বঙ্গোপসাগরের সামগ্রিক শান্তি ও স্থিতিশীলতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

fec-image

কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট আর্মি (কেএনএফএ) ১০০% খ্রিস্টান। মায়ানমারে এবং সীমান্তের ভারতে একই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন গ্রুপ রয়েছে। একই এলাকায় অবস্থানরত প্রায় ১০০% মুসলিম রোহিঙ্গারা। যদি একটি ধর্মীয় রেসিপি প্রবেশ করে, এটি একটি নতুন প্যান্ডোরার বাক্স খুলবে।

সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন ও অন্যান্য স্থলযুদ্ধগুলো আমাদের সমুদ্র এবং উপকূলরেখার গুরুত্বকে অস্পষ্ট করে দিয়েছে যেখানে বেশিরভাগ বাণিজ্য পরিচালিত হয়, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ বাস করে এবং যেখানে অতীতের মতো ভবিষ্যতে আরও অর্থনৈতিক ও সামরিক কার্যকলাপ সংঘটিত হবে। এই ধারাবাহিকতায়, ৩৭টি দেশ দ্বারা বেষ্টিত ভারত মহাসাগরের চেয়ে সাধারণভাবে কোন মহাসাগরেরই কৌশলগত স্থিতিশীলতার এত প্রয়োজন নেই। উল্লেখ্য,  এই ৩৭টি দেশে বিশ্বের ১/৩ জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে তরুণ। এটি ২১ শতকের জনসংখ্যাগত এবং কৌশলগত কেন্দ্র। বিশেষ করে, বঙ্গোপসাগরের বৃহত্তর স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, কারণ এটি সার্ক এবং আসিয়ানের সংযোগস্থলে এবং বিমসটেকের সাথেও পারস্পরিকভাবে বেষ্টিত। বঙ্গোপসাগরে অস্থিতিশীলতা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উভয়কেই প্রভাবিত করবে। এই অংশের দেশগুলির প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলি হল স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তাদের জনগণের জন্য উন্নত জীবন। যেকোনো অস্থিতিশীলতা বা স্থিতিশীলতার হুমকি রাজনৈতিক লক্ষ্যে মারাত্মকভাবে বাধা সৃষ্টি করবে।

ইতিমধ্যে, বঙ্গোপসাগর ভূ-রাজনৈতিকভাবে দুটি আঞ্চলিক এবং সম্ভাব্য বিশ্বশক্তির মাধ্যমে অস্থির হয়ে উঠছে, যেখানে চীন মিয়ানমারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মাধ্যমে তার জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষা করতে চায়। চীনের প্রায় ১৪% শক্তি মিয়ানমারের মাধ্যমে পরিবহণ করা হয়, যেখানে চীন জ্বালানি অবকাঠামোর জন্য বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। ভারত বঙ্গোপসাগরের (কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট) মাধ্যমে আংশিকভাবে তার পূর্ব রাজ্যগুলির সাথে সংযোগ স্থাপনে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এই উদ্যোগগুলি বঙ্গোপসাগরে কোয়াড (ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান) এবং চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার দ্বারা গুরুতরভাবে প্রভাবিত হবে। এগুলি ছাড়াও, এই এলাকার যে কোনও সংঘাত রাজনীতিকীকরণ হবে ভূ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে, যা অবধারিতভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।  অন্য ইস্যুটি হল, এখানকার উপকূলবর্তী দেশগুলিতে যে কোনও ধরণের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে পরিচালিত ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইতিহাসে আছে যে অতীতে বিশ্ব অর্থনীতির ৬০% ছিল ভারত ও চীন। এটি ছিল শান্তিপূর্ণ ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরের অবদান। এটি নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে, শান্তিপূর্ণ বঙ্গোপসাগর উভয় আঞ্চলিক শক্তি এবং সমস্ত উপকূলীয় রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রয়োজন। বঙ্গোপসাগরে অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের জন্য উন্নত দেশে পরিণত হওয়া কঠিন করে তুলবে। একইভাবে, ভারত মহাসাগরে অস্থিতিশীলতার কারণে পশ্চিম থেকে পূর্বে ধীরে ধীরে ক্ষমতার স্থানান্তর ধীর গতির হয়ে যাবে।

তাহলে কীভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একটি ভূ-রাজনৈতিক উদ্যোগের সাথে যুক্ত? অনেক বিষয়ের পাশাপাশি, এই বিশেষ সমস্যাটি বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের সাথেও যুক্ত হয়েছে। বৈশ্বিক মঞ্চে চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে যেখানে পশ্চিমাদের অবস্থান ভিন্ন। যদিও আঞ্চলিক পর্যায়ে, চীন এবং ভারত উভয়ই মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে, যা ভূ-কৌশলগত উদ্দেশ্যেও। তবে, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মিয়ানমারের জান্তা আরও বেশি করে চীনের পক্ষপুটে প্রবেশ করায় ভবিষ্যত ভিন্ন হতে পারে।

স্থানীয় পর্যায়ে, গতিশীলতা একটু ভিন্ন। জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন পর্যায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে চায়। তবে, ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ইউএলএ) এবং আরাকান আর্মির (এএ) অভ্যন্তরীণ রাজনীতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অতটা স্বাগত জানাচ্ছে না। এএ বেশ শক্তিশালী এবং রাখাইনের ৬০%-৭০% নিয়ন্ত্রণ করে (যেখানে শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ফিরে আসবে), কিন্তু তাদের শক্তির উৎস চীন। তাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পূর্ণভাবে এএ-র একার ওপর নির্ভর করে না। জান্তা রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে এবং তাদের ফিরিয়ে নেয়া জেনারেল মিন অং হ্লার মানসিকতার সাথে যায় না, যদিও আমরা চীনা মধ্যস্থতায় প্রত্যাবাসন উদ্যোগের কিছু নাটক লক্ষ্য করি। চীন বাংলাদেশকে ইঙ্গিত দিতে চায়,, নাটাই কার হাতে। বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যু সমাধান করতে চায় তাহলে চীনের প্রয়োজন। তবে বৃহৎ দৃষ্টিতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ভারতের দিকে ঝুঁকে থাকা বাংলাদেশকে বাধ্যগত পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে ত্রি-সীমান্ত অঞ্চলে (বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার) অবস্থান করছে। এটি দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা। এই তিন দেশের কয়েক ডজন বিদ্রোহী/বিচ্ছিন্নতাবাদী দল সেখানে কাজ করছে। কোনো সরকারই তাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বৈরী সীমানা, দুর্গম ভূখণ্ড, যোগাযোগের অভাব, প্রশাসনের জনসংখ্যার প্রতি বন্ধুহীন/উদাসীনতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড/কর্মসংস্থানের অভাব এখানে বন্দুক সংস্কৃতি বিরাজ করার কয়েকটি কারণ। আগে, পপি এবং মারিজুয়ানার মতো মাদক চাষ এই গোষ্ঠীর জন্য অর্থকরী ফসল ছিল, এখন অ্যামফিটামিন টাইপ স্টিমুল্যান্ট (এটিএস) উৎপাদন প্রায় সব সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্পদের প্রধান উৎস। তবে, অল্প জনবসতি হওয়ায় এলাকায় নিয়োগ সরবরাহ সীমিত ছিল।

এখন ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে, যাদের মধ্যে ৪ লাখ শিশু এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক। ২০৩০ সালের মধ্যে, তাদের বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক হবে। সঠিক শিক্ষা, আশা এবং স্বপ্ন ছাড়া, তারা অস্থির পরিবেশের ঘূর্ণিপাকে টার্গেট গ্রুপের শিকার হবে। বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে এই শিশুদের মানসিক আঘাত আছে; তারা তাদের জীবনের ভয়াবহতা অনুভব করেছে, এবং অনেকে তাদের মাকে ধর্ষিতাহতে দেখেছে। মনে আঘাত এবং অন্তরে ঘৃণা নিয়ে, শোষিত হলে তারা কীসে পরিণত হতে পারে, কেবল সময়ই বলতে পারে। সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন ছাত্র হিসেবে, আমি বলতে পারি, এটা একটা ‘টিকিং টাইম বোমা’। তাহলে এটা বাংলাদেশের একার সমস্যা হবে না; এর আঞ্চলিক, এমনকি বৈশ্বিক প্রভাবও থাকবে। এছাড়া, আমরা দেখতে পাব অপ্রচলিত নিরাপত্তা বিষয়গুলো, যেমন, এই অঞ্চলে মাদকের বিস্তার দ্রুতগতিতে, অস্ত্র চোরাচালান, নৌকায় মানব পাচার, সমুদ্র ডাকাতি/দস্যুতা দেখা দিতে পারে, যা বঙ্গোপসাগরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনিরাপদ এবং ব্যয়বহুল করে তুলবে, যা তাদের কৌশলগত লক্ষ্যসহ উভয় আঞ্চলিক শক্তিকে সমানভাবে প্রভাবিত করবে। সময়ের সাথে সাথে, হতাশার একটি পর্যায় আসতে পারে যেখানে রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী উপস্থিত হবে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এমন কর্মকাণ্ড চালাবে যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা ঐতিহ্যগত নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। প্রথাগত এবং অপ্রচলিত উভয় হুমকির পরিস্থিতিতে বঙ্গোপসাগরের শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে আরও একটি মাত্রা রয়েছে যার একটি ধর্মীয় অর্থ থাকতে পারে। কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট আর্মি (কেএনএফএ) ১০০% খ্রিস্টান। মায়ানমারে এবং সীমান্তের ভারতে একই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন গ্রুপ রয়েছে। একই এলাকায় অবস্থানরত প্রায় ১০০% মুসলিম রোহিঙ্গারা। যদি একটি ধর্মীয় রেসিপি প্রবেশ করে, এটি একটি নতুন প্যান্ডোরার বাক্স খুলবে। যাইহোক, এখনই মন্তব্য করা, প্রস্তাব দেওয়া বা ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব তাড়াতাড়ি হবে।

আমাদের দক্ষিণ-পূর্বে পরিস্থিতি কতটা বিশৃঙ্খল, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের সাথে, এটি বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের বড় এবং ছোট দেশগুলির জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলবে এবং এমনকি আমাদের শান্তি, স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং আমাদের জনগণের জন্য উন্নত জীবনকে একটি দূরবর্তী বাস্তবতা করে তুলবে। সুতরাং, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের বাড়িতে মর্যাদার সাথে দ্রুত টেকসই প্রত্যাবাসন সবার জন্য ভাল হবে।

♦ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড. মো. মাহফুজুর রহমান: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সাবেক প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন