“‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যা করছে, তা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে করছে। এরা রাতে ওপারে যায় এবং তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাদকপাচার করছে।''”

কক্সবাজারকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার

fec-image

‘রোহিঙ্গারা আলাদা জনগোষ্ঠী, তাদের সংস্কৃতি আলাদা। তাদের অপরাধের বিচার দেশের প্রচলিত আইনে না হলেও আলাদা আইনি ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে অপরাধ সংঘটিত করে বের হয়ে যেতে না পারে।

মাদক বিরোধী অভিযান জোরদারের লক্ষ্যে কক্সবাজারকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। একই সাথে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকাও রয়েছে সে তালিকায়। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে মাদক প্রবেশের সবচেয়ে বড় এই রুটকে সরকার মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে রূপরেখা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।

রবিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, কমিটির আগের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা এবং কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করার বিষয়টি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ আসে। রবিবারের বৈঠকে ওই সুপারিশের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সব বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয় সভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যসূচি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। সভায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা এবং কক্সবাজার জেলাকে মাদকপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করার বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিটির আগের বৈঠকে (১৫ জানুয়ারি ২০২৩) সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ্ আল মাসুদ চৌধুরী প্রসঙ্গটি তোলেন। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও উৎপাদনকারী দেশগুলোর কাছাকাছি অবস্থান, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকে আক্রান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ, ভারত থেকে হেরোইন, গাঁজা, ফেন্সিডিল ও ইনজেক্টিক ড্রাগের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে।’ পরে তিনি সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক চোরাচালান রোধকল্পে সীমান্ত নিশ্চিতকরণ, স্যাটেলাইট মনিটরিং প্রযুক্তি স্থাপন এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন, চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার এলাকাকে মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণা করার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।

ওই বৈঠকে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘গত ৩ বছরে মিয়ানমার সীমান্তে বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে যে পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদক আটক করা হয়েছে, তার মূল্য ১ হাজার ৯শ’ কোটি টাকার বেশি।’

বৈঠকে ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যা করছে, তা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে করছে। এরা রাতে ওপারে যায় এবং তাদের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাদকপাচার করছে। যে মাদক উদ্ধারের কথা জানা যায়, তা মূলত ২ বা ৩ শতাংশ মাত্র। এতে সহজেই অনুমান করা যায়—কী বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সেখানে সম্পৃক্ত। এ এলাকাটি মাদকের অভয়ারণ্য। এটিকে কঠোরভাবে দমন না করলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এই এলাকায় দিনের বেলায় এক চিত্র, রাতে তা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এ অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় লোকও সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে।’

কোনাপাড়া ক্যাম্প ও নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের চলাচল এবং যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আলাদা জনগোষ্ঠী, তাদের সংস্কৃতি আলাদা। এরা এ দেশে আশ্রয়গ্রহণকারী। তাদের অপরাধের বিচার দেশের প্রচলিত আইনে না করে, তাদের জন্য আলাদা আইনি ব্যবস্থা রাখা দরকার, যাতে অপরাধ সংঘটিত করে বের হয়ে যেতে না পারে। মাদকের বিচারকাজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করা দরকার, যাতে অন্যরা ভয় পায়, বুঝতে পারে যে বেআইনি কাজ করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে।’

বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ডেটাবেজ তৈরি করা হয়। রোহিঙ্গা ডেটাবেজটি এনটিএমসিকে প্রদান করা হলেও ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ে তা হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে বর্তমানের ডাটাবেজ না থাকায় আইন প্রয়োগকারী, গোয়েন্দা ও তদন্ত সংস্থাগুলো বিভিন্ন তদন্তের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। এতে তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।’

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণার পুনরুল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘মাদকপাচারের সঙ্গে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি যিনিই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। মাদক ব্যবসায়ী যত শক্তিশালীই হউক না কেন, প্রধানমন্ত্রীর থেকে তা শক্তিশালী নয়। ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের সঙ্গে কোনও আপস হতে পারে না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এখানে বাস করতে হলে আমাদের দেশের আইন মানতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়—এমন কর্মকাণ্ড থেকে তাদের দূরে থাকতে হবে। এসব বন্ধ না করলে হয় তারা তাদের দেশে ফেরত যাবে, না হয় অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের ভাসানচরে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া কাটলেই গুলি চালায়। এখানে তারের বেড়া কাটলে আমাদেরও কঠোর হতে হবে।’ কক্সবাজার অঞ্চল মাদকপ্রবণ এলাকা বলেই এখানে সংসদীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলেও মন্ত্রী জানান।

কমিটির সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘মাদকপাচারের বিভিন্ন রুটের মধ্যে কক্সবাজার রুটেই বেশিরভাগ মাদক প্রবেশের কথা জানা যায়।’ বর্তমানে মাদকপাচার কমে যাওয়ার পরিবর্তে এখন প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে পীর ফজলু বলেন, ‘২০২০ সালে একশ’র বেশি তালিকাভুক্ত মাদকপাচারকারী আত্মসমর্পণ করেছিল। যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তারা আবারও এই পাচার কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে যাচ্ছে।’ কক্সবাজার এলাকায় মাদকপাচার রোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বিশেষ ভাতার আওতায় আনার কথাও বলেন এই সদস্য।

বৈঠকে কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমদ জিরো পয়েন্টে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মাদক পাচারের বড় রুট হিসেবে এ পয়েন্টটি চিহ্নিত হয়ে আছে।

সর্বশেষ বৈঠকে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে ও মানবিক সেবায় নিয়োজিত সকল স্তরের পুলিশ, আনসার, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, ফায়ারসার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ঝুঁকি ভাতা প্রদানের সুপারিশ করা হয়।

কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমেদের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সামছুল আলম দুদু, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পীর ফজলুর রহমান, নূর মোহাম্মদ ও রুমানা আলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, মাদক, সরকার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন