পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ঘিরে বিদেশিদের মহাপরিকল্পনা

fec-image

বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘিরে ‘মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে এগোচ্ছে ভারতসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কিছু রাজনীতিবিদ ও সংগঠন। ভারতের চাওয়া এই পার্বত্যাঞ্চল ও ত্রিপুরা নিয়ে ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ গঠন আর পূর্ব তিমুরের মতো পৃথক রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতা চালাচ্ছে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কিছু এনজিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক এবং কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করছেন। এমন বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি কার্যবিবরণীতে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিন পার্বত্য জেলাকে অস্থিতিশীল করার আরো চেষ্টা হবে বলে আশঙ্কা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের।

গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রেরণের জন্য ১০ পৃষ্ঠার কার্যবিবরণী প্রস্তুত করে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তির নানামুখী অপতৎপরতা তুলে ধরে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ওই এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও গুজব ছড়িয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও কার্যবিবরণীতে তুলে ধরা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র আমার দেশকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চল ঘিরে অনেক ধরনের তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় দেশের সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে পার্বত্যাঞ্চলের বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়েছে। অক্টোবর মাসের মধ্যেই সবগুলো সংস্থা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা কমিটির একটি বৈঠক হয়। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টা, সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অংশ নেন। ওই বৈঠকে এসব প্রতিবেদন ও পার্বত্যাঞ্চল ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও নানামুখী অপতৎপরতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। তারই আলোকে এ কার্যবিবরণী তৈরি করা হয়েছে। এতে পার্বত্য এলাকা ঘিরে সরকারের কী করা উচিত, সে বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে।

গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড গঠনের চক্রান্ত

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ কার্যবিবরণীর ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা নিয়ে ভারতের ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ গঠনের চক্রান্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের ত্রিপুরার রাজপরিবারের প্রধান প্রদ্যোত বিক্রম মানিক্য দেব বর্মা বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা ও ত্রিপুরাকে নিয়ে ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ গঠনের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছেন। তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজপরিবারের প্রধান ভারতের এএনআই নিউজকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম একসময় বাংলাদেশের অংশ ছিল না এবং সেখানে থাকা চাকমা জনগোষ্ঠী কখনোই বাংলাদেশের অংশ হতে চায়নি। বর্মা আরো বলেন, ঐতিহাসিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ও জাতিগত অংশ। এখন সময় এসেছে এ অঞ্চলকে একত্র করে ভুটানের মতো একটি বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ গঠনের।

বর্মাকে উদ্বৃত করে কার্যবিবরণীতে আরো বলা হয়েছে, ‘তিনি (বর্মা) আরো দাবি করেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠী আলাদা রাষ্ট্র চায় এবং তারা এর জন্য প্রস্তুত। এ বিষয়ে কোনো গণভোট না হলেও আমি জানি তারা এটা চায়। আমি বলছি না এটি পূর্ব তিমুর হোক। আমি চাই এটি ভুটানের মতো একটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে উঠুক, যেখানে আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষরা স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে।’

পশ্চিমাদের চাওয়া পূর্ব তিমুরের মতো রাষ্ট্র

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, কিছু বামপন্থি সংগঠন ও দেশি-বিদেশি কয়েকটি এনজিও পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তারা চাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদান’-এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনের বর্ণনা দিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘অতি গোপনীয়’ এ কার্যবিবরণীতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অংশ নেওয়া উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য আমার দেশকে বলেন, কিছু রাজনীতিবিদ, ছাত্রসংগঠন ও এনজিওর কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রচণ্ড আঘাত। তিনি বলেন, উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ সুদান ও পূর্ব তিমুরের রাজনৈতিক পরিবর্তন লক্ষ করলে দেখা যাবে, এর সূচনা হয়েছিল প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ বছর আগে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে এ ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, তা এখন থেকেই আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তা করতে হবে।

পশ্চিমা দেশগুলোর কয়েকটি এনজিওর কার্যক্রমের বিষয়েও আপত্তি তুলে ধরা হয়েছে গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনগুলোর উদ্বৃতি দিয়ে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু সেপ্টেম্বরেই তিন পার্বত্য জেলায় পশ্চিমা কয়েকটি দেশের ১৩ জন ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ সফর করেছেন। এছাড়াও কয়েকটি এনজিও ও আইএনজিওর তৎপরতা লক্ষ করা গেছে।

ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসছে অস্ত্র

পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র আসে মূলত ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে। পাশাপাশি ভারতীয় কিছু গ্রুপ আর্থিক কষ্টে পড়লে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। এমন তথ্যও তুলে ধরা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যবিবরণীতে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সম্প্রতি মিজোরাম থেকে ইউপিডিএফের (প্রসীত) জন্য আট হাজার গোলাবারুদের একটি চালান পার্বত্য এলাকায় আনার পরিকল্পনা করা হয়। ওই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে গোলাবারুদ আনতে ব্যর্থ হয় ইউপিডিএফ।’

পার্বত্য এলাকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘একটি মহল খাগড়াছড়িতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটছে। কিছু সন্ত্রাসী পাহাড়ের উপর থেকে গুলি চালাচ্ছে। এসব অস্ত্র প্রায়ই দেশের বাইরে থেকে আসে।’

পাহাড় অশান্ত করতে দেবাশীষ রায়ের উসকানি

পার্বত্য জেলাগুলোয় উপজাতিদের উসকে দিচ্ছেন চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়। এ বিষয়ে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সম্প্রতি কথিত ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, এ পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পাহাড়িদের অশান্ত করার অপচেষ্টা চালান দেবাশীষ রায়। তিনি পরিকল্পিতভাবে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করতে প্রশাসনের সমালোচনা করাসহ বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন, যা পরে পাহাড়কে আরো অশান্ত করে তোলে।’

পাহাড়কে অশান্ত করতে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, কিছুদিন আগে খাগড়াছড়িতে এক পাহাড়ি ছাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন বলে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তাতে পুরো পার্বত্য এলাকায় পাল্টাপাল্টি হামলা, নিহত-আহত, অবরোধ, ১৪৪ ধারা জারির ঘটনাও ঘটে। অথচ পরে ওই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করে। তাতেও ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। ডা. জয়া চাকমার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই ছাত্রীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। ধর্ষণের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি।

গুজবে ভর করে পার্বত্য এলাকাকে অশান্ত করার চক্রান্তের বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আরেফিন জুয়েল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সবই তো দেখলেন এবং জানলেন। বিষয়টি একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। আসলে ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেনি। মিথ্যা একটি অভিযোগ তুলে পুরো পার্বত্যাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল একটি গোষ্ঠী।’

দেবাশীষ রায়ের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে কার্যবিবরণীতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘খাগড়াছড়ির কথিত মারমা কিশোরী ধর্ষণকেন্দ্রিক দেবাশীষ রায়ের কর্মকাণ্ড উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিকর। তারা এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা করতে অনলাইন ও অফলাইনে মিথ্যা, বানোয়াট ও উসকানিমূলক প্রচারণা চালিয়েছে।’

পার্বত্য এলাকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন সাবেক সচিব শফিউল আজিম। দেবাশীষ রায়ের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘একবার আমরা জানতে পারলাম পার্বত্য এলাকায় দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে পশ্চিমা দেশের কয়েকটি সংস্থার প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসেছেন। বিষয়টি সরকারের কোনো পর্যায়ে জানানো হয়নি। আমাদের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বৈঠকস্থলে যেতে চাইলে তাকে উচ্ছৃঙ্খল কিছু তরুণ বাধা দেয়। শেষ পর্যন্ত তাকে ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হয়নি।’

পাহাড়কে অশান্ত করতে ভারত থেকে উসকানি

পার্বত্য তিন জেলাকে অশান্ত করতে ভারত থেকে অব্যাহতভাবে উসকানি দেওয়া হচ্ছে- এমন তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যবিবরণীতে। এতে বলা হয়েছে, ‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় উপজাতীয় সংগঠন অল ইন্ডিয়া চাকমা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, ত্রিপুরা চাকমা স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও মিজোরাম চাকমা স্টুডেন্ট ইউনিয়ন এবং পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন ছাত্র সংঘ ও আরাকান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে পৃথকভাবে বিবৃতি দেয়। এতে তারা পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীর ওপর দমনপীড়নের মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে এবং সরকার ও সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ইসলামি চরমপন্থি হিসেবে উল্লেখ করে মিথ্যাচার করে।’

কার্যবিবরণীতে দিল্লির ষড়যন্ত্রের বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গত ৩০ সেপ্টেম্বর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে দিল্লিতে বসবাসরত এবং ইউপিডিএফ (প্রসীত) সমর্থিত সুহাস চাকমা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে পাহাড়ে গণহত্যার মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করেন। এরপর ৩ অক্টোবর একই কাউন্সিলে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বৈষম্য ও বর্ণবাদের অভিযোগ তুলে ফের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেন। পাশাপাশি গুইমারার ঘটনা তদন্তে ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার (ওএইচসিএইচআর) হস্তক্ষেপ চান। ভারতীয় গণমাধ্যম এটি ফলাও করে প্রচার করে।’

পাহাড়কে অশান্ত করতে কাজ করছেন যারা

রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের নাগরিক সেজে পার্বত্যাঞ্চলকে অশান্ত করে বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নে যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কাজ করছে, তাদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে কার্যবিবরণীতে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘খাগড়াছড়ির কথিত মারমা কিশোরীর ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাম রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপজাতি নেতারা সরকার ও সেনাবাহিনী নিয়ে মিথ্যা, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে ইউল্যাবের শিক্ষক অলিউর রহমান, ফারজানা প্রভা, অলিক মৃ, জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক, টনি চিরান, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, শামসুল হুদা, জাকির হোসেন, গোলাম মাওলা রনি, হেনা চাকমা, রুপাইয়া তঞ্চঙ্গা, সুর্মি চাকমা, অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল ও অনন্ত তঞ্চঙ্গা উল্লেখযোগ্য।

কার্যবিবরণীতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, পার্বত্য এলাকায় ইউপিডিএফের (প্রসীত) অপতৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তাদের নেতাককর্মীরা দেশে ও বিদেশে অবস্থান করে ঢাকাসহ তিন পার্বত্য জেলায় এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা ও উসকানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে।

ঐক্যবদ্ধ না হলে সামনে গুরুতর বিপদ

পার্বত্য এলাকা নিয়ে বিদেশিদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর তাগিদ দিয়েছেন সাবেক সচিব শফিউল আজিম। দীর্ঘ সময় ধরে পার্বত্য এলাকা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শফিউল আজিম বলেন, পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এখন এটি জোরদার হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে ধর্ম, বর্ণ, পেশা ও জাতিগত বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভৌগোলিক কারণেই পার্বত্য এলাকায় সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদেরও দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাহাড়ে বসবাসকারী সব নাগরিকের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার জন্য পাইলট প্রকল্পসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।

পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সাবেক এই সচিব বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় আয়োজিত এথনিক (নৃ) গোষ্ঠীসংক্রান্ত একটি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে জার্মানির একজন প্রবীণ সাংবাদিকও অংশ নিয়েছিলেন। আমাকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের পার্বত্য তিন জেলা সম্পর্কে জানতে চান। আমাদের পার্বত্য এলাকা সম্পর্কে তিনি কতটুকু জানেন- জানতে চাইলে তিনি এমন কিছু তথ্য দিলেন যা ছিল খুবই ভয়ানক ও বিপজ্জনক। আমাদের তিন পার্বত্য জেলা ও ভারতের কিছু এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা তিনি আমাকে বেশ জোর দিয়ে বললেন। পরে আমরা সম্মেলনে আমাদের পার্বত্যাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস তুলে ধরি।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরে শফিউল আজিম বলেন, তিনটি পার্বত্য উপজেলায় খুব দ্রুত খ্রিস্টানাইজেশন হচ্ছে। কয়েকটি উপজেলায় মুসলিম, হিন্দু ও বৌদ্ধদের মোট জনসংখ্যার চেয়ে খ্রিষ্টান জনসংখ্যা বেশি। এটিও অবশ্যই চিন্তায় নিতে হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য এলাকায় আমাদের জ্ঞাতসারে হোক আর অজ্ঞাতসারে হোক, আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি এনজিওর কার্যক্রম বাংলাদেশের পক্ষে নয়।

একটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে শফিউল আজিম জানান, উপজাতিদের মধ্যে অধিকাংশই বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে ঘৃণা করছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে তারাও অপছন্দ করছে। রাষ্ট্রের মেইনস্ট্রিম কর্মকাণ্ডে আরো বেশি পরিমাণে তাদের যুক্ত করতে হবে। সীমান্ত এলাকাগুলোয়ও টহল ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের উদ্যোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও মনে করছেন সাবেক এই সচিব।

রুলস অব বিজনেস থেকে বাদ দেওয়ার আবদার

ইতঃপূর্বে পার্বত্য এলাকার একটি পাহাড়ি সংগঠনের পক্ষ থেকে তিন পার্বত্য জেলাকে রুলস অব বিজনেস থেকে বাদ দেওয়ার আবদার জানিয়ে সরকারের কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। তবে সরকার ওই চিঠি নাকচ করে পাল্টা জবাব দিয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

চিঠিটি যখন পাঠানো হয়েছিল, তখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন ও বিধি শাখার অতিরিক্ত সচিব ছিলেন শফিউল আজিম। এ বিষয়ে তিনি আমার দেশকে বলেন, বিগত সরকারের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি চিঠি পাঠানো হয়। সরকারের রুলস অব বিজনেস থেকে তিন পার্বত্য জেলাকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাবের কথা শুনে পুরো প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয় ওই সময়।

প্রস্তাবটি সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, রুলস অব বিজনেস হলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে কার্যাবলি বণ্টন এবং পরিচালনার জন্য প্রণীত একটি নিয়মাবলি। এ নিয়মাবলি সরকারি প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সুসংহত ও নিয়মতান্ত্রিক করে তোলে। এটি সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রণীত। পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কতটা গভীর থেকে হচ্ছে, ওই চিঠিই তার নিকৃষ্ট উদাহরণ।

প্রবন্ধ লেখকঃ এম এ নোমান

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, প্রবন্ধ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন