তিন দেশের সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করে চলছে প্রশিক্ষণ

পার্বতাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র গঠনে কুকিদের নীলনকশা

fec-image

‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ যার সংক্ষিপ্ত নাম- কেএনএফ। দেশের পার্বত্য অঞ্চলে হঠাৎ মাথাচাড়া দেওয়া সংগঠনটি এখন ভয়ংকররূপে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করার নীলনকশাও বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। শুরুর দিকে শান্তিপ্রিয় সংগঠন হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে বিষধর সাপের মতো ফণা তুলতে শুরু করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আঞ্চলিক এ সংগঠন। ইতোমধ্যেই কেএনএফ বানিয়েছে নিজস্ব পতাকা। তৈরি করেছে মনগড়া মানচিত্র। আর এসব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথা আলাদা রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়েছে প্রশিক্ষিত নিজস্ব ‘বাহিনী’। যাদেরকে দেওয়া হয়েছে সামরিক বাহিনীর আদলে কমান্ডো প্রশিক্ষণ। সময়ের আলো প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে!

কেএনএফের সাংগঠনিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তথ্যচিত্র বিশ্লেষণ, পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেখানে অনেক আগে থেকেই অন্তত চারটি আঞ্চলিক সংগঠন পাহাড়ি জনপদকে নানাভাবে অশান্ত রাখায় ব্যস্ত, সেখানে নতুন করে কেএনএফের ভূখণ্ড আলাদা করার অপতৎপরতা আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বিচ্ছিন্নতাবাদী এ সংগঠন কথিত নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদেরও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লা, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া অন্তত ৩৮ জঙ্গি বর্তমানে এই কেএনএফের অধীনে দুর্গম পাহাড়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এ প্রেক্ষাপটে বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম ও অনেক উঁচু একটি পাহাড় ঘিরে অভিযান অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী ও র‌্যাব। যেখানে অনেকসংখ্যক সেনাসদস্য অংশ নিয়েছে বলেও জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল আবু হায়দার মোহাম্মদ রাসেলুজ্জামান বলেন, ‘পাবর্ত্য অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পাহাড়ের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর।’

কেএনএফ কি?
কেএনএফ মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানকেন্দ্রিক আঞ্চলিক নতুন সংগঠন। যার পূর্ণাঙ্গ নাম- ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’। তথ্য-উপাত্ত ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেএনএফ পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক আয়তনের অঞ্চল তথা লামা, রুমা, আলীকদম, থানচি, রোয়াংছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাইছড়ি, বরকলসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে। যে মানচিত্রের তিন দিকে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত। কেএনএফ থেকে প্রকাশ পাওয়া একটি ছবিতে দেখা যায়, এই মানচিত্রকে তারা প্রস্তাবিত হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সীমানা, জেলা ও উপজেলা সীমানা নির্ধারণ করেছে। পাহাড়ের বম, পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং নামক ক্ষুদ্র ছয়টি জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। বর্তমানে কেএনএফ প্রধান হলেন নাথান বম।

এ প্রসঙ্গে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘শুধু কেএনএফ নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন আছে তারা সবাই এই ভূখণ্ডকে আলাদা রাষ্ট্র তথা জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। এরা দেশের শত্রু। স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের জন্য বরাবরই হুমকি। এগুলোর পেছনে মূলত দায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) প্রধান সন্তু লারমা। তিনি শান্তিচুক্তি করলেও প্রধান দুটি শর্তই মানেননি। অস্ত্র জমা না দিলে তো শান্তিচুক্তি আর বাস্তবায়ন হয় না। তার কারণেই বিভিন্ন গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গ্রুপ এখন দেশ রক্ষা বাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। এগুলো কঠোরভাবে দমন করা না হলে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।’

যেভাবে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে কেএনএফ:
কেএনএফের কর্মকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ ও তথ্যচিত্র থেকে দেখা যায়, এক মিনিটের একটি ফুটেজে শতাধিক উপজাতি নারী-পুরুষ, যারা শৃঙ্খল বাহিনীর মতো দাঁড়িয়ে সমস্বরে ইংরেজিতে বলছিলেন, ‘নো ফুল স্টেট, নো রেস্ট’ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র ব্যতীত অবসর নয়। সেখানে প্রত্যেকেই সেনাবাহিনীর মতোই ‘কম্ব্যাট’ পোশাক পরিহিত ছিলেন। ফুটেজ দেখলে বোঝা যায়, দুর্গম কোনো পাহাড়ে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের সময় এই ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। আরও জানা যায়, সবুজ ঢেউয়ের ওপরে নীল আবহের মাঝখানে সাদা একটি তারকাসংবলিত একটি পতাকা তৈরি করেছে তারা। যেটি তাদের সেই প্রশিক্ষণকেন্দ্র বা আস্তানায় টানিয়ে রাখা হয়েছে। সংগঠনের নামে তারা একটি লোগো বানিয়েছে। যেখানে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ আছে ২০০৮ সাল।

বান্দরবানের স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, নাথান বম ২০১৮ সালে বান্দরবান থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রথম দিকে কেএনএফ নিজেদের জাতিগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করে। কেএনএফ যে ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত তারা চাকমা, মারমাসহ অন্যদের তুলনায় অনেকটা অবহেলিত হিসেবে পরিচিত। কিছুটা শান্তিপ্রিয় হিসেবেও ধরা হয়েছিল। তারা পার্বত্য অন্যান্য আঞ্চলিক সংগঠনের বিরুদ্ধেও কাজ করছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা মূলত গোপন মিশন সামনে আনতে থাকে। এখন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রকেই আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করার স্বপ্ন দেখছে কেএনএফ। পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পরিবেশের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ নানাভাবে নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্র, সরকার বা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের প্রপাগান্ডা চালাতে শক্তিশালী গ্রুপ গড়ে তোলা হয়েছে। বেশ কিছু পাহাড়ি অনলাইন সাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তারা এসব কাজে ব্যবহার করছে। এমনকি তারা নিজেদের সক্ষমতা ও শক্তি জানান দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞ-বিশ্লেষকরা যা বলছেন:
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ‘কেএনএফ পাহাড়ে নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি করছে। যেহেতু বাংলাদেশের সীমানায় পার্শ্ববর্তী দুটি দেশের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় কেএনএফ তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে, তাই তাদের সঙ্গে কোনো বহিঃশক্তির সমর্থন বা কোনো ধরনের যোগাযোগ আছে কি না, এগুলো খতিয়ে দেখার দরকার। আমাদের সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতাও বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি এগুলো গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ করে গবেষণার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আরও অন্য কোনো সংগঠন এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে কি না, সেগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগেও দেখেছি, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিবাহিনী বা বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন তৎপরতা চালিয়েছে বা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকার তথা সামরিক বাহিনীকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পাহাড়ের শান্তিশৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রয়োজনীয় নানা ধরনের আগাম পদক্ষেপ রাখতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। তবে প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংগঠনের ভিত্তি এবং সদস্যসংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাথমিকভাবে যেটি দেখা যাচ্ছে- সদস্যসংখ্যার বিবেচনায় কেএনএফ তেমন বড় বা শক্তিশালী কোনো সংগঠন নয়। এ মুহূর্তে তাদের সদস্য সংখ্যা কম। তবে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে সেটি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্থানীয় জনগণকে আনুগত্যে বাধ্য করতে পারে। তবে আপাতত সামগ্রিকভাবে এটা তাদের অপচেষ্টা।’ তিনি বলেন, ‘কেএনএফ মিয়ানমার থেকে এখন কিছুটা সমর্থন তারা পেতে পারে। সেটা সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়েও হতে পারে। তারা যেহেতু সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে তাই আমাদের সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। যাতে বাংলাদেশের মাটিতে তারা শক্ত ঘাঁটি গড়তে না পারে।’

দুর্গম পাহাড় ঘিরে চলছে অভিযান:
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম একটি এলাকায় সুউচ্চ পাহাড়কে কেএনএফ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করে এলাকাটি ঘিরে সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের সম্মিলিত অভিযান চালানো হচ্ছে। কয়েক হাজার ফুট উচ্চতার ওই পাহাড়টি এতটাই দুর্গম যে, পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছানো অনেকটাই কঠিন। ফলে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েও সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের সদস্যরা সেখানে বর্তমানে খুব কাছাকাছি অবস্থানে থেকে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘দেশের কয়েকটি জেলা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি আমরা জানতে পারি তারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাসা বা গৃহত্যাগ করেছে। যারা অধিকাংশই নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া”য় যুক্ত হয়েছে। ওই জঙ্গি সংগঠনে কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য তারা স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করে। আমরা এই সংগঠনের ১২ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি দেশব্যাপী ৫৫ জন এভাবেই নিরুদ্দেশ হয়েছে। যার মধ্যে ৩৮ জনের নাম-ঠিকানা নিশ্চিত হই। পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারি নিরুদ্দেশ হওয়া ৩৮ জনের অধিকাংশই পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর অবস্থান করছে। তারা সেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এই তথ্য পেয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিষয়টি অবগত করেছি। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য পাওয়ার পর সেনাবাহিনী ও র‌্যাব যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন