পাহাড় নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রের নতুন খেলা শুরুর ইঙ্গিত মিলছে। ষড়যন্ত্রের এ নীলনক্সা হয়েছে পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের সংগ্রাম বাদ দিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবির আন্দোলনে চার গ্রুপই সম্পৃক্ত হওয়া। এই চার গ্রুপ হচ্ছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এর বিভক্ত দুই গ্রুপ ও ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর বিভক্ত দু’গ্রুপ। ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির পর শান্তি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় থেকে এর বিরোধিতায় নামে জেএসএস প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সেকেন্ড ইন কমান্ড খ্যাত প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন জেএসএস- এরই বিদ্রোহী একটি অংশ। এ প্রক্রিয়ায় প্রসীতের নেতৃত্বে জন্ম নেয় সন্তুবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ।

দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফ নেতৃত্বের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উপগ্রুপে বিভক্তির মাধ্যমে দুটি করে চার গ্রুপে পরিণত হওয়ার ঘটনাটি ঘটে। তবে দুটি সংগঠনের মূল গ্রুপ রয়েছে পৃথকভাবে সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসার নেতৃত্বে। এই দুই গ্রুপের ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে অসংখ্য তরতাজা প্রাণ ঝরে গেছে। সঙ্গে আরও প্রাণ গেছে পাহাড়ে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি সেনা সদস্যদেরও।

বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে গোপন এক সমঝোতা হয়েছে বলে চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। পাহাড়ের বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে এই সমঝোতা দেশে নয়, হয়েছে দেশের বাইরে। কারও মতে এ সমঝোতা হয়েছে প্রতিবেশী একটি দেশের কোন এক স্থানে। আবার কারও মতে এটা হয়েছে ইউরোপের একটি দেশে। জেএসএস ও ইউপিডিএফের বিভক্ত গ্রুপের সদস্যদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠেছে কিসের এ সমঝোতা। এমন প্রশ্নের উত্তরে বেরিয়ে এসেছে জেএসএস, ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের যে দাবি তারা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে এর বদলে পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া।

এ বিষয়টি নিয়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর মূল নেতৃত্বের কোন সূত্রই মুখ খোলেনি। এদের ক্যাডার পর্যায়ে বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত। তবে সমঝোতার প্রশ্নে জেএসএস-এর বিভক্ত লারমা গ্রুপ এবং ইউপিডিএফ-এর বিভক্ত সংস্কার গ্রুপের নেতাদের মাঝে নানা প্রশ্ন জেগেছে। জেএসএস-এর অনেকের মতে জেএসএস যখন পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করেছে তখন প্রসীত খীসা কেন বিরোধিতায় নেমে পরবর্তীতে বিরোধী গ্রুপ অর্থাৎ চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ-এর জন্ম দিয়েছে। পক্ষান্তরে ইউপিডিএফ-এর অভ্যন্তরেও প্রশ্ন উঠেছে সন্তু লারমা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে পাহাড়ীদের স্বার্থের জলাঞ্জলি দিয়ে বছরের পর বছর ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ চালিয়ে এখন তাদের দু’জনের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি ধোপে টিকে না।

এ বিষয়ে পাহাড়ের দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর শীর্ষ কয়েক নেতার মধ্যস্থতায় সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসার মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। আর এ সমঝোতার মূল লক্ষ্য বর্তমান সরকার থেকে তাদের দীর্ঘদিনের স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যের কাতারে আসা। সাম্প্রতিক সময়ে অদৃশ্য এ সমঝোতার বিষয়টির ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে বিভিন্নভাবে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস বেশ কিছু সময় ধরে এক ধরনের নীরব ভূমিকায় রয়েছে। সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন ঘটনায় দৃশ্যমান অবস্থায় রয়েছে ইউপিডিএফ। আর সমঝোতা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে দুই গ্রুপে যারা ভূমিকা রেখেছে তারা এখন জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর বিভক্ত গ্রুপের নেতা ও সদস্যদের ঐক্যের কাতারে আনার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

পাহাড়ের সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, সন্তু লারমা ও প্রসীত খীসার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাজনৈতিক সহিংসতার পথ নয়, অহিংসার পথে ঐক্য গড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক সময়ের গুরু ও শিষ্যের মধ্যে এ সমঝোতা হয়েছে এবং সমঝোতা অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ হয়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর সকল নেতাকর্মী স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের কর্মকা- চালিয়ে যাবে। এদিকে, বিগত দিনের সংঘাত, দ্বন্দ্ব, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্য হানাহানি, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি অনেকটাই কমে আসায় সমঝোতা যে সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়টি অনেকটাই এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, এর আগেও জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় নিবার্চনসহ নানা ইস্যুতে কয়েক দফায় গুরু-শিষ্যের সাংগঠনিক সমঝোতা, যুদ্ধবিরতি হলেও এবারের সমঝোতা দীর্ঘমেয়াদী এবং দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় গুরু-শিষ্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে দূরে সরে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে একাট্টা হয়েছে বলেই তথ্য মিলেছে। যার ফলে সরকার ও শান্তিচুক্তির পক্ষীয় দল জেএসএস’র মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে শান্তিচুক্তি অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নে তেমন ফলপ্রসূতা আসবে না বলে প্রতীয়মান। বিদেশের মাটিতে পর্দার আড়ালে চলা, রহস্যেঘেরা গুরু-শিষ্যের এমন গোপন সমঝোতা বৈঠকের ফলে পাল্টে যেতে পারে পার্বত্যাঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনীতির ভবিষ্যত। ঘটতে পারে ভিন্ন মেরুকরণ।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭৪ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াই চালাচ্ছে জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস। ১৯৭৬ সালে বরকলে টহল পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ। এর আগে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে পাহাড়ীদের জমি কেড়ে নেয়া এবং নানা নির্যাতন করার রীতি শুরু হয়। ওই সময় থেকে পাহাড়ীদের ধারণা ছিল, পার্বত্য এলাকা ভারত ও বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে। সে কারণে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা এবং বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলন হয়। সেই সময়ে পাকিস্তানীরা বাঙালীদের সঙ্গে পাহাড়ীদের বিরোধ সৃষ্টির কৌশল নেয়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালে পাহাড়ীদের দাবি ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব আইন পরিষদ, হিল ট্র্যাক্ট ম্যানুয়েল এ্যাক্ট পুনর্প্রতিষ্ঠা ও রাজা তথা সার্কেল চীফদের দফতর সংরক্ষণ। কিন্তু পাহাড়ীদের এ দাবি গৃহীত হয়নি তৎসময়ের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে। তদুপরি, পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ অবধি একই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সার্কেল চীফের ব্যানারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজার শাসন চলমান রয়েছে।

পাহাড়ীদের এসব দাবি সংবিধান কমিটি হতে প্রত্যাখ্রাত হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ পাহাড়ী নেতাদের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির গভীর জঙ্গলে জনসংহতি সমিতির ব্যানারে শান্তিবাহিনী গঠিত হয়। ১৯৭৫-১৯৭৭ সালে এই শান্তিবাহিনী সামরিক কায়দায় প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ঘাঁটি গড়ে তোলে শান্তিবাহিনী। ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীর একটি বহরে হামলা চালায় শান্তিবাহিনীর গেরিলা সদস্যরা।

সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, জেএসএস, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন