ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সবাই কি সমান কোটাসুবিধা পায়?

‘পার্বত্যাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে বাঙালিদের কোটা-সুবিধা অর্ধেক হওয়া উচিত’

fec-image

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, পাহাড়ের দুর্গম ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বসবাস করেও পার্বত্য বাঙালি জনগোষ্ঠী কোটা-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পার্বত্য বাঙালিরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। পার্বত্যাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে বাঙালিদের জন্য কোটা-সুবিধা অর্ধেক হওয়া উচিত। বাঙালিরা এখানে অবহেলিত, প্রান্তিক এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এজন্য পিছিয়ে পড়া ও রক্ষিত পাহাড়ি বাঙালিদেরও কোটার আওতায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোটার বেশির ভাগ সুবিধা একচেটিয়াভাবে চাকমা এবং কিছু ক্ষেত্রে মারমা ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা পাচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলের বাকি ১০-১১ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বঞ্চিত। ইত্তেফাকের প্রতিবেদক আবুল খায়েরের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

জানা যায়, দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীতে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ নৃ-গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে কোটা-সুবিধার বাইরে রয়েছে। সরকারি চাকরির কোটায় ৭১ শতাংশ সুবিধা পেয়ে আসছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তিনটি নৃ-গোষ্ঠী। এগুলো হলো চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা। বাকি অন্তত অর্ধশত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মাত্র ২৯ শতাংশ সুবিধা পায়। এছাড়া এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। গত ১০ বছরে (২০১১-২০২১) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোটার অধীনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যায় যে, চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রাধান্য রয়েছে। এখানে অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে বঞ্চনা ও আধিপত্য পরিলক্ষিত হয়।

গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ৫০টিরও বেশি সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত মোট ৩ হাজার ১০৮টি আসনের অর্ধেকেরও বেশি (৫৬ শতাংশ) শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ছাত্রদের দখলে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যায় চাকমারা বাংলাদেশের মোট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনসংখ্যার শতকরা ২৯ ভাগ। একইভাবে, মারমা সম্প্রদায় মোট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ এবং তারা কোটা সুবিধা পায় ১৪ শতাংশ, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ে জনসংখ্যা ৯ শতাংশ এবং কোটা-সুবিধা পায় ০৭ শতাংশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গড় শিক্ষার হার ৭২.৯ শতাংশ, কিন্তু প্রত্যন্ত পার্বত্য জনপদে চাকমাদের শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ। এই অগ্রগতি বঞ্চনা ও অনগ্রসরতার পরিচায়ক নয়। শিক্ষার কারণে পেশা ও কর্মক্ষেত্রে চাকমা জাতিগোষ্ঠীর সুস্পষ্ট আধিপত্য রয়েছে। অন্য দিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার হার মাত্র ৪৫ শতাংশ ও পার্বত্য বাঙালিদের ২৩ শতাংশ। এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এটা সুযোগের তারতম্য, ভারসাম্যহীনতা এবং নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বৈষম্যের প্রমাণ। এখানে চাকমা বাদে বাকি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জনসংখ্যা ৭১ শতাংশ। অথচ এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি ও সরকারি চাকরির কোটা-সুবিধা পাচ্ছে মাত্র ৪৪ শতাংশ।

পার্বত্যাঞ্চলের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা বলছে, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গৃহস্থালি স্তরের আয়, খাদ্য খরচ ইত্যাদির মতো বেশ কয়েকটি আর্থসামাজিক সূচকে চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজন সমতল ভূমিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন গণমাধ্যমকে বলেন, চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা দেশে কোটা পদ্ধতিতে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি ও সরকারি চাকরির সব সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। এটা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমতল ভূমিতে বসবাসকারীদের সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি ও সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা উচ্চ শিক্ষা সরকারি চাকরির কোটা-সুবিধার অভাবে নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছি।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য রেমলিয়ান পাংখোয়া বলেন, পাংখোয়া এখন দেশের বিলুপ্ত প্রায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। গত ৫০ বছরে পাংখোয়া সম্প্রদায়ের বিসিএস ক্যাডারে কোনো প্রতিনিধি নেই। তাহলে কি আমরা উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে আছি? উচ্চ শিক্ষায় বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো আমরা ভর্তির কোনো সুযোগ পাচ্ছি না। এ জন্য বিদ্যমান কোটাতে পাংখোয়াদের বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগরিক পরিষদ রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সভাপতি সাব্বির আহম্মদ এই বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার মাত্র ২৩ শতাংশ। পার্বত্য বাঙালিরা একেবারে পিছিয়ে আছে। পার্বত্য বাঙালিদের কোনো কোটা-সুবিধা নেই। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার ভর্তি ও সরকারি চাকরির সুবিধা পেয়েছে বলেই তারা আজ অনেক এগিয়ে গেছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন