দীর্ঘ ২১ বছর পর দখলমুক্ত রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার : চাবি এখন বোমাং রাজার হাতে

অবশেষে দীর্ঘ ২১ বছর পর শতবছরের এতিহ্য রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার (খিয়ংওয়াক্যং) পরিচালনার দায়িত্বভার পেলেন বোমাং সার্কেলের রাজা। এতদিন অবৈধভাবে বিহারটি পরিচালনা করতেন থোয়াইচপ্রু মাস্টার-বাচমং গংরা। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারে চাবি হস্তান্তর করার মধ্যে দিয়ে শতবছরের প্রথাগত ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেয়া হলো বোমাং সার্কেলের রাজাকে।

এবিষয়টিকে বৌদ্ধ ভিক্ষু, নেতৃবৃন্দসহ সচেতন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা স্বাগত জানালেও হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে উপঞ্ঞা জোত মহাথের উচহ্লা ভান্তের কতিপয় শিষ্য ও অনুসারীরা। 

১৬ই মে বান্দরবান বোমাং সার্কেলের ১৭ মত রাজা বোমাংগ্রী উ. উ চ প্রু চৌধুরীর হাতে অনুষ্ঠানিকভাবে রাজগুরু বিহারের চাবি ও মূল্যবান পরিসম্পদের দায়িত্বভার হস্তান্তর করেছে পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা।

এসময় উপস্থিত ছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কেএসমং মারমা, প্রয়াত ১৪তম রাজা মং শৈ প্রু চৌধুরীর ছেলে রাজকুমার মং ঙৈ প্রু চৌধুরী ও রাজকুমার ও হেডম্যান নু মং প্রু চৌধুরী, রাজ পরিবারের অন্যতম সদস্য হেডম্যান সাশৈ প্রু চৌঃ পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের নেতৃবৃন্দ, জেলা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রতিনিধিরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পার্বত্য শান্তিচুক্তির আলোকে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনে উল্লেখ্য রয়েছে, জেলায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ কোন সংস্থা নিয়ে সাংঘর্ষিকপূর্ণ বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে তার নিরসনে ওই পরিষদগুলো কর্তৃক সমন্বয় সাধণের উদ্যোগ নিতে পারে। উপঞ্ঞা জোত মহাথের উচহ্লা ভান্তে প্রয়ানেরপর শবদেহ ফিরিয়ে এনে যথাযথ মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করা এবং রাজগুরু বিহার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ এই উদ্যোগটি নিয়েছে বলে সূত্রগুলো জানায়।

বৈঠকে রাজগুরু বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি থোয়াইংচপ্রু মাস্টার ১৪ ও ১৯এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে জেলা পরিষদকে বিহারে যাবতীয় সম্পদের তালিকা অবহিত করতে গিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে ৩টি অতিপুরানো গুণসম্পন্ন বুদ্ধমুর্তির মধ্যে ১টি রাজগুরু বিহারে সংরক্ষিত ছিল। তার জানামতে যুগ পরম্পরায় দানকৃত গুণসম্পন্ন বুদ্ধমূর্তি, স্বর্ণ, রৌপ্য অলংকারাদি বিহারে থাকার কথা। তিনি (থোয়াইংচপ্রু মাস্টার) সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষিত রয়েছে কিনা জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন ও ক্যাং কমিটির প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বৈঠকে প্রস্তাব দেন।

এব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কেএসমং মারমা জানান, ঐতিহ্যবাহী গুনসম্পন্ন বুদ্ধমূর্তি সিলগালা ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের দিয়ে পরীক্ষা করা বিষয়টি সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং প্রথাগত রিতী-নীতির নিয়মানুসারে রাজগুরু বিহারের চাবি বোমাং রাজার হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এব্যাপারে পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলেন, উপঞ্ঞা জোত মহাথের(উচহ্লা ভান্তে) প্রয়ানের পর পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, বৌদ্ধ সমাজের প্রতিনিধি ও ভিক্ষুসংঘের প্রতিনিধিদের সাথে একাধিকবার বৈঠকের পর সকলের অনুরোধক্রমে শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াত বৌদ্ধ ধর্মীয়গুরু উপঞ্ঞা জোত মহাথের (উচহ্লাভান্তের) শবদেহ খৈয়াখালি থেকে বান্দরবানে ফিরে এনে যথাযথ মর্যাদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা উদ্যোগ নিয়েছে জেলা পরিষদ। এছাড়াও চুরি যাওয়ার আশঙ্কায় সকলের মতামতের ভিত্তিতে রাজগুরু বিহারের স্থাবর-অস্থাবর এর তালিকা তৈরি ও হাজার বছরের পুরোনো বুদ্ধমূর্তিটি সিলগালা ও বয়সকাল নির্ধারণের জন্য প্রত্নতত্ত্ববিদদের দিয়ে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং বিহারের চাবি বোমাং রাজার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এবিষয়ে যমুনা টেলিভিশনের বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি বাটিং মারমা জানান, যে সিদ্ধান্তগুলো জেলা পরিষদ নিয়েছে, এটি একটি সময়গোযোগী সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। জেলা পরিষদের এই সিদ্ধান্তেকে আমরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা খুশি ও স্বাগত জানায়।

এদিকে বুদ্ধমূতিটি চুরি যাওয়ার আশঙ্কায় সিলগালা ও রাজগুরু বিহারে চাবি বোমাং রাজার হাতে হস্তান্তর করার বিষয়টি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা স্বাগত জানালেও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ভান্তের কতিপয় শিষ্য ও অনুসারীরা। তারা এঘটনায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে গণমাধ্যম ও ফেইসবুকে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি প্রদানসহ ষড়যন্ত্র মূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপাসক, বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা ও রাজ পরিবারের সদস্যরা জানান, বর্তমানে রাজগুরু বিহারে সংরক্ষিত থাকা বুদ্ধমূর্তি আসল প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী গুনসম্পন্ন বুদ্ধমূর্তিটি কিনা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। উপঞ্ঞা জোত মহাথের উচহ্লা ভান্তে রাজগুরু বিহারের বিহারাধ্যক্ষ দায়িত্ব নেয়ার ৪/৫বছর পরে উধাও হয়ে গেছে বলে সকলের মধ্যে এই সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এদিকে বোমাং রাজ পরিবারের একাধিক সদস্যের সাথে আলাপ করে জানা যায়, খিয়ংওয়াক্যং (রাজগুরু বিহার)টি প্রায়াত বোমাং রাজা ক্য জাইন প্রু প্রায় ২৪০বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

প্রথাগত আইনে বলা আছে স্ব-স্ব গ্রামে বিহারের বিহারাধক্ষ নিয়োগ করবে ওই গ্রাম বা পাড়ার প্রধান( কারবারি)।বান্দরবানের রাজগুরু বিহারেও বোমাং রাজাই রাজবিহারে বিহারাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা নিয়ম রয়েছে। আরও বলা আছে বিহারাধ্যক্ষ নিয়োগের ঘোষণাপত্রে রাজ পরিবারে ৯জন নবীন সদস্যের স্বাক্ষর অবশ্যই থাকার নিয়ম রয়েছে। কোন ক্রমেই জনপ্রতিনিধি বা নেতা বিহারে বিহারাধক্ষ নিয়োগ দিতে পারেনা। কিন্তু সে প্রথাগত আইন ভেঙ্গে প্রয়াত ১৯৯৯ সালের ১৩ই জানুয়ারি উপঞ্ঞা জোত( উচহ্লা ভান্তে) নিজস্ব শিষ্য-ভক্তদের নিয়ে জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান থোয়াইংচপ্রু মাস্টার-বাচমং গংদের সহযোগিতায় সন্ত্রাসী কায়দায় রাজগুরু বিহার থেকে বিহারাধ্যক্ষ উঃ আগাদামা ভান্তেকে অপসারণ করেন এবং জোর জবরদস্তি করে উচহ্লা ভান্তে নিজেই রাজগুরু বিহারের বিহারাধ্যক্ষের আসনে বসেছিল। মুলত তখন থেকেই রাজ পরিবার এবং মারমা সমাজের মাঝে দিধাদ্বন্দ্ব ও ফাটলের সৃষ্টি হয়।

প্রত্ততত্ত্ববিদদের দিয়ে পরীক্ষা করা হলে আসলে সত্য বের হয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কায় আতঙ্ক-উৎকন্ঠায় রয়েছে ভান্তে শিষ্য ও অনুসারীরা। তাই তারা জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ ও নেতৃবৃন্দের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে নানান অপপ্রচারের লিপ্ত রয়েছে।

এদিকে বিষয়গুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের বৌদ্ধধর্মীয় ওয়েব পেজ পঞ্ঞা-প্রজ্ঞায় উচহ্লা ভান্তের কথিত এক শিষ্য ক্ষোভ প্রকাশ করে ও হুমকি দিয়ে করা মন্তব্যে বলেন, ষড়যন্ত্রকারীদের সাবধান করছি গুরুভান্তের প্রতিটি শিষ্য-শিষ্যারা হচ্ছে একেকটি পিলার। গুরুভান্তে নেই বলে তার শিষ্যদের দূর্বল ভাববেন না। অনেক মৈত্রী দিয়েছি, অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। সামনে আর মৈত্রী হবে না।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন