দাবি পূরণ না হলে ফিরবেনা একটি রোহিঙ্গাও, প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত প্রশাসন

fec-image

কক্সবাজারের টেকনাফে চারটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ৩৫৪০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরাতে ইতিমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে বৃহষ্পতিবার ওই সব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা হবে বলে জানা গেছে। প্রশাসনও এমনটি জানিয়ে বলেন কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে প্রত্যাবাসন করা হবেনা।

রোহিঙ্গা নেতারাও জানান, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা এখনো পুরোপুরো অবগত নয়। এমন খবরে তারা হতাশ জানিয়ে বলেন, দাবি দাওয়া পূরণ না হলে কোনো রোহিঙ্গা ওপারে ফিরবেনা। রবি ও সোমবার টেকনাফ কেরণতলী প্রত্যাবাসন ঘাট ও নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা শিবির পরির্দশন এবং সেখানকার লোকজনের কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া প্রত্যাবাসন বিরোধী একটি চক্র ক্যাম্পগুলোতে দফায় দফায় গোপন মিটিং করছে বলে জানা গেছে। এ সব তথ্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কাছে রয়েছে।

এ সময় টেকনাফের সদর ইউনিয়নের কেরণতলী প্রত্যাবাসন ঘাটে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। এ সময় প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা একটি দল প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থান ও কক্ষ ঘুরে দেখেন।

সেখানে কথা হয় শ্রমিক ছৈয়দ নুর ও মোহাম্মদ কলিমের সঙ্গে। তারা বলেন, এখান থেকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে। ফলে ক্যাম্প ইনচার্জের নির্দেশে গত কয়েকদিন প্রত্যাবাসন ঘাটে নতুন করে পরিস্কার-পরিচ্ছনতা কাজ করছি। এছাড়া প্রতিদিন অফিসের লোকজন এসে তদারকি ও দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রত্যাবাসন ঘাটে দায়িত্বরত ১৬ আনসার ব্যাটালিয়নের হাবিলদার মোহাম্মদ আইনুল হক বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঘাটে কয়েকদিন ধরে কাজ চলছে। তাদেরকে আমরা সহযোগিতা করছি। শুনেছি কয়েকদিনের মধ্যে এই ঘাট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে। এর মধ্যে টেকনাফের প্রত্যাবাসন ঘাটে প্যারাবনের ভেতর দিয়ে লম্বা কাঠের জেটি, ৩৩ আধা সেমি-টিনের থাকার ঘর, চারটি শৌচাগার রয়েছে। সেখানে ১৬ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।

একইদিন নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২৬ সিআইসি কার্যালয়ের পাশে ছোট ছোট ঘর করতে দেখা গেছে। যারা সেচ্ছায় যাবে, তাদেরকে এ সব ঘরে রাখা হবে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ক্যাম্প ইনচার্জের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এসব লিফলেট বার্মিজ ভাষায় লিখা রয়েছে। লিফলেট সমূহে প্রত্যাবসনের পর এনভিসি কার্ডের মাধ্যমে ছয় মাস পরে নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের কথা বলা রয়েছে জানান রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা নেতা মোঃ জাকারিয়া জানান, সোমবার (১৯ আগস্ট) দুপুরের আগেই তিনটি বৈঠক করেছেন ইউএনএইচসিআর, সিআইসি ও অন্যান্য এনজিওদের সাথে। ওখানে প্রত্যাবাসনের বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। তবে কারা প্রত্যাবাসনের তালিকায় রয়েছেন জানাইনি। স্বেচ্ছায় যারা মিয়ানমারে যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রত্যাবাস করা হবে। জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না বলে কর্মকর্তারা আশ্বস্থ করেছেন।

ক্যাম্প ২৭ এর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন বশর বলেন, নিজ জন্মভূমিতে ফেরত যাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। হঠাৎ করে বলা নেই, বার্তা নেই প্রত্যাবাসনের বার্তা পেয়ে আমরা হতাশ ও ক্ষুদ্ধ। একই ক্যাম্পের ব্লক এ’র মাঝি মোঃ নুর বলেন, সিআইসি ক্যাম্পের আশেপাশে কিছু ঘর তৈরী করা হয়েছে। যারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে তাদেরকে এ ঘরে রাখা হবে। সেখান থেকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। মিয়ানমার সরকার ওখানেও ক্যাম্পে রেখে তদন্ত সাপেক্ষে কোথায় রাখবে সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্ত এ সব সিদ্ধান্ত এখনো কেউ জানেনা। কিন্তু এতদিন ধরে আমরা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) কার্ডের বিপক্ষে ছিলাম। এখন প্রত্যাবসন কবরার সময় এনভিসি কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হবে। এটা রোহিঙ্গারা মেনে নেবেনা। এভাবে কোনো রোহিঙ্গা ফেরত যাবে বলে এই মাঝির মনে হয়না। এভাবে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে আমাদের মত থাকতে পারেনা।

নয়াপাড়া শালবাগান ক্যাম্পের (নং-২৬) রোহিঙ্গা হেড মাঝি বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমারের এক প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা শিবিরে পরিদর্শনে এসেছিলেন। তাদের সাথে আমাদের কথা হয়। আমরা ৪ টি শর্ত ছুড়ে দিয়ে ছিলাম। এ ছাড়া আমাদের সাথে ডায়ালগ করার কথা রয়েছে। এসব বিষয় সম্পন্ন না হতে রোহিঙ্গারা ফিরবেনা বলেও জানান তিনি।

একাধিক রোহিঙ্গা নেতা ও সাধারণ রোহিঙ্গারা জানান, তাদের পক্ষ থেকে পুনরায় তাদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এরমধ্যে নাগরিকত্ব প্রদান, নিজ ভিটে জমি ফিরিয়ে দেওয়া, মিয়ানমারে আটককৃতদের মুক্তি, হত্যা, গণধর্ষন ও বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগের বিচারের দাবি রয়েছে। এ সব দাবী পুরণ হলে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরবে রোহিঙ্গারা।

দেশ বিদেশ থেকে প্রত্যাবসন বিরোধী একটি চক্র (কতিপয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও সরকারি বিরোধী পক্ষ) ভয়েস কল ও অনলাইন রেডিওর মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচচালনা করছে বলে জানা গেছে। এমনি একটি অডিও বার্তা এক এনজিওর কর্মকর্তার কাছে রয়েছে। সেখানে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের পত্যাবাসন বিরোধী নানা কথা বলতে শুনা গেছে।

টেকনাফ নয়াপাড়া শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প (নং- ২৬) এর ইনচার্জ মোঃ খালিদ হোসেন জানান, প্রত্যাবাসনে জন্য ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের তালিকা হাতে পেয়েছি। পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবে প্রায় প্রস্তুতের কথাও জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে বার্তা পৌঁছানো হয়েছে। যাদের কাছে বার্তা পৌঁছেনি তাদেরকে মঙ্গলবারের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। এজন্য এনজিও কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা মাঝিদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রত্যাবাসনের বিষয়সহ ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোাচনা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো জানান, কোন রোহিঙ্গাকে জোর পূর্বক প্রত্যাবাসন করা হবে না। ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রবিউল হাসান জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য স্ব স্ব ক্যাম্পের ইনচার্জ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যাবাসনের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে এবং প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এদেশে আসার পর থেকেই তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিতে বিভিন্নভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গঠিত দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সিদ্বান্ত মতে, ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩০টি পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই দেশই প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের মুখে সে সময় প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।

এরপর থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়। সবশেষ ২২ আগস্ট সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু বিভিন্ন দাবি-দাওয়া এখনো পূরণ না হওয়ায় বিরোধী অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গারা। ফলে প্রত্যাবাসন আদৌ শুরু করা যাবে কিনা, তা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের দায়িত্বরত অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারি।

রোহিঙ্গারা এদেশে আসার পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা হলেও এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
আরআরআরসি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ‘দুই দফায় ২২ হাজার ৪৩২ ও ২৫ হাজার সাত জনের তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদের মধ্য থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জনের বিষয়ে মিয়ানমার ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা ক্যাম্প
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন