পানছড়ির উল্টাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠদান চলছে খোলা আকাশের নীচে
স্টাফ রিপোর্টার:
শ্রেণি কক্ষের অভাবে পানছড়ির উল্টাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে খোলা আকাশের নিচে চলছে পাঠদান। রোদ্র, বৃষ্টি আর শীতকে উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচেই ক্লাস করতে হচ্চে শিক্ষার্থীদের। উল্টাছড়ির বিশাল এলাকা জুড়ে পার্শবার্তী আর কোন মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানে পাড়াশুনা করছে। ফলাফলের দিক থেকে জেএসসিতে উপজেলা পর্যাযে প্রথম স্থান অধিকার করলেও এখনো বিদ্যালয়টির জীর্ণদশা এখনো কাটেটি।
সরেজমিনে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করছেন শিক্ষার্থীরা। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাঠদান করছেন শিক্ষক শিখা প্রভা বনিক।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭–১৯৯৮ দশকে উল্টাছড়ি, মধ্যনগর, আলী নগর, জিয়ানগর, মুসলিমনগর, উমরপুর, রসুলপুর, পাইয়ং পাড়া ও মরাটিলাসহ বিশালাকার এলাকা জুড়ে ছিলনা কোন নিম্ন বা উচ্চ মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়। যার ফলে এসব এলাকায় শিক্ষার হার ছিল শূণ্যের কোটায়। তাছাড়া উল্টাছড়ি বর্তমানে ইউনিয়ন হলেও তখনকার আমলে ছিল ৪নং লতিবান ইউনিয়নের একাংশ।
তখনকার সময় পাহাড়ী–বাঙ্গালীর সহবস্থানের এই এলাকায় একটি বিদ্যালয় গড়ে তোলার এক মহতী উদ্যেগ নেন ৩নং সদর পানছড়ি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ডা. মো. হাবিবুর রহমান। তিনি উপজেলা পরিষদের সন্নিকটে অবস্থিত কলোনীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার এই উদ্যেগকে স্বাগত জানিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে প্রয়াত ৪নং লতিবান ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মালেক।
অবশেষে ১৯৯৯ সালে উল্টাছড়ি কুটির শিল্প কারখানার জরাজীর্ণ একটি ঘরে চালু করা হয় উল্টাছড়ি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয় মো. রফিকুল ইসলাম বাবুলকে। ৬০/৬৫জন শিক্ষার্থী নিয়েই শুরু হয় নিয়মিত পাঠদান ও বিদ্যালয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রধান শিক্ষকের এক শিক্ষা সংগ্রাম।
অনেক চড়াই–উৎরাই পার করে দীর্ঘ বছর বিনা বেতনে শ্রম দিয়ে শিক্ষকরা এই বিদ্যালয়টিকে গড়ে তোলে স্বনামধন্য বিদ্যালয়রুপে। অবশেষে ২০১০ সালের ৩১ মে বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হয় ও ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারিতে অনুমতি পায় মাধ্যমিক পাঠদানের। এবারই প্রথম বারের মত নিজ বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা দিবে এসএসসি পরীক্ষা।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী জয়ন্তী ত্রিপুরা, ককরতি ত্রিপুরা, অনজিত ত্রিপুরা, মো. সোহাগ, রাসেল, শাহনাজ, ঝর্ণাদের সাথে আলাপকালে তারা আক্ষেপ করে বলেন, বছরের বেশির ভাগ সময়েই খোলা আকাশের নীচে ক্লাশ করেছি। আমাদের স্যারেরা আন্তরিক ছিল বলেই আমাদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে পেরেছে। না হয় শীত–বর্ষা মৌসুমে কেউ কি খোলা আকাশের নিচে পাঠদান নেয়? ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া কাইয়ুম হোসেন, রিতা ত্রিপুরা, ৭ম শ্রেণির জান্নাতুল ফেরদৌস, ৮ম শ্রেণির রিফাত জাহান, নবম শ্রেণির বিমল কান্তি ত্রিপুরা ও দশম শ্রেণির রিনা আক্তার, রতন ত্রিপুরারা জানায়, শ্রেণিকক্ষের অভাবে আমরা গাঁদাগাদি করে বসেই ক্লাশ করি। তাছাড়া পরিমাণমত টেবিলও নেই তাই এক টেবিলে কমপক্ষে ৬জন বসি। শিক্ষাথীদের প্রশ্ন আমরা কেন এত অবহেলিত? তাদের দাবি এই বিদ্যালয়ের জন্য একটি নতুন ভবন ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র দেয়া হোক।
কথা হয় প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বাবুলের সাথে, তিনি জানান বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন শতাধিক। বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ৫টি। শ্রেণিকক্ষ সংকুলানের অভাবে এসএসসির বিশেষ ক্লাশ, ধর্ম বিষয়ক ও বিভাগ ভিত্তিক বিষয়ের পাঠদান খোলা মাঠেই দিতে হয়। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষের উঁচু ও নিচু টেবিলগুলো মরাটিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে হাওলাত করে আনা। যখন চাইবে তখন ফেরত দিতে হবে। খোলা আকাশের নীচে পড়ে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত তিন বছরের জেএসসি ফলাফলে উপজেলায় প্রথম ও ২য় স্থানও অধিকার করেছে বলে উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়।
প্রধান শিক্ষক আরো জানান, বিদ্যালয়ের ভবনের জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক আবেদন করেছি। কিন্তু এখনো কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ২৯৮ নং আসনের সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা কিছুদিন আগে বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে বিদ্যালয়ের বেহাল দশা দেখে আগামী জুনের মধ্যেই একটি ভবন নির্মাণ করে দেয়ার আশ্বাস প্রদান করেন।
এ ব্যাপারে পানছড়ি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. শাহজাহান মিয়া জানান, বিদ্যালয়টি আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। এ বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ও আসবাবপত্রের অভাব রয়েছে। যা খুবই প্রয়োজন।
পানছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, ফলাফলের দিক দিয়ে বিদ্যালয়টি অনেক এগিয়ে। বিদ্যালয়ের ভবনের ব্যাপারে একটি রেজুলেশন হয়েছে এবং আপাতত একটি টিন সেট ঘর নির্মাণের চিন্তা ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
পানছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা জানান, উল্টাছড়ি বিদ্যালয়ের জন্য ১টি টিন সেট ঘর এবং কিছু বেঞ্চ দেয়ার ব্যাপারে কার্যক্রম চলছে।
উল্লেখ্য, বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৯জন শিক্ষক ও ২জন কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। এদের মাঝে ৫ শিক্ষক ও ২ কর্মচারী এমপিওভুক্ত। খন্ডকালীন শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের সামান্য আয়ের টাকা দিয়েই সামান্য সম্মানী ভাতা প্রদান করা হয়। ৫নং উল্টাছড়ি ইউপির বিশালাকার এলাকা জুড়ে মাত্র একটি বিদ্যালয়। কিন্তু এই বিদ্যালয়টির শ্রেণি কক্ষ ও আসবাবপত্রের বেহাল দশা দেখে অনেক শিক্ষার্থীই আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই জরুরী ভিত্তিতে একটি নতুন ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সু–দৃষ্টি কামনা করছেন এলাকাবাসী ও অভিভাবক মহল।