পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন দশকে ৩০ হাজার বাঙালী হত্যার একটিরও বিচার হয়নি

926vvvvvvvvvvvvvvvvvvv

আবু বকর ছিদ্দিক:

দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলা তথা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ও পরবর্তী দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে সংগঠিত গণহত্যা, গুম, অপহরণ ও হাজার হাজার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ঘটনার বিচার হয়নি। প্রায় দু’যুগে তত্কালীন শান্তিবাহিনীর নৃশংস বর্বর গণহত্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধশত জায়গায় কয়েক হাজার মানুষ হত্যা করা হয় ও হাজার হাজার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিশেষ করে ১৯৮৬ সালের পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়, মাটিরাঙ্গা, লোগাং, পাকুয়াখালি, নানিয়ারচর, লংগদু, কাউখালী, বরকল, ভূষণছড়া, পানছড়ি, দীঘিনালা এলাকায় এসব গণহত্যা হয়েছে। এসব গণহত্যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাঙালিসহ কয়েক হাজার মানুষ মারা যায় বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

মানবাধিকার কর্মীরা দাবি তুলেছেন, এই গণহত্যারও বিচার শুরু করা দরকার। এটা সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য। কেননা এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না। একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী হত্যার বিচার চলছে। এর পাশাপাশি পার্বত্য গণহত্যারও বিচার শুরু করা উচিত।

রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন গণহত্যার কথা স্বীকার করে জানান, দেশের অপরাপর জেলার মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এসব গণহত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর পার্বত্যবাসীর আশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে আর কোনো সংঘাত হবে না। অনুসন্ধানে দেখা গেল পার্বত্য চুক্তির পরও অনেক সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা, অপহরণ এবং হত্যাযজ্ঞ চলছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ও গণহত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি; বরং এসব হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।
পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের নেতা মো. মাসুদ জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রায় ৩০ হাজার বাঙালি হত্যা করা হয়েছে। এসবের একটিরও বিচার হয়নি।

sayedibnrahmat_1378706004_1-pakuakhali-00

উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালের ৩০ মে রাতে রাঙামাটির বরকল উপজেলার প্রত্যন্ত ভূষণছড়া গ্রামে ৪৩৭ জন নিরীহ বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে তত্কালীন জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী। এটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে বৃহত্ গণহত্যা।

১৯৮৬ সালে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় বেশি গণহত্যা সংঘটিত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালের পর খাগড়াছড়ি জেলায় উল্লেখযোগ্য হত্যা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮৬ সালের ২২ ডিসেম্বর রামগড়ে অগ্নিসংযোগ ও ব্রাশফায়ার করে ৩৩ জনকে হত্যা করে শতাধিক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর রামগড়ের হাজাছড়া এলাকায় একই নুরুজ্জামানসহ পরিবারের ৬ জনকে হত্যা করা হয়।

১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির লংগদু উপজেলার পাকুয়াখালীতে সংঘটিত হয় আরেক গণহত্যা। সেদিন শান্তিবাহিনী মিটিং করার মিথ্যা আশ্বাসে ডেকে নিয়ে ৩৫ জন নিরীহ বাঙালি কাঠুরেকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা দিয়ে কুপিয়ে এবং বেয়নেট ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল এসব অসহায় মানুষকে। প্রতিটি লাশই বিকৃত করে সেদিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তারা।

১৯৮৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর রামগড়ের বাল্টুরাম এলাকায় মালেক বিডিপির একই পরিবারের ৪ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ১৯৮৬ সালের ৩ অক্টোবর মাটিরাঙ্গার ওয়াচু মৌজার অভ্যা এলাকার ১৩ জনকে গুলি করলে ১২ জনই মারা যান।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার অভ্যা এলাকার বাসিন্দা মো. নৌমান জানান, শান্তিবাহিনী নৃশংসভাবে পরিবারের ১২ জনকে হত্যা করে। এ সময় আমার মা ফয়েজুন্নেছা (৬৫), ভাইঝি নাজমা আক্তার (৭), ভাগনি আলেয়া (৭), আমির হোসেন (৭০), শাহজানের বাবা মারা যান। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আবুল কাশেমের মেয়ে হাজেরা বেগমও মারা যান।

১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল মাটিরাঙ্গা উপজেলা বর্নাল ইউনিয়নের সওদাগর পাড়া দুই পরিবারের ১০ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়। নিহতরা হলেন আবুল কাসেম, আবুল বশর, আবুল কালাম, কানু মিয়া, কানু মিয়ার স্ত্রী দেলনাহার বেগম, জোহরা বেগম, পারভিন আক্তার, নুর বানু আক্তার, মকবুল আহমদ, আকলিমা আক্তার ও আয়শা আক্তার।
১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল মাটিরাঙ্গার ভগবানটিলা, তাইন্দং, তবলছড়ি বাজার ও আশপাশে অগ্নিসংযোগ ও ব্রাশফায়ার করে ৫৪ জনকে হত্যা করা হয়। একই দিনে পানছড়ি এলাকার ছনটিলা, খাগড়াছড়ি সদরের কুমিল্লাটিলা, মানিকছড়ির মলঙ্গীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় তত্কালীন শান্তিবাহিনীর নির্যাতনে কয়েকশ’ মানুষ নিহত হয় ও কয়েক হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে নৃশংস বর্বরতা চালায় তারা। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর বর্বর হামলায় সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাঙে সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত হামলায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ নিহত ও কয়েকশ’ ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

১৯৮০ সালে বান্দরবান জেলার বন্দুকছড়ি এলাকায় শান্তিবাহিনীর নৃশংস বর্বরতায় ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন মেজরসহ ২২ জন সৈনিককে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
এ প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক পিপি ও হিউম্যান রাইটসের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজুর মুর্শেদ ভূঁইয়া বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের একটিরও বিচার হয়নি। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া প্রয়োজন। অভিযুক্তদের বিরুদ্বে দু-একটি মামলা হলেও এগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর নয়, এটি সার্বজনীন বিষয়।

শান্তিচুক্তির পর গত ২০১০ সালের ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও ২২, ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির সহিংস ঘটনায় শতাধিক বাড়িঘর পুড়ে ছাই ও বেশ কয়েকজন নিহত হয়। ২০০১ সালের ২৫ জুন রামগড়ে পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতায় শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ২০০৩ সালে মহালছড়িতে কয়েকটি গ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগে বিপুল পরিমাণ সম্পদ নষ্ট হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত মোট ১১টি সংহিস ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে। পাহাড়ি-বাঙালি সশস্ত্র সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দু’সম্প্রদায়ের মানুষই। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন। পাহাড়ি ও বাঙালির ৯০০-এরও বেশি ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আহত ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। সর্বশেষ গত বছরের ১৭ এপ্রিল রামগড়ের পিলাকের ছনটিলা এলাকায় বাঙালিদের গুচ্ছগ্রামে অগ্নিসংযোগ করে ৩ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা।

এর আগে ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাটে নতুন করে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সহিংসতার জের ধরে পরদিন সেখানে বাঙালিদের সাতটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলার আশঙ্কায় ভাইভাইছড়া, এমএসপাড়া ও হাজাছড়া নামে তিনটি পাহাড়ি গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিলও অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা একই এলাকার গঙ্গারাম মুখের বাঘাইহাট নার্সারি এলাকায় সাতটি গ্রামে আগুন দিয়ে ১৩২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এতে ধ্বংস হয় বাঙালিদের ৭৯টি এবং পাহাড়িদের ৪৫টি ঘরবাড়ি। ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট মহালছড়িতে সংঘাতে নিহত হন দুই জন এবং আহত হন প্রায় ৫০ জন।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বাবু রুইথি কার্বারী জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির আগে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছে অনেকেরই। হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শান্তিচুক্তির পরও অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ২০০৩ সালে মহালছড়িতে সহিংসতায় ৪-৫টি গ্রামে সাত শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে যায়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল ভুয়াছড়া, ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর রাজভিলা, ২০০১ সালের ১৮ মে বোয়ালখালী ও মেরুং, ১৯৯৯ সালের ১৬ অক্টোবর বাবুছড়া, ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল বাঘাইহাটে সহিংসতা হয়েছে।
পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু করলেও একটি স্বাধীন দেশের হাজার হাজার মানুষ হত্যার বিচারের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সন্তু লারমার মতো যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে দেশের স্বাধীনতার ওপর কলঙ্ক লেপন করেছে, সরকার তাদের ক্ষমতা দিয়ে পতাকা দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। একটি স্বাধীন দেশের জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে।

এদিকে গত বছর ৩০ নভেম্বর ইউপিডিএফ এক মানববন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় গণহত্যায় তাদের ১১৪ জন নেতকর্মী নিহত হয় বলে দাবি করে। মানববন্ধনে ইউপিডিএফ তাদের এসব নেতাকর্মী হত্যার বিচার দাবি করেন। ২০১১ সালের গত ২১ মে রাঙামাটি জেলার সুবলঙের মিদিঙাছড়ি গ্রামে সাংগঠনিক কাজে গেলে ইউপিডিএফের নেতাকর্মীদের ওপর জেএসএস সন্তু লারমার লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতা অনিমেষ চাকমাসহ ৪ সদস্যকে খুন করে।

উল্লেখ্য, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে বিন্যস্ত ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল এলাকার পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে প্রায় ১৪ লাখ লোক বাস করেন। ১৯৮১ সালে পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ির সংখ্যা ছিল ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বাঙালি ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সেখানে ৫১ শতাংশ বাঙালি ও ৪৯ শতাংশ পাহাড়ির বসবাস। সর্বশেষ ২০০১ সালের হিসাবে ৫৯ শতাংশ বাঙালি ও ৪১ শতাংশ পাহাড়ি সেখানকার বাসিন্দা।

-আর্কাইভ নিউজ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন দশকে ৩০ হাজার বাঙালী হত্যার একটিরও বিচার হয়নি”

  1. Pingback: পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন দশকে ৩০ হাজার বাঙালী হত্যার একটিরও বিচার হয়নি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন