পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বোঝাবুঝির অভাব

জেনারেল ইব্রাহীম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক:

দুই প্রকারের ‘গ্যাপ’
দু’টি ইংরেজি শব্দযুগল উপস্থাপন করছি। একটা হলো ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’; আরেকটি হলো ‘জেনারেশন গ্যাপ’। প্রথমে কমিউনিকেশন গ্যাপ সম্বন্ধে বলি। এটা বলতে বুঝায়, দু’জন ব্যক্তির মধ্যে বোঝাবুঝির অভাব। এর মানে এই নয় যে, যোগাযোগের অভাব। ফোন আছে, ফোনে আলাপ হচ্ছে অথবা সামনে দেখা হচ্ছে, হাত মেলানো হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু বক্তা যা বলতে চাচ্ছেন, অথবা যা বললেন, শ্রোতা সেটা না বুঝে অন্য কিছু বুঝলেন। অনেক সময় তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে অনেক বার্তা আদান-প্রদান হয়; সেই সময়ও কী বার্তা প্রদান করা হলো এবং প্রাপক কী বুঝলেন, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য হয়ে যায়। দু’জন ব্যক্তির মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি হতেই পারে। এইরূপ পরিস্থিতিতে তিও হয়ে যেতে পারে। এখন জেনারেশন গ্যাপ নিয়ে বলি। সাধারণত ত্রিশ-বত্রিশ বছরকে একটা জেনারেশন বা প্রজন্ম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়।

আমি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। যখন যুদ্ধ করি তখন বয়স ছিল সাড়ে একুশ থেকে সাড়ে বাইশ। সার্বিকভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তারা এখন ষাট বছরের বেশি বয়স্ক। আমরা একটা প্রজন্ম। যাদের বয়স এখন পঁচিশ-ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ, তারা আরেকটা প্রজন্ম। আমার নাতিরা বা তাদের চেয়ে পাঁচ-সাত বছরের বড় যারা তারা আরেকটা প্রজন্ম। পোশাক-আশাকের ধরন, কথা বলার ধরন, শব্দচয়নের ধরন, খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস, বিয়েশাদিতে সামাজিকতার নিয়মকানুন ইত্যাদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তারতম্য হয় কিছুটা। আবার এটাও সত্য যে, আমাদের প্রজন্মের কষ্ট ও ত্যাগ (১৯৬৬-১৯৭২) অথবা স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে আমাদের কষ্ট ও ত্যাগ (১৯৭২-১৯৯০) সাধারণভাবে বর্তমান প্রজন্ম মূল্যায়ন করে কূল পাবে না। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ইতিহাস-জ্ঞান প্রচার করতে হয়, যেন গ্যাপ কম থাকে। দেশের মানুষের মানসিক চিন্তার প্রকৃতি ও ধারা বদলে যাচ্ছে। এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলতে গেলে শ্রোতার কাছে এটা রূপকথার মতো মনে হয়। অনুরূপ আরো বিষয় আছে যেগুলো আজ ২০১৫ সালে অনেকের কাছে খুবই আশ্চর্যজনক মনে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আজকের সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে কষ্ট করে চিন্তা করতে হবে, মেজর মোহসিন নামক একজন সাহসী অফিসার কেন ঘণ্টাছড়ি নামক জায়গায় অ্যাম্বুশে পড়ে অনেক সৈনিকসহ শহীদ হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, আজকে যিনি রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায় এসি ল্যান্ডের দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি কল্পনাই করতে পারবেন না হয়তো, পঁচিশ বছর আগে এখানে আসতে হলে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন সুযোগ হতো এবং তা-ও অনেক পাহারার মধ্য দিয়ে।

গ্যাপ সম্বন্ধে আলোচনা কেন?
কমিউনিকেশন গ্যাপ এবং জেনারেশন গ্যাপ- এ দুটো কথা ব্যাখ্যা করার কারণ হলো, আজকে ২০১৫ সালে যাদের বয়স ত্রিশ এবং তার কম অথবা সেনাবাহিনীতে কর্মরত যাদের চাকরি বাইশ বছরের কম, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সেখানে বিরাজমান সমস্যা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত না থাকার সম্ভাবনা আছে। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে, কিন্তু লজ্জায় যদি ধারণাটা প্রকাশ না করি, সেটাও ভুল হতে পারে। আমাদের জেনারেশন এবং যাদের কথা উল্লেখ করলাম এই তরুণদের জেনারেশনের মধ্যে একটা ‘ভালো গ্যাপ’ সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য আজ এই কলামে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আলোচনা করছি। সেখানে একটি সমস্যা বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত (অফিসারসহ) সেনা-বিডিআর-পুলিশ সদস্য প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে সরকারের হুকুমে দায়িত্ব পালনকালে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বার্থে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার নিরীহ পাহাড়ি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছেন দুই পরে যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত পাহাড়ি তরুণ প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তথা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে। আজকের ২০১৫ সালে আমার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি কৃত্রিম শান্তি বিরাজ করছে। এই কৃত্রিম শান্তিও যদি লঙ্ঘিত হয়ে যায়, তখন শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নতুন প্রোপটে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা ও সার্কেল
এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি জেলা। ১৯৮৪ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর ছিল রাঙ্গামাটি। ওই জেলার তিনটি মহকুমার মধ্যে সদর মহকুমার নাম ছিল রাঙ্গামাটি। আরেকটি মহকুমার নাম ছিল বান্দরবান। তৃতীয় মহকুমার নাম একসময়ে ছিল রামগড়, কিন্তু হেডকোয়ার্টার খাগড়াছড়ি। রামগড় নামক ক্ষুদ্র শহরটি অতি সীমান্তবর্তী (জিরো লাইন সংলগ্ন) শহর হওয়ায় মহকুমার সদর দফতর ছিল কিছু দূরে খাগড়াছড়ি শহরে। ১৯০১ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক জেলা ও প্রশাসনিক অঞ্চলকে তিনটি সার্কেলে ভাগ করা হয়েছিল। রাঙ্গামাটি-কেন্দ্রিক সার্কেলটির নাম চাকমা সার্কেল। কারণ, এখানে চাকমা উপজাতীয় মানুষের প্রাধান্য ছিল। বান্দরবানকেন্দ্রিক সার্কেলটির নাম ছিল বোমাং সার্কেল এবং এখানে মার্মা উপজাতীয় মানুষের প্রাধান্য ছিল। খাগড়াছড়িকেন্দ্রিক কোনো সার্কেল ছিল না। তৃতীয় সার্কেলটির নাম ছিল মং সার্কেল এবং এটি ছিল মানিকছড়িকেন্দ্রিক। মানিকছড়ি হচ্ছে বর্তমানে একটি উপজেলা বা থানার নাম; চট্টগ্রাম মহানগর থেকে হাটহাজারী ফটিকছড়ি হয়ে মানিকছড়ির ওপর দিয়ে খাগড়াছড়ি যেতে হয়। মানিকছড়ি থেকে ৪০ মাইল উত্তরে এবং রামগড় থেকে ১২ মাইল পূর্বে খাগড়াছড়ি শহর। ব্রিটিশ আমল থেকে সার্কেলের প্রধানগণকে বলা হতো ইংরেজি ভাষায় ‘চিফ’। বাংলা ভাষায় বলা হয় ‘রাজা’; কিন্তু ইংরেজিতে কিং নয়। বর্তমান তিন সার্কেলের তিনজন চিফ তথা তিনজন রাজার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং বিবিধ অঙ্গনে সক্রিয় হলেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশিস রায়।

জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনী
পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনীতি ছিল একটি গৌণ বিষয়। প্রথাগত বা ট্র্যাডিশনাল নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য এবং সামাজিক একতা ছিল পাহাড়ি সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী তিন বছরে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বড় রকমের ঝাঁকি খায়। ১৯৭০ সালে রাঙ্গামাটি শহরে একটা গোপন মিটিং হয়েছিল, যে মিটিংয়ের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি গোপন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটি রাজনৈতিক দল । ১৯৭৩ সালে এর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে একটি সশস্ত্র শাখা খোলা হয়েছিল; যার নাম ছিল ‘শান্তিবাহিনী’। এর সর্বাধিক পরিচিত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি ১৯৭০ সালে তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব, ১৯৭২-এ তিনি গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার সময় তিনি তার যৌক্তিক আপত্তিগুলো তুলে ধরেছিলেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সেদিকে কর্ণপাত করেনি। হাতেগোনা যে দু’চারজন গণপরিষদ সদস্য ১৯৭২ সালের শেষাংশে নতুনভাবে লেখা বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।

১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটি শহরে একটি জনসভায় বঙ্গবন্ধু নিজে পাহাড়িদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোরা সবাই বাঙালি।’ এটা ছিল টিমটিম করে জ্বলা আগুনে কেরোসিন ঢেলে দেয়ার মতো একটি ঘটনা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত সময়ে শান্তিবাহিনী ভারতের মাটিতে এবং দেশের মাটিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেদের সুসংগঠিত করে। ভারতীয় সাহায্যে গোলাবারুদ সরঞ্জাম সংরক্ষিত করে। ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরে শান্তিবাহিনী প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সরকারের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এটাই হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে বিদ্রোহ বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

একেক জনের মূল্যায়নের একেক রকম প্রোপট
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইন্সার্জেন্সি, অর্থাৎ শান্তিবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাস ও ঘটনাপরিক্রমা দীর্ঘ। একেকজন বুদ্ধিজীবী বা সমাজবিজ্ঞানী বা সামরিক বিশ্লেষক বা ইতিহাসবিদ এই বিদ্রোহের ইতিহাস ও ঘটনাপরিক্রমাকে একেক রকম দৃষ্টিতে রচনা ও মূল্যায়ন করবেন- এটাই স্বাভাবিক। তবে রচনা ও মূল্যায়নে কিছু মৌলিক বিষয়ে পার্থক্য না থাকাই ভালো। মারাত্মক দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের েেত্র এই স্বাভাবিকতা থাকেনি। অর্থাৎ অস্বাভাবিক হয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী বা সমাজবিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদ, এমনকি রাজনৈতিক কারণে সামরিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও মূল্যায়নের যে পার্থক্য, সেটা কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে দৃশ্যমানভাবেই পরস্পর বিপরীতমুখী। তাই আজ ২০১৫ সালে এ প্রসঙ্গে অতি সংক্ষেপে কিছু কথা তুলে ধরছি। যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১৯৯৬ সালের পরে কমিশন পেয়েছেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে মতামত প্রদান ও মূল্যায়ন করবেন একভাবে। যারা ১৯৭০ দশকের শেষাংশে বা পুরো ১৯৮০-এর দশকব্যাপী বা ১৯৯০-এর দশকের প্রথম অংশে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করেছেন, তারা মতামত প্রদান ও মূল্যায়ন করবেন অন্যভাবে। অনুরূপ মন্তব্য বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্যও প্রযোজ্য। বেসামরিক ত্রে থেকে দু-একটি উদাহরণ দিই। যিনি ১৯৮৮-৮৯ সালে খাগড়াছড়ি জেলায় জেলা প্রশাসনে অথবা কোনো উপজেলায় চাকরি করেছেন, তিনি এক রকম দেখেছেন ও উপলব্ধি করেছেন। অপরদিকে, যে বেসামরিক কর্মকর্তা ১৯৯৬-৯৭ সালে জেলা প্রশাসনে বা কোনো উপজেলায় চাকরি করেছেন, তিনি আরেক রকম উপলব্ধি করেছেন।

আমার সম্পৃক্ততা
ব্যক্তিগতভাবে আমি ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি থেকে একই বছরে জুন মাস পর্যন্ত সাড়ে ছয় মাস সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে কাপ্তাইয়ের সন্নিকটে তৎকালীন ফারুয়া ও রাজস্থলী থানার ভৌগোলিক এলাকায় কাপ্তাইয়ে অবস্থিত পদাতিক ব্রিগেডের অধীনে কাজ করেছি। এরপর ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সাড়ে পাঁচ মাস, আশ্চর্যজনক ঘটনাক্রমে পঁচিশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে ফারুয়া (নতুন নাম বিলাইছড়ি) থানার ভৌগোলিক এলাকায় কাজ করেছি। এরপর ১৯৮৭ সালের জুলাই থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তারপর ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৭ থেকে ২৭ জুন ১৯৮৯ পর্যন্ত দেড় বছর খাগড়াছড়িতে অবস্থিত পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির প্রয়োজনে, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে রিজিওন কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করতাম। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য কর্মযজ্ঞ প্রস্তুত রাখেন। আমি যে দুই বছর ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছি, তার আগেও যেমন পরেও তেমন, সম্মানিত জ্যেষ্ঠ সেনাকর্মকর্তারা ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। প্রত্যেকের আমলই ঘটনাবহুল ছিল, তারা সর্বোৎকৃষ্ট অবদান রেখেছেন তাদের সহকর্মীদের নিয়ে। কিন্তু আমার ওই খাগড়াছড়ির সময়টুকু ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯৮৮-৮৯ সাল ব্যতিক্রমী সময়
পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেকবারই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সঙ্ঘাত হয়েছে; এবং উভয়পরে মানুষের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। শান্তিবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত নৃশংসতাও হয়েছে প্রচুর। সরকারি বাহিনীগুলো কর্তৃক পরিচালিত অপারেশনের কারণেও অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৮-৮৯ সালটি ব্যতিক্রম এ জন্য যে, ক্ষতি যেমন প্রচুর হচ্ছিল, তেমনই শান্তি স্থাপনের জন্যও সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। চারবার আমি নিজে শান্তিবাহিনীর সাথে সংলাপ করার জন্য গভীর জঙ্গলে নিরস্ত্র ও পাহারাবিহীন অবস্থায়, সিভিল পোশাকে গিয়েছি; এর মধ্যে তিনবার ছিলাম সরকারি প্রতিনিধিদলের প্রধান। এ জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায় একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়েও আমাকে গভীরভাবে জনসম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে হয়েছিল। বেসামরিক প্রশাসনের সাথে নিবিড় ও আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছিল। শান্তি স্থাপনের জন্য মানুষের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। শান্তি স্থাপনের জন্য বিদ্রোহী শান্তি বাহিনীর মনেও যেন সংলাপের প্রতি আগ্রহ থাকে, তার জন্য অনেক পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। দেড় বছরে আমি ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের ৪৯টি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলাম বিভিন্ন ময়দানে; ঘরের ভেতরে ঘরোয়া বৈঠকের কথা বলছি না। আমার জন্য জনসম্পৃক্ত রাজনীতির হাতেখড়ি ওখানেই।

অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, এই শান্তিপ্রক্রিয়ার প্রধান উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আমার তাৎণিক ওপরে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চট্টগ্রামে অবস্থিত ডিভিশনের জিওসি (বৃহত্তর ময়মনসিংহের নান্দাইলের সন্তান) মেজর জেনারেল আব্দুস সালামও নিবিড় ও উদারভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আমাদেরকে অনেক ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। প্রথমেই আমাকে আমার কনিষ্ঠ সহযোগী ও সহকর্মীদের বোঝাতে হয়েছে, আশ্বস্ত করতে হয়েছে, উদ্দীপ্ত করতে হয়েছে। কারণ এ ধরনের বড় ও জোরালো কাজ কোনো দিনও একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। একটা টিম লাগে। টিম বিল্ডিং একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর রহমতে আমরা ভালো টিম গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। তাই আমি ওই সহকর্মী ও সহযোগীদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখানে নাম লিপিবদ্ধ না করলেও, ছোট-বড় শতাধিক অফিসার যারা আমার সহকর্মী ছিলেন এবং প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক বিভিন্ন পদবির সৈনিক যারা সহকর্মী ছিলেন, তারাও আপ্রাণ আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করেছেন। অফিসার ও সৈনিক বলতে সেনাবাহিনী, বিডিআর, জেলা পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, আনসার এবং ভিডিপি- সব সংস্থার মানুষকেই বুঝাচ্ছি।

বিস্তারিত তথ্যভাণ্ডার
আমার বক্তব্যে কেউ-না-কেউ দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। তর্ক-বিতর্ক করার স্বাধীনতা বহাল রাখতেই হবে। এই ক্ষুদ্র কলামে সব কথা যেহেতু কোনো অবস্থাতেই উপস্থাপন করা সম্ভব নয়, সেহেতু অবশ্যই সম্মানিত পাঠক সমাজকে আহ্বান জানাব একটি পুস্তক সংগ্রহ করে পড়ার জন্য। পুস্তকটির নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিপ্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’। পুস্তকটির লেখক আমি নিজে। প্রকাশক মওলা ব্রাদার্স। ঠিকানা : ৩৯, বাংলা বাজার, ঢাকা। মওলা ব্রাদার্সের ফোন নম্বর : ৭১৭৫২২৭ অথবা ৭১১৯৪৬৩। তাদের ইমেইল : [email protected]. বইটি ঢাকায় অনেক দোকানে পাওয়া যায়, আবার অনেক দোকানে পাওয়া যাবেও না। কারণ পুস্তকের বিষয়বস্তু কঠিন এবং ‘আনকমন’। তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের সন্নিকটে ‘বুক ওয়ার্ম’ নামের দোকানে অথবা বেইলি রোডে (অপর নাম নাটক সরণি) সাগর পাবলিশার্সে পুস্তকটি পাওয়া যাবেই। চট্টগ্রাম মহানগরে প্রেসক্লাব বিল্ডিংয়ে ‘বাতিঘর’ নামের দোকানে বইটি পাবেন।

সম্মানিত পাঠক, আমি কি ব্যক্তিগত বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনো নৈতিক অপরাধ করছি? উত্তর হলো, না। কারণ এই পুস্তকের বিক্রয়লব্ধ কোনো রয়েলটি নিই না বা আমার কাছে আসে না এবং এ নিয়ে আগ্রহী নই। কিন্তু পুস্তকটির বিষয়বস্তু আমার মতে, জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ; সেজন্য বিস্তারিতভাবে জানালাম। আমার ওয়েবসাইট, এই কলামের নিচে দেয়া আছে; ওই ওয়েবসাইটেও বইটির সারমর্ম পাবেন। বিশেষ করে সব ধরনের গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর ও প্রশাসনের কর্মকর্তা যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে জড়িত, তাদের জন্য বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামকে বুঝতে হলে এর প্রেক্ষাপট জানতেই হবে। অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি অনেক বই লিখেছেন; সেগুলোও অবশ্যই পড়তে পারেন। কারণ, পড়া উচিত। নয়া দিগন্ত পত্রিকা, কিছু বিশেষ শ্রেণীর পাঠকের কাছে, সরকারি প্রশাসনিক নির্দেশে, পৌঁছায় না। তাই পাঠক সম্প্রদায়ের মধ্যে যাদের কাছে এই নয়া দিগন্ত পত্রিকা পৌঁছায়, তাদের মাধ্যমেই এই সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান রাখছি।

শান্তিপ্রক্রিয়ার দুইটি প্রধান ধাপ
পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলির সূত্রপাত (১৯৭১-৭৬) হয়েছিল আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রোপটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহ দুধ কলা খেয়ে, ভিটামিন খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছিল (১৯৭৭-৯০) আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রোপটে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অনেক রকম পদপে নেয়া হয়েছিল; যার মধ্যে দুইটি প্রধান পদক্ষেপের উল্লেখ করছি। একগুচ্ছ পদক্ষেপ হলো ১৯৮৮-৮৯ সালের; যথা একাধিক দফায় সংলাপ, তিন জেলার সামাজিক ও নাগরিক নেতাদের সাথে তিনটি আলাদা চুক্তি, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে তিন জেলার জন্য তিনটি ও সার্বিকভাবে একটি, মোট চারটি আইন পাস; আরো পরে ২৫ জুন ১৯৮৯ তারিখে তিন জেলায় প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদের নির্বাচন। অপর পদক্ষেপগুচ্ছ হলো, ১৯৯৬-৯৭ সালের যথা একাধিক দফায় সংলাপ এবং ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর। ১৯৮৮-৮৯ সালের পরিশ্রমের ফসল ছিল ওই সময়ের চুক্তি ও আইনগুলো। এই পরিশ্রম ও ফসলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৬-৯৭ সালে নতুন করে চুক্তি করা হয়েছিল। এই চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সতেরো বছর ধরেই বিতর্ক অব্যাহত আছে।

ছাই চাপা আগুন
আমার সামরিক অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে নিবেদন করছি, আন্তর্জাতিক রাজনীতির  প্রেক্ষাপট বদলেছে, আঞ্চলিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলেছে, আঞ্চলিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের রূপ বদলেছে ইত্যাদি যেমন সত্য, এটাও সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইন্সার্জেন্সির আগুন কোনোমতেই সম্পূর্ণভাবে নিভে যায়নি। যে আগুন নেভেনি, সেটা ছাই দিয়ে চাপা রাখা যায়। কিন্তু সে আগুন যে আবার জ্বলবে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। সাম্প্রতিককালের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংবাদগুলোর মূল্যায়ন করেই এই কথাগুলো বলছি। আগামী সপ্তাহেও এই কলামের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আরো একটু লিখব বলে আশা করি।

♦ লেখক : মেজর জেনারেল (অব:) ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন