আত্মখুশিতে ভাসানচরে গেল রোহিঙ্গারা

fec-image

আত্মখুশিতে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে গেল রোহিঙ্গাদের একটি দল। বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে ১১টি বাসে করে রওনা দিয়েছে তারা। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ এলাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে অন্তত ৩০০জন রোহিঙ্গা থাকতে পারে বলে ধারণা রোহিঙ্গা নেতাদের। এরা ছাড়াও মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকেও বেশকিছু রোহিঙ্গা ভাসানচর এলাকায় যেতে ট্রানজিট পয়েন্টের পথে রয়ে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এ ব্যাপারে প্রশাসনের কেউ কথা না বললেও র‌্যাব -১৫ কমান্ডার আজিম আহমেদ জানিয়েছেন সকাল থেকেই তারা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। এ সংক্রান্ত কিছু ছবি ও ভিডিও সরবরাহ করেন তিনি

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে প্রাণে বাঁচতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার পর পেরিয়ে গেছে ৩৯ মাস। এর মাঝে দুই দফা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলেও রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের শিবিরের ওপর চাপ কমানোর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে ভাসানচরের দিকে পাঠানো হলো।

অসমর্থিত সূত্রমতে, স্বেচ্ছায় যারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তাদের পাঠানোর মাধ্যমেই এ স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। মাঠে একাধিক কাপড়ের প্যান্ডেল ও বুথ তৈরি করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের কেউ মুখ খুলতে না চাইলেও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপক আয়োজন চোখে পড়ার মতো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ট্রানজিট পয়েন্টে চলে আসে। বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) ভোর থেকে আসা শুরু করে অন্যরাও। আগে থেকে প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা ও খাদ্যসামগ্রী মজুত করা হয়। উখিয়া কলেজ মাঠ থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হয় সকালে।

সূত্রমতে, ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম ঘিরে ভাসানচর দ্বীপ ঘুরে আসে ২২টি এনজিওর প্রতিনিধি দল। ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে মজুত করা হয়েছে প্রায় ৭০টন খাদ্যসামগ্রী।

বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝিরা জানান, অনেক রোহিঙ্গা পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচর যেতে উদ্যোগী হচ্ছে। তাদের অনেকে বুধবার (২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ট্রানজিট পয়েন্টে চলে যায়। বাকিরা আজ সকালে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আন্তর্জাতিক একটি এনজিওর কর্মকর্তা বলেন, বার বার অভিযোগ উঠেছে এনজিওদের প্ররোচনায় রোহিঙ্গারা ভাসানচর যাচ্ছে না। তাই এবারের যাত্রায় কোন এনজিও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে নয়।

এদিকে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর ১৪টি জাহাজ। প্রথম দুই মাস তাদের রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর নিজ নিজ বাসস্থানেই তারা রান্না করতে পারবেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেওয়ার আগে ২২টি এনজিওর প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সরকারের পরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তারা।

সম্প্রতি দ্বীপটি ঘুরে দেখা গেছে পালস বাংলাদেশ সোসাইটি, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ, ফ্রেন্ডশিপ, এসএডব্লিউবি, শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল : বাংলাদেশ, গ্লোবাল উন্নয়ন সংস্থা, আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার, সনি ইন্টারন্যাশনাল, আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন, হেলথ দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, জনসভা কেন্দ্র, কারিতাস বাংলাদেশ, সমাজকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস), সোশ্যাল এইড, সিডিডি, মুক্তি- কক্সবাজার, ভলান্টারি অরগানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, আর টি এম ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল, আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল। এসব এনজিও সেখানে কাজও শুরু করেছে।

এদিকে, দীর্ঘ দিন ধরে প্রচার পেয়ে আসছে ১ লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচর যাচ্ছে। অবশেষে এর যাত্রা শুরু হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছেন।

সূত্র জানায়, উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে ঠাসাঠাসির বসবাস ছেড়ে ভাসানচরে যেতে তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা রাজি হয়েছে। তবে চার থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত।

নোয়াখালীর হাতিয়ায় সাগরের মাঝে ভেসে থাকা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সংবলিত ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। বসবাসের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দেখতে গত সেপ্টেম্বরে দুই নারীসহ ৪০ রোহিঙ্গা নেতাকে সেখানে নিয়ে যায় সরকার। তারা ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়। তারা ক্যাম্পে ফিরে অন্যদের ভাসানচরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। দু’বছর আগে সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের অনিচ্ছার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না।

ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের অনেকে জানান, তারা ভাসানচর পরিদর্শন শেষে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের মুখে সেখানকার বর্ণনা শুনে বসবাস করতে যেতে রাজি হয়েছেন। তাদের মতে পাহাড়ের ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাসের চেয়ে ভাসানচর অনেক নিরাপদ হবে। এ ছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নির্মিত অবকাঠামো অনেক বেশি আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত মনে হয়েছে রোহিঙ্গাদের।

কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়ার ইতিবাচক মনোভাব দেখে তাদের সেখানে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সরকার। রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে নিরাপদে ভাসানচরে পাঠাতে পারলে আরও অনেক পরিবার সেখানে যেতে আগ্রহী হবে বলে সরকার আশাবাদী।

এদিকে, কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যেন সব তথ্য জেনে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। বুধবার সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার যে পরিকল্পনা সরকার চূড়ান্ত করেছে, তার সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।

এ স্থানান্তর প্রক্রিয়ার প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমে বা রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ভাসানচর, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন