নৃ-গোষ্ঠিদের নিজস্ব ভাষায় প্রা: শিক্ষা কার্যক্রম শুরু

rangamati-pic-01-01-16-04-copy

নিজস্ব প্রতিনিধি:

অবশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে নৃ-গোষ্ঠিদের নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি। কর্মর্সূচির অংশ হিসেবে রবিবার বই উৎসবের দিন রাঙামাটির ৫০ টিপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চারটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের নিজস্ব ভাষার বই বিতরণ করা হয়েছে। নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। ক্ষুদে শিক্ষার্থীরাও নিজস্ব ভাষার লিখিত হরফের বই হাতে পেয়ে কৌতুহলি হয়ে উঠেছেন। তবে অভিজ্ঞ মহল এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও পর্যাপ্ত শিক্ষক, প্রশিক্ষণ ও গভেষণা না থাকায় এ উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১ ভাষাভাষি ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। এসব জনগোষ্ঠীদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তিতেও পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া রোধ ও জনগোষ্ঠীদের শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নিতে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা পদ্ধতি চালুর কথা রয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিশুদের মাতৃভাষায় পড়ালেখা করার সুযোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সে পরিকল্পনা দীর্ঘ দিন আলোর মুখ দেখেনি।

অবশেষে ইংরেজী নতুন বছর ২০১৭ সালে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিশুদের হাতে নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার বই তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হলো নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, এ কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ে রাঙামাটি ১০ উপজেলায় নতুন পাঠ্য বইয়ের সাথে ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও সাত্রী জনগোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের মাঝে ১২ হাজার ৩৮১টি বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চাকমা ভাষায় ১০৮২টি, মারমা ভাষায় ২১৬৫টি, ত্রিপুরা ভাষায় ২৫৮৩টি ও সাত্রী ভাষায় ৩৮১টি বই বিতরণ করা হয়।

এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৃ-গোষ্ঠিদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্য বই দেয়া হলেও এসব ভাষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক পর্যাপ্ত পরিমানে নেই। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষক থাকলেও তারা নিজেদের ভাষা মুখে বলতে পারলেও লিখিত হরফের সাথে পরিচিত নন। এ ছাড়াও নিজস্ব ভাষায় পাঠদানের উপরও তাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। এ অবস্থায় নিজস্ব ভাষায় পাঠদানে প্রথমে শিক্ষকরা হিমশিম খাবেন বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।

বনরূপা মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অর্চনা চাকমা জানান, তার স্কুলে চাকমা ও মারমা ভাষার শিক্ষক আছেন কিন্তু ত্রিপুরা ভাষার কোন শিক্ষক নেই। এ ছাড়া যে দুই সম্প্রদায়ের শিক্ষক আছেন তারা নিজেদের ভাষার হরফ সম্পর্কে ভালোভাবে পরিচিত নন। রানী দয়াময়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজিয়া বেগম বলেন, নৃ-গোষ্ঠিদের নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হলে আগে পর্যাপ্ত পরিমানে প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও এসব ভাষা এবং শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। অন্যথায় নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তরের পরে গিয়ে মূল ধারার শিক্ষা পদ্ধতির সাথে সমন্বয় রাখতে পারবে না বলেও তিনি মনে করেন। বিশ্লেষকদের মতে এখনো অধিকাংশ নৃ-গোষ্ঠির নিজস্ব হরফ পাওয়া যায় নি। এ ছাড়াও কালের আবর্তে অনেক নৃ-গোষ্ঠির ভাষার বিকৃতি ঘটেছে এ অবস্থায় নৃ-গোষ্ঠির নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা চালু করতে হলে এ নিয়ে আরও বেশি গবেষণার প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা আশা ব্যক্ত করে বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে নৃ-গোষ্ঠিদের নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায় থেকে নৃ-গোষ্ঠিদের শিশুদের ঝরে পড়া রোধ হবে এবং শিশুরা শিক্ষার প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে উঠবেন। তিনি জানান, জেলা পরিষদের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ৫০ জন শিক্ষককে নৃ-গোষ্ঠি ভাষার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও শিক্ষককে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে।

সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় নৃ-গোষ্ঠিদের প্রচুর শিক্ষক রয়েছেন। তাদের অনেকে নিজেদের ভাষা লিখতে না পারলেও সকলেই তাদের ভাষা বলতে পারেন। এসব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযোগি করে তোলা হবে। তিনি বলেন, নিজস্ব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হলে অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার মান আরও বৃদ্ধি পাবে।

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন