অদম্য নেপাল চাকমার মেডিকেলে চান্স পাওয়ার গল্প
ছোটবেলা থেকেই নেপালের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার, সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে জড়ানোর। অবশেষে নেপাল চাকমা সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে।
কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার ১নং জালিয়াপালং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মনখালী চাকমাপাড়া গ্রামের অংচাইগ্য চাকমা ও ছিংলাই চাকমার ছেলে।
দর্জি পিতার চার ছেলে। অত্যন্ত মেধাবী নেপাল চাকমা ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখা করতে ভালোবাসতেন। মেধাবী এই ছাত্র এলাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মনখালী চাকমাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৪.৮৩ পেয়ে পিএসসি’তে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়। এরপর টেকনাফ বাহারছড়ার শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ ও এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৮৯ পেয়ে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয় ।
স্কুলের সব প্রতিযোগিতা, অনুষ্ঠান সবকিছুতেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রিয় নেপাল, ছোটদের নেপাল ভাই। এসএসসির গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয় কক্সবাজার সরকারি কলেজে।
কক্সবাজার শহর হতে তার বাড়ির দূরত্ব ছিলো আনুমানিক ৬০ কিলোমিটারের বেশী। হত-দরিদ্র পরিবারের ছেলে নেপাল চাকমা তার জীবন সংগ্রামে দেখেছে কত রং বেরং এর বৈচিত্র্যময় মানুষ। যারা কিনা তাকে কেউ বা আড় চোখে চেয়েছে আবার কেউ বা সৎ সাহস বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সামনে চলার পথকে মসৃণ করে দিয়েছে।
নেপাল স্কুল ও কলেজ জীবনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, লয়ার, প্রোগ্রামার, ম্যাথমেটিশিয়ান আরো কত কিছুই হওয়ার স্বপ্ন দেখত। তবে সাদা অ্যাপ্রোনের মায়া উপেক্ষা করতে পারেনি সে। তাই দিন রাত একাকার করে নিজেকে সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে জড়াতে কতই না প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয়েছে। তবু জীবন যুদ্ধে থেমে থাকেনি অদম্য নেপাল।
কলেজ জীবন ছিল তার কাছে স্বপ্নের মতো। কলেজের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া, বিভিন্ন প্রতিযোহগিতায় প্রথম হওয়া, বিশেষ করে বিভিন্ন মেধাভিত্তিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার গ্রহণ করাসহ সবকিছু মিলিয়ে জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল তার।
অদম্য নেপাল তার জীবন যুদ্ধে বহুবার থেমে গিয়েও উঠে দাড়িয়েছে। নেপাল চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তার পিতা প্যারালাইজড রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। তখন তার দুই বড় ভাই টিটন চাকমা ও মিদুল চাকমা শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।
কিন্তু তা আর হতে দিলো না সব প্রতিবন্ধতাকে উপেক্ষা করতেই মাঠে নেমে যায় নেপালের মমতাময়ী মা ছিংলাই চাকমা। যেখানে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে তিনি লড়েছেন একাই একদিকে সংসার সামলানো অন্যদিকে প্যারালাইজডে আক্রান্ত হওয়া স্বামীর ঔষধের খরচ চালানো। তাদের এ প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় ছিংলাই চাকমা কখনো খেটেছে দিন মজুর হয়ে কখনো বা নিজেদের সঞ্চয়কৃত স্বপ্ল পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়েছে।
তাদের এ ক্রান্তিলগ্নে পাশে দাড়িয়ে ছিলো এলাকার জনপ্রতিনিধিরা সেই সাথে এলাকারা শিক্ষানুরাগী ও সুশীল সমাজ। যাদের বদৌলতে সব প্রতিবন্ধকতা সামলিয়ে নিয়েছে ছিংলাই চাকমা একাই।
সদ্য মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নেপাল চাকমা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে , আমার বাবা একজন সৎ দর্জি ছিলেন, শামলাপুর বাজারে যতেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু বাবা হঠাৎ প্যারালাইজডে আক্রান্ত হয়ে গেলে মা ৬ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছে। একদিকে বাবার মাসিক ঔষধের খরচ চালানো অন্যদিকে এতবড় পরিবারের ভরণপোষণ সবকিছু মিলিয়ে আমার মায়ের জন্য প্রতিবন্ধকতা ছিল। তারপরে ও মা জীবনে সংগ্রামে করে গেছে।
তখনকার সময়ে অনেক জনপ্রতিনিধি কাছ থেকে নানান ভাবে সাহায্য সহযোগিতা চেয়েছেন তা পেয়েছেন । বিশেষ করে একজনের কথা বা বললেই নয়, তিনি হলেন টেকনাফের বাহারছড়ায় শিক্ষার মশালের আলোড়ন সৃষ্টিকারী শ্রদ্ধেয় স্যার মাস্টার এম এ মনজুর। স্যার আমাদের তিন ভাইকে বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি অনেক ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্যারের কাছে চিরজীবন ঋণী হয়ে থাকব।
আমি আমার পরিবারের দুর্দশা খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই অনুধাবন করেছি হত-দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জীবনের পথ চলা কত প্রতিবন্ধকার সম্মুখীন হতে হয়। তাই আমি পড়াশোনার পাশাপাশি চেষ্টা করি সামাজিক কাজকর্ম নিজেকে সংযুক্ত রাখার । যেন কোন শিক্ষার্থী যাতে অর্থের অভাবে অকালে ঝরে না পড়ে। সেজন্য আমি এলাকার সেচ্ছাসেবীদের নিয়ে একটা সেচ্ছাসেবী সংগঠনও গড়ে তুলেছি। যেখানে আমরা অর্থে অভাবে ঝড়ে পড়া রোধে কাজ করে যাচ্ছি।
সর্বশেষ নেপাল চাকমা সবার কাছে দোয়া চেয়ে বলেন, আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে আমি প্রান্তিক মানুষের কাছে দৃঢ়ভাবে লেগে থাকতে পারি।
নেপাল চাকমার মা ছিংলাই চাকমা বলেন, আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ যার অশেষ মেহেরবানিতে আমার ছেলে নেপাল চাকমা মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। আমি একজন মা হিসাবে গর্বিত আমার ছেলের এমন অর্জনে। আমার অতীতের সকল দুঃখ কষ্টের সুফল আজ পেয়েছি। আর যারা আমাকে আজকের এ অবস্থানে পৌঁছতে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিলেন সবার প্রতি আবারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ।সকলেই আমার ছেলের জন্য আশীর্বাদ করবেন যেন আমাদের প্রান্তিক মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারে।