পাহাড়ের বাংলা বর্ষবরণ উৎসব- বৈসাবী

Boisabi pic2

দিদারুল আলম রাফি, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি:

পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-দশমাংশ। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড় অধ্যুষিত অঞ্চল এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই পরিচয় ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভিন্ন কারনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় একটি ব্যাতিক্রমী অঞ্চল। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে বাঙলি ছাড়াও বাস করে প্রায় ১৩ টি  নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী। এই নৃতাত্বিক গোষ্ঠী সমূহের আছে বিভিন্ন উৎসব। এর মধ্যে তাদের বর্ষবরণ উৎসবই সবচেয়ে বড় উৎসব বলে বিবেচিত হয়।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান অধিবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে থাকে। চাকমারা পালন করে ‘বিজু’ নামে, ত্রিপুরারা ‘বৈসু’, তঞ্চঙ্গ্যারা ‘বিসু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ নামে। এই চার সম্প্রদায়ের দেওয়া উৎসবের নামগুলো একত্র করে, এখন এর নাম রাখা হয়েছে ‘বৈসাবি’। এই উৎসব প্রতিবছর বাংলা চৈত্র মাসের ৩০, ৩১ ও নতুন বছরের বৈশাখের ১ তারিখে আয়োজন করা হয়। পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর এই উৎসব বেশ পুরোনো। চাকমাদের পালাগান গেংখুলীতে এই বিজু উৎসবে যুবক-যুবতীদের প্রেম ও আদি-রসাত্মক বিভিন্ন জিনিস বর্ণিত হয়েছে। চাকমাদের উপাখ্যান ‘রাধামন’ ও ‘ধনপুদি’তেও আছে এই উৎসবের বর্ণনা।

যেই নামেই ডাকা হোক না কেন, এই বৈসাবি উৎসবটি মূলত বাংলা বর্ষবরন উৎসবেরই অপর একটি নাম। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। বাংলা সন গননাও শুরু হয় তার সময়কাল থেকেই। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাসুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। মোঘলদের অধীনস্থ হিশেবে তখনকার উপজাতি শাসকরাও এই নিয়ম মেনে কর ও খাজনা আদায় করতেন।  মুঘল আমল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীরা বাঙালিদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হন যে, আসাম সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটের পরিচালক জেপি মিলস ১৮ শতাব্দীতে চাকমাদের ‘Most Bengali Tribes’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এরপর ১৯৬৭ সালের দিকে যখন ঘটা করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন তথা পহেলা বৈশাখ পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠে, অনুমান করা হয় তেমন সময়েই পাহাড়িদের এই উৎসবগুলো বিস্তৃতি লাভ করে।

বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর এই উৎসবকে ভিন্ন নামকরনের কারন জানা না গেলেও, স্বকিয়তা নিয়ে তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত সচেতন পাহাড়ের বিভিন্ন গোষ্ঠী মুঘল সুবেদারদের খুশি করতেই বেশ জাকজমকের সাথে এই উৎসব পালন করা শুরু করে। তবে নিজেদের স্বকিয়তা বজায় রাখতেই ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করা হয়। তবে বর্তমানে সব উৎসবকে একত্রে বৈসাবি নামেই ডাকা হয়।

 বৈসাবী উৎসবের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম থাকে উৎসবমুখর। চাকমারা বৈসাবি তথা বিজুর প্রথম দিন সারা বাড়িঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে। ভোরে নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে এই উৎসবের শুরু করে তারা। ঐদিন ঘর ফুল দিয়ে সাজানো হয়। বাড়ির পোষা মুরগী, কুকুর, বিড়াল এমনকি পাড়ার অন্যান্যদের পোষা প্রাণীদের পর্যন্ত সবাই খাবার খাওয়ায়। পরের দিন চাকমাদের মূল বিজু। মূল বিজুর দিন সবাই বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েরা সকালে উঠে নদীতে স্নান করতে যায়। স্নান করে নতুন জামাকাপড় পড়ে।

সেদিন সবার বাড়িতে বিশেষ ধরণের ‘পাঁচন’ রান্না করা হয়। পাঁচন হচ্ছে শুটকি ও ১০-৪০ পদের সবজী মিশিয়ে রান্না করা এক ধরণের নিরামিষ খাবার। সাথে তৈরী হয় মিষ্ঠান্ন আর পিঠা-পুলী। তাদের আদি একটি বিশ্বাস হচ্ছে, যদি সাত ঘরের পাঁচন খাওয়া হয়, তাহলে বছরের বাকী দিনগুলোতে শরীর ভালো থাকে। এজন্য সবার মধ্যে একটি চেষ্টা থাকে সাতটি ঘর ঘুরে আসে।

ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীরা এই উৎসবকে বৈসু উৎসব বলে থাকে। বৈসু উৎসব বাংলা বছরের প্রথম ও শেষ দুইদিনকে বলা হয়ে থাকে। বৈসু উৎসব কেবলমাত্র বর্ষবিদায় ও বর্ষবরন স্বর্বস্ব নয়। এই উৎসবের সাথে লোকাচার ও ধর্মীয় অনুভূতিও সম্পৃক্ত রয়েছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসু উৎসবের প্রথম দিনকে ‘হাড়ি বৈসু’ ও দ্বিতীয় দিনকে ‘বিসুমা’ এবং বাংলা পহেলা বৈশাখকে ‘বিসিকতাল’ নামে অবিহিত করে। হাড়ি বৈসুর দিনটি হল গৃহস্থদের জন্য সবচেয়ে ব্যাস্ততম দিন। এদিন বিশেষ শ্রদ্ধা সহকারে গবাদি পশু-পাখির সেবা ও পরিচর্যা করা হয়। চন্দন পানি দিয়ে গবাদি পশুদের স্নান করা হয়। বিসুমা’র দিন নিরামিষ রান্না হয় প্রতিটি বাড়িতে। এই দিনে প্রাণি হত্যা নিষিদ্ধ। দৈহিক, মানসিক ও সামগ্রিকভাবে মঙ্গলের জন্য এই দিন উপাসনা করা হয়। এই দিন তারাও ‘পাঁচন’ নামের বিশেষ নিরামিষ রান্না করা হয়। তৃতীয় দিন অর্থাৎ ‘বিসিকতাল’ দিনটি মূলত বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পর্ব। এইদিন সবাই নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আমিষ রান্না করে। বয়স্ক আত্মীয়দের স্নান ও প্রনাম করা হয়। এদিন কাউকে খালি মুখে বিদায় দেওয়া হয় না। এভাবেই শেষ হয় তিনদিনের বৈসু উৎসব।

মারমাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হচ্ছে ‘সাংগ্রাই’। চৈত্র মাসের প্রথম দুইদিন ও বৈশাখ মাসের প্রথম দিন সাংগ্রাই উৎসবের ব্যাপ্তিকাল। বয়স্করা শীল বা উপবাস পালন করেন এই দিনে। পুরাতন দিনে যা কিছু অমঙ্গল বা অশুভ, তা বর্জন করে নতুনের আহবানে করা হয় জলকেলি বা পানি খেলা। এই জলকেলি মূলত হয় তরুন তরুনীদের মধ্যে। একে অপরকে পবিত্র পানি ছিটিয়ে তারা এই উৎসব পালন করা হয়। মূলত এই জলকেলিই এই উৎসবের প্রধান আকর্ষন।

তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন বিসু পালন করে থাকে। বিসুর দিন তারা নতুন কাপড়চোপড় পরে আত্মীয়দের সাথে দেখা করে। প্রতি পাড়ায় পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরীর ধুম পরে যায়। বিসুর দ্বিতীয় দিন তারা ‘ঘিলা’ খেলায় মেতে উঠে। নতুন বছরের প্রথম দিন সবাই স্নান করে মন্দিরে যায়। মন্দিরে বৌদ্ধ বিক্ষুদের দ্বারা পঞ্চশীল গ্রহন করে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে। এদিন আত্মীয় স্বজন ও বয়স্কদের যত্ন করে খাওয়ানো হয়। এছাড়া তারা খেলাধুলা ও সয়াংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ অত্যন্ত আনন্দ উৎসবের সাথে পালন করে ম্রো সম্প্রদায়। ম্রো সমাজে এই উৎসব ‘ক্লবংপাই’ নামে পরিচিত। বছরের শেষ দিন বুনোফুল দিয়ে নিজেদের ও ঘরবাড়ি সাজায় তারা। এদিন ফুল পূজা হয়। পহেলা বৈশাখে বাড়ির বয়স্কদের স্নান করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরানো হয়, শিশুদের খাওয়ানো হয় খাবার। ঐদিন শুটকি দিয়ে পাঁচন রান্না করে আপ্যায়ন করা হয়। সারাদিন পাড়ার সকলে আনন্দে মেতে উঠে এবং প্রাণি হত্যা থেকে বিরত থাকে।

চাকদের বড় উৎসবও সাংগ্রাই। এই উৎসব হয় পাঁচদিনব্যাপী। এই শুভ দিনে চাকরা সকল হিংশা-বিদ্বেষ ভুলে উৎসবে মেতে উঠে। নবীন ও প্রবীনদের মধ্যে সৌহার্দ্যতা, জ্ঞ্যানী-গুনী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, পূজা পার্বন, ইত্যাদির মাধ্যমে চাকরা সাংগ্রাই পালন করে।

বর্ষবিদায় ও নববর্ষের অনুষ্ঠান খুমী সম্প্রদায় পহেলা বৈশাখে করে থাকে। এইদিন তারা নিজেদের মতো করে পাহাড়ি ফুল দিয়ে সাজেন।

বম, লুসাই ও পাংখোয়া সম্প্রদায় বৈসাবি উৎসব পালন করে না। পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিষ্টান মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরিত হয়ে এই পিছিয়ে পড়া তিনটি সম্প্রদায় হারিয়ে ফেলেছে তাদের আদি ঐতিহ্য। তারা ইংরেজি বছরের প্রথম দিন ও শেষ দিন আনন্দের সাথে পালন করে। এছাড়া পালন করে ২৫ ডিসেম্বরের ক্রিসমাস। 

 

 

প্রত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও তিন পার্বত্য জেলায় পালিত হতে যাচ্ছে বাংলা নববর্ষবরন উৎসব বৈসাবি। আগামী ১২, ১৩, ১৪ এপ্রিল থেকে তিন জেলা জুড়ে পালিত হবে এই উৎসব। ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে। কেনাকাটা চলছে জোরেশোরে। ব্যাস্ত সময় পার করছেন ঘরের কর্তারা। বাড়ির দিকে ছুট লাগিয়েছেন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে থাকা পাহাড়ি চাকুরীজীবী ও ছাত্ররা।

 

বাংলা নতুন বছরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বর্ষবরন উৎসব ভিন্ন নামে বা ভিন্ন ব্যাপ্তিকাল সহ পালিত হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপক। বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব কালের আবর্তনে রঙ পাল্টালেও, এখনও প্রায় আগের নিয়মে পালিত হয় পাহাড়িদের উৎসবগুলো। তবে রঙ পাল্টিয়েছে কিছুটা হলেও। কর প্রদানের একটি উৎসব কালের আবর্তনে পরিণত হয়েছে জাতিগোষ্ঠীসমূহের বৃহত্তম সামাজিক উৎসবে। পুরোতন যত অমঙ্গল আর অশুভ, সব ধুয়ে মুছে যাক, বেড়ে উঠুক বৈসাবির অনুভব। সকলকে বৈসাবির শুভেচ্ছা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন