষ্ণব ত্রিপুরা রামগড়ের বল্টুরাম এলাকার মৃত নিগমানন্দ বৈষ্ণব ত্রিপুরার ছেলে। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) কেন্দ্রীয় সংগঠক মাইকেল চাকমা এ ঘটনার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস-এমএন লারমা) দায়ী করে।
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ খাগড়াছড়ির পানছড়িতে রনি ত্রিপুরা (৩২) নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-এমএন লারমা) এক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পানছড়ি উপজেলা সদরের শুকতারা বোর্ডিংয়ের পাশে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রনি ত্রিপুরা পানছড়ির মরাটিলা এলাকার মৃত মনিন্দ্র লাল ত্রিপুরার ছেলে।
পার্বত্য খাগড়াছড়িতে একের পর এক হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতায় প্রতিপক্ষের গুলিতে তুষার চাকমা (২৫) নামে এক ইউপিডিএফ সমর্থক খুন হয়েছেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি-২০১৯ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের নারায়ণখাইয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তুষার চাকমা জেলার লক্ষ্ণীছড়ি উপজেলার বাসিন্দা। পেশায় তিনি ব্যাটারিচালিত আটোরিকশা (টমটম) চালক ছিলেন।
আলোচিত দুই হত্যাকান্ডের রায়
খাগড়াছড়িতে স্ত্রী ও ছয় মাসের শিশুপুত্রকে শ্বাসরোধ করে হত্যার দায়ে মো. ছাবের আলী (২৯) নামের এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি তার ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার দায়ে ছাবের আলীর বাবা মো. মাহবুব আলী (৫৪) ও মা রেনু আরা বেগমকে (৪৯) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে বিচারক এ রায় প্রদান করেন। মামলার অপর আসামি ছাবের আলীর ছোট ভাই মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়।
এদিকে খাগড়াছড়িতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যার দায়ে রবিউল ইসলাম (২৫) নামের এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তার এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২১ নভেম্বর দুপুরের দিকে খাগড়াছড়ির নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক এবং জেলা ও দায়রা জজ রেজা মো. আলমগীর হোসেন এ রায় দেন।
আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সম্পন্ন
বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সাত বছর পর ২৪ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সম্পন্ন হয়। কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মো. মাহবুবুল আলম হানিফ ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে সভাপতি, নির্মলেন্দু চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক ও মো. দিদারুল আলম দিদারকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ তাদের নাম ঘোষণা করেন।
পার্বত্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক। ১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি পার্বত জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল পার্বত্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৫ম বৈঠক। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. দবিরুল ইসলাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কমিটির সদস্য বীর বাহাদুর উ শৈ সিং, সংসদীয় কমিটির সদস্য এবিএম ফজলে করিম, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও নারী সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা প্রমুখ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘ বৈঠকের পর বিকেল ৩টার দিকে কমিটির সভাপতি মো. দবিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও আলাপ-আলোচনা চলছে। অচিরেই পাহাড়ের মানুষের শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। পার্বত্য এলাকায় স্থায়ী কমিটির এ ধরনের বৈঠক এ অঞ্চলের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বুঝতে সক্ষম হবে বলেও জানান তিনি।
ভূমি কমিশনের শুনানিকে কেন্দ্র করে উপ্তত্ত পাহাড়
বছরের শেষ দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের শুনানিকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি উত্তাল হয়ে উঠে। কমিশনের একপেশে শুনানি বন্ধের দাবিতে ২৩ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ।