ফলজ ও বনজ বাগানেই লাখপতি পানছড়ির মংশী মারমা
শাহজাহান কবির সাজু, পানছড়ি প্রতিনিধি:
খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলায় ফলজ ও বনজ বাগান সৃজনের মাধ্যমেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মংশী মারমা। এই বাগান গড়ার কারিগর মংশী উপজেলার ৪নং লতিবান ইউপির কংচাইরী পাড়া গ্রামের মৃত মংচাই মার্মা ও নাইক্রই মার্মার গর্বিত সন্তান।
১৯৬৯-৭০ সালে অষ্টম শ্রেণী পাশ করা মংশী মারমার বর্তমান বয়স প্রায় ৬৩ বছর। কৃষিই তার একমাত্র পেশা ও নেশা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সাহস, মনোবল আর কায়িক শ্রমের মাধ্যমেই বাগান সৃজন শুরু করে ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে। সেগুন, গর্জন, বাঁশসহ বিভিন্ন ফলজ বাগানের মাধ্যমেই শুরু হয় তার কৃষি যুদ্ধ। বর্তমানে পানছড়ি উপজেলা তথা জেলায় আম্রপালি বাগানের মাঝে সেরা বাগানের খ্যাতি আসবে কংচাইরী পাড়ার মংশী বাগানগুলোই। যার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সারিবদ্ধতার দৃশ্য এক নজর দেখা মাত্রই চোখ জুড়াবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কংচ্ইারী পাড়ার গহীন অরণ্যের মাঝে এক মনোমুগ্ধকর ও প্রাণবন্ত এলাকা জুড়ে গাছে বাদুর ঝুলা আছে বিভিন্ন জাতের আম। বাগান মালিক মংশী মারমা চিনিয়ে দিলেন আম্রপালি, মল্লিকা, গোপাল ভোগ, রাঙ্গোয়াই জাতের আম। বিশালাকার বাগানে আম ঝুলার দৃশ্য মন মাতিয়ে তোলে। মংশী জানালেন ৩টি বাগানে ৭৫০টি গাছ এবার ফল দিয়েছে। মুকুল থেকে ফল হওয়ার সাথে সাথে অগ্রিম বাগান বিক্রি করেছেন সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। গত বছর বিক্রি হয়েছিল আড়াই লক্ষ টাকা। ১৯৯০-৯১ সালে বাগান সৃজন করে ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছরই ফলন পাচ্ছে বলে জানান। বর্তমানে আরো একটি নতুন বাগান সৃজন করেছেন যাতে রয়েছে প্রায় ৭শতাধিক আম্রপালিসহ নানা জাতের আম।
আম ছাড়াও রয়েছে সেগুন, গর্জন, রাবার ও বাঁশ বাগান। এ পর্যন্ত সেগুন বাগান বিক্রি করেছেন ৩বার। প্রথমবার ৮ লক্ষ, ২য় বার ১৭ লক্ষ ও ৩য় বার ১০ লক্ষ। বাঁশ বাগানেও রয়েছে হাজার হাজার বাঁশের সারি। প্রতি দুই বছর পর পরই বিক্রি করেন বিভিন্ন সাইজের বাঁশ। গত ছয় বছরে বাঁশ বিক্রি করেছেন প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকার। বর্তমানে মংশী মারমার ফলজ ও বনজ বাগানের পরিমাণ ৫৫ একর, ধান্য জমি ৭ একর, নিজ বাড়ি ১ একর ও যৌথ অংশীদারে রয়েছে ৭০ একর জমির উপর রাবার বাগান যেখানে রয়েছে ১৯ হাজার রাবার গাছ। এসব বাগান্ শ্রমিকদের সাথে নিজেও করেন কঠোর পরিশ্রম। আর এই পরিশ্রমের ফলেই এসব বাগান থেকে বর্তমানে গড়ে তার মাসিক আয় হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা।
এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে জানা যায়, মংশী মারমা এলাকার একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক। তিনি অনেক ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার একজন মূল রূপকারও। ১৯৯৪ সালে ভাইবোনছড়া মিলিনিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ১ একর নিজ নামীয় জায়গা বিনামূল্যে দান করেন। এবং ঐ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এলাকার বিভিন্ন গরীবদের মাঝে ঘর সংস্কারের জন্য দু’এক বছর পরপর নিজ বাগানের দু’আড়াই হাজার বাঁশ বিতরণ, বান্দরবানের অনাথ আশ্রমে প্রতি বছর দানসহ এলাকার ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দান করেন উদার হস্তে।
মংশী মারমার সাথে আলাপকালে তিনি জানান, ১৯৮১ সাল থেকে অদ্যবধি পর্যন্ত বাগান সৃজনের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য কয়েকবার প্রস্তাব আসলেও তা প্রত্যাখান করেছেন। এলাকার জনগণের দু:খ-দুর্দশার কথা শুনলেই তিনি এগিয়ে যান এবং এসব দূরীকরণের মাধ্যমেই নিজের আত্মতৃপ্তি ও সন্তুষ্টি অনুভব করেন।
পানছড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার মো: আলাউদ্দিন শেখ জানান, মংশী মারমার বাগান তিনি ৩/৪ বার পরিদর্শন করেছেন। এই ধরণের একটি পরিকল্পিত ও সু-শৃঙ্খল বাগানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি জানান, পাক্ষিক ভ্রমণসূচীর আওতায় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সব সময় বাগানের তদারকী করছে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শও প্রদান করা হচ্ছে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দিবস চাকমা জানান, মংশী মারমা একজন পবিপূর্ণ কৃষক। একজন আদর্শ কৃষকের মাঝে যেসব গুণাবলী থাকা দরকার সবই তার মাঝে বিদ্যমান। এ বয়সেও তার শেখার প্রতি প্রচুর আগ্রহ। কৃষি বিষয়ক কোন নতুন পরামর্শ পেলেই তিনি সে প্রযুক্তি কাজে লাগান। তাছাড়া বিভিন্ন পুরষ্কারের পাশাপাশি তিনি বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরষ্কারের জন্যও কয়েকবার মনোনীত হয়েছেন।