পানছড়িতে এক সাধকের হঠাৎ আর্বিভাব

 

SADOK

শাহজাহান কবির সাজু, পানছড়ি প্রতিনিধি:

খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার ১নং লোগাং ইউপির প্রত্যন্ত মাচ্ছ্যাছড়া নামক গহীন অরণ্য এক সাধকের আর্বিভাব ঘটেছে। বিভিন্ন রোগ মুক্তির জন্য সাধকের একটু সান্নিধ্য পেতে জেলার দুরদুরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন ছুটে আসছে শত শত রোগী।

জানা যায়, আর্বিভুত সাধক মাচ্ছ্যাছড়া গ্রামের রবিনশ্বর চাকমার ছেলে কিরণ চন্দ্র চাকমা (৪৫)। পানছড়ি উপজেলা সদর হতে প্রায় বার কিলোমিটার পাকা রাস্তা পাড়ি দিয়েই পশ্চিমে প্রায় সাত কিলো কাঁচা রাস্তা যেতে হয়। সিএনজি, মাহিন্দ্র বা মোটর সাইকেল যোগে মাইল চারেক কোন মতে টিলা টংকর বেয়ে গেলেও বাকীটুকু পাঁয়ে চলা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। উঁচু নিঁচু পাহাড়ী খাড়া পথ বেয়ে সাধকের আস্তানায় পৌঁছা খুবই কষ্ট ও দুরহ ব্যাপার। খবর শুনে হাল না ছেড়ে মোটর সাইকেল আর পায়ে চলতে চলতে কোন মতে জান নিয়ে বেলা একটার দিকে এ প্রতিবেদক হাজির হন সাধকের আস্তানায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, শত শত দর্শনার্থী সাধকের দর্শনের অপেক্ষায়। সাধক কিরণ চন্দ্র চাকমা শতবর্ষী বয়রা গাছের নীচে হাতে মাইক নিয়ে ভক্তদের আর্শিবাদ দিচ্ছেন। আশ-পাশ ও চারিদিকে ভক্তদের আনাগোনা আর যেন সইছে না। সাধকের সামনে গিয়ে ভক্তরা মাথা নত করতেই আর্শিবাদ দিয়ে হাতে তুলে দিচ্ছেন কিছু আমলকি, লিচি আর কাউকে পানি ছোঁয়া। সাধক এসবকে মার্গ ফল হিসাবেই প্রচার করছেন।

ভক্তদের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, তারা উপকার পাচ্ছেন। এক অভিভাবক জানালেন, তার ছেলে আগে প্রচুর মদ পান করতো, জুয়া খেলতো কিন্তু ভগবানের আর্শিবাদে সাধকের কাছে আসার পর তারা এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। তাই পূনরায় আর্শিবাদ নিতে এসেছেন।

জেলার লক্ষীছড়ি উপজেলার বেলাক্কাপাড়া থেকে লক্ষন চাকমা- ছেলে সত্যবান চাকমা (৩৪), খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পাকুজ্যাছড়ি গ্রামের বিপুল বিকাশ চাকমার ছেলে- রিপন চাকমা (২২), খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পেরাছড়া স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী- এসমিতা চাকমা, শিলাছড়ি আইলমারা এলাকার কৃষ্ণলাল চাকমার স্ত্রী- দুমা রানী চাকমা (৪০) তারা সবাই সাধকের আর্শিবাদ নিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্তিময় শরীরে আর্শিবাদের অপেক্ষায়। এদের কেউ মাদক ও জুয়ায় আসক্ত, কেউ কোমর ব্যাথায় ভুগছেন- তাদের দৃঢ় বিশ্বাস সাধকের আর্শিবাদ তারা পেলেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন।

সাধকের ভাতিজা জটিল কান্তি চাকমার সাথে আলাপ কালে জানা যায়, দীর্ঘ আট বছর ধরে ধ্যান সাধনার পর আজ তিনি বড় সাধক। প্রতিদিন হাজারো পূণ্যার্থীর সমাগম ঘটে এই গহীন অরণ্যে। তাই তিনটি পূর্ণার্থি ঘর তৈরী করা হয়েছে আরো দুই/তিনটি ঘর তৈরীর পরিকল্পনা চলছে। বিনা খরচে পূর্ণ্যার্থীরা এসব ঘরে থাকে এবং খাওয়া দাওয়া করে বলে জানা যায়। প্রভা বিন্দু চাকমা ও মিন্টু চাকমা সার্বক্ষনিক নিয়োজিত রয়েছেন রান্নার কাজে। এদিকে সাধকের সাধনার সুবিধার্থে এলাকার স্নেহ কুমার চাকমার ছেলে সোনামনি চাকমা প্রায় তিন একর জায়গা দান করেছেন বলে জানান জটিল কান্তি চাকমা।

এদিকে পূণ্যার্থীদের দেয়া দানীয় সামগ্রীতে ভরপুর হয়েছে তিন-তিনটি রুম। এর মধ্যে প্রায় শত বান টিন, জেনারেটর, সোলার, মাইক, এমপ্লিফায়ার, চল্লিশ বস্তার মত চাউল, শীতল পাটি, টোপ পেরেক, হাঁড়ি-পাতিল, কোদাল, ডিজেল, বেলচা, বালতি, বড় বড় পানির ড্রাম, মোতবাতি, বিস্কিট ও পানীয় জল সহ বিভিন্ন জিনিস পত্রাদি। তাছাড়া প্রবেশ মুখেই রয়েছে শ্রদ্ধাদান আদায়ের জন্য একটি টং ঘর। সে ঘরে বসে তিন জন শ্রদ্ধা আদায় করছেন।

জানা যায়, সাধক কিরন চন্দ্র চাকমার সাধক হিসাবে আর্বিভাব ঘটে মাস খানেক পূর্বে। এই অল্প সময়েই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে খাগড়াছড়ি জেলাসহ অন্যান্য জেলাগুলোতেও। তার স্ত্রী সবিকা চাকমা, ছেলে সুদত্ত চাকমা ও মেয়ে কামনা চাকমাকেও মাচ্চ্যাছড়া এলাকার গহীন অরণ্যে সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।

সাধক কিরণ চন্দ্র চাকমার সাথে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সরেজমিনে শতবর্ষী বয়রা গাছে একটি গর্তের মুখে বুদ্ধকে দেখতে পান বলে জানান। সেই গাছটির নিচে বসেই মাইকের সাহায্য তিনি ভক্তদের আর্শিবাদ দিয়ে থাকেন। তাছাড়া কিছুদুরে অবস্থিত দারমারা নামক একটি গাছের নিচে নিয়ে যান সেই গাছের গর্তেও বুদ্ধ রয়েছে বলে জানান। তিনি আরো জানান, দারমারা গাছটির নিচে তিন দিন সাধনা করে তিনি অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন যার জন্য তার সাধকের পথ সহজযোগ্য হয়।

সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ও বনের বিভিন্ন প্রাণীর ডাকে পুরো এলাকা যেন থমথমে। সেই সাথে পূণ্যার্থীদেরও যাবার পালা। বিদায় বেলা সাধক পথ দেখিয়ে আমাদের বার বার বলছেন, কোন সমস্যা নেই, পথে কোন বিপদ হবেনা, আমার এখানে আপনারা আসছেন তো, সুন্দরভাবে আপনারা ঘরে পৌঁছতে পারবেন। প্রায় দু’মাইল পাহাড়ী খাড়া পথ পায়ে হেঁটে. মোটর সাইকেলে পাঁচ কিলো কাঁচা উঁচু নিঁচু পাহাড় পাড়ি দিয়ে প্রধান সড়ক হয়ে বাড়ি ফিরে এসেই স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন প্রতিবেদক।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন