পার্বত্য চট্টগ্রামে ওয়ার্ল্ডভিশনের দরজা বন্ধ হচ্ছে ১ অক্টোবর

worldvision

জমির উদ্দিন: 

টানা প্রায় চার দশকব্যাপী পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যক্রমের পাট চুকিয়ে ১ অক্টোবর মঙ্গলবার বিদায় নিচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ডভিশন ইন্টারন্যাশনাল।’ ওয়ার্ল্ডভিশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্যে এনজিও ব্যুরোর নির্দেশে সংস্থাটি পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর এ্যাসাইনমেন্ট অফিসার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গত ১৬ মে তারিখের পত্রে সরকারি এ সিদ্ধান্তের কথা ওয়ার্ল্ডভিশনকে জানানো হয়।

এনজিও ব্যুরোর একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এনজিও পরিচালনা সম্পর্কীত সাম্প্রতিক শর্ত অনুযায়ী কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা স্থানীয় পার্টনার এনজিও ছাড়া মাঠ পর্যায়ে সরাসরি কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না। অন্য সবসংস্থা এ শর্ত পূরণ করলেও ওয়ার্ল্ডভিশন কর্তৃপক্ষ পার্টনার এনজিওর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্মত না হওয়ায় সরকারকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিগত দিনে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করে আসছে ওয়ার্ল্ডভিশন। কিন্তু বছর তিনেক আগে ওয়ার্ল্ডভিশনসহ কয়েকটি এনজিও সংস্থার বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তকরণের অভিযোগ উঠে। বিভিন্ন সময় সরকারী তদন্তেও এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। যদিও ওয়ার্ল্ডভিশন এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

তবে এনজিও ব্যুরোর ১৬ মে তারিখের পত্রে ওয়ার্ল্ডভিশনের কাজ বন্ধ করে দেয়ার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ না করলেও পত্রে ধর্মান্তকরণ প্রসঙ্গটির ইঙ্গিত রয়েছে। সর্বশেষ অর্থ ছাড় সংক্রান্ত এই পত্রের ঘ ও ঙ শর্তে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ কোন সম্প্রদায়কে নির্বাচন পরিহার করা এবং ধর্মান্তরিতকরণ নিরুৎসাহিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।

এদিকে সরকারি নির্দেশে অফিস বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ওয়ার্ল্ডভিশন কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে তাদের বান্দরবান অফিসে রক্ষিত হাজার হাজার ফাইল পুড়িয়ে ধংস করেছে।
এদিকে ওয়ার্ল্ডভিশনের ঢাকাস্থ গণসংযোগ অফিস থেকে জানানো হয়, ওয়ার্ল্ডভিশন ইন্টারন্যাশনাল সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ৩০ সেপ্টেম্বরের আগেই বান্দরবানে চলমান কাজ-কর্ম গুটিয়ে নিচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গনসংযোগ শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে এনজিও কার্যক্রম পরিচালনার শর্ত পূরণের লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে পার্টনার খোঁজা হচ্ছে। পার্টনার এনজিও নিয়োগ দিতে পারলেই বান্দরবানে আবারো কাজ শুরু করা হবে।

প্রসঙ্গতঃ পার্বত্য জেলা বান্দরবানসহ দেশের ৩৪টি জেলায় ওয়ার্ল্ডভিশন কাজ করছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের আদিবাসী অধ্যূষিত এলাকা ছাড়াও ঢাকা, রংপুর, নারায়নগঞ্জ, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, যশোহর, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, ঝিনাইদহ, নড়াইল, ফরিদপুর, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা, মাদারিপুর, জয়পুর হাট ও সাতক্ষীরা রয়েছে।  

প্রতি বছর সংস্থাটি বেশ কয়েকটি খাতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া বর্তমানে ওয়ার্ল্ডভিশন ইন্টারন্যাশনাল-ইউএসএ’র মঞ্জুরীকৃত এক হাজার নয় শত সাত কোটি একান্ন লাখ চল্লিশ হাজার টাকায় ৫ বছর মেয়াদী ‘ওয়ার্ল্ডভিশন ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ চলমান রয়েছে। শুধুমাত্র এ প্রকল্পের আওতায় বার্ষিক ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।

বান্দরবানে উন্নযন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবান এরিয়া অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কক্সবাজার অঞ্চলের সিনিয়র এডিপি ম্যানেজার ত্রিমোথি উজ্জ্বল কান্তি সরকার জানান, এনজিও ব্যুরোর পত্রের আলোকেই তারা বান্দরবানে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছেন।

তিনি জানান, অন্যান্য চলমান প্রকল্প ছাড়াও বর্তমানে বান্দরবান অঞ্চলে ৮ হাজারেরও বেশি সরাসরি উপকারভোগী শিশু রয়েছে। এদের কল্যাণে প্রতি বছর কমপক্ষে ৪ লাখ ডলার ব্যয় করা হয়ে থাকে।

তিনি জানান, শিশু সহায়তা খাতের প্রকল্পটি ২০১৭ সাল পর্যন্ত চলমান রাখার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ায় অসমাপ্ত অবস্থায়ই কাজ গুটিয়ে নিতে হচ্ছে।

এদিকে নির্ভরযোগ্য একটি সুত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ার্ল্ডভিশন কর্তৃপক্ষ বান্দরবান এলাকায় ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে শুরু করে। দু’বছর আগে বান্দরবান এডিপি ম্যানেজার জিরকুম সাহুর চুক্তি নবায়ন না করে প্রধান কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তাকে বান্দরবান এরিয়া ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তার যোগদানের কয়েক মাসের মাথায় তাকে অন্য অঞ্চলে বদলী করে নেয়ার পর থেকে দীর্ঘ দিন যাবত পদটি শূণ্য রয়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজার অঞ্চলে সিনিয়র এডিপি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত ত্রিমোথি উজ্জ্বল কান্তি সরকারকে বান্দরবান অঞ্চলের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবার আগে বান্দরবানে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রকল্প পরিচালনার ছাড়পত্রের জন্যে ওয়াল্ডভিশন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে কোন আবেদন করেনি।

সাবেক এরিয়া ম্যানেজার জিরকুম সাহু জানান, ১৯৭৪-৭৫ সালে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি এলাকায় ছাত্র বোর্ডিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ডভিশন ইন্টারন্যাশনাল পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ শুরু করে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন