বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে হঠাৎ করেই তুরস্কের বিপ অ্যাপ ডাউনলোডের হিড়িক

fec-image

প্রযুক্তির জগতে অনেকটা হঠাৎ করেই আলোড়ন তুলেছে তুরস্কে তৈরি একটি ভিডিও কলিং ও মেসেজিং অ্যাপ, যার নাম ‘বিপ’।

বিভিন্ন তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে তুরস্কের এই অ্যাপ এখন অনেকে দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে বাংলাদেশে এই অ্যাপের জনপ্রিয়তা সবাইকে ছাড়িয়েছে।

গুগল প্লে স্টোর থেকে বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের অ্যাপ ডাউনলোডের র‍্যাংকিং বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে যে বিপের ডাউনলোড মাত্র একদিনের ব্যবধানে ৯২ ধাপ এগিয়ে সবার শীর্ষে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়তার একেবারে উপরের দিকে থাকা ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক লাইট-এর মতো অ্যাপগুলোকে পেছনে ফেলে তালিকার এক নম্বরে রয়েছে তুরস্কের মেসেজিং অ্যাপ বিপ।

সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপ জানিয়েছে যে ব্যবহারকারীদের কিছু তথ্য তারা তাদেরই সহযোগী কোম্পানির সঙ্গে শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে হোয়াটসঅ্যাপে আদান-প্রদান করা বার্তা এবং তথ্যের গোপনীয়তা বজায় থাকবে কি না – তা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়।

মোবাইল ডেটা বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপ অ্যানি’ জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন সবার শীর্ষে রয়েছে তুরস্কের অ্যাপ বিপ।

বিপ অ্যাপ কী?

বিপ অ্যাপ-এর তরফ থেকে যে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে, সেখানে তাদের পক্ষ থেকে গোপনীয়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে।

বলা হয়েছে, এটি এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপটেড, অর্থাৎ ভয়েস কল এবং মেসেজ আদান-প্রদান গোপন থাকবে এবং এটি কেউ হ্যাক করতে পারবে না।

এই অ্যাপ অনেকটা হোয়াটসঅ্যাপ-সহ অন্যান্য ভিডিও কলিং ও মেসেজিং অ্যাপের মতো করেই কাজ করে।

আইওএস চালিত আইফোন এবং অ্যান্ড্রয়েড চালিত মোবাইল ফোনে এই অ্যাপ ডাউনলোড করা যায়। এছাড়া ডেস্কটপেও ব্যবহার করা যায় এই অ্যাপ।

তুরস্কের গণমাধ্যমের খবর বলা হচ্ছে যে মোবাইল ফোন কোম্পানি টার্কসেল বিপ অ্যাপ উদ্ভাবন করে ২০১৩ সালে। বিশ্বের ১৯২টি দেশে এই অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগই ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

সাম্প্রতিক সময়ের আগে পর্যন্ত বিপ অ্যাপ সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হয়েছে জার্মানিতে এবং সেখানে এর ব্যবহারও বেশি হয়। এছাড়া, ফ্রান্স এবং ইউক্রেনেও বহু মানুষ বিপ অ্যাপ ডাউনলোড করেছে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

বর্তমানে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিপ অ্যাপ-এর দারুণ চাহিদা তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন টার্কসেল-এর ওই কর্মকর্তারা।

গোপনীয়তা কতটা?

এই অ্যাপের মাধ্যমে অডিও-ভিডিও কল, মেসেজ, ছবি এবং ভিডিও আদান-প্রদান করা যায়।

অ্যাপ কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, এখানে সিক্রেট চ্যাট করার ব্যবস্থাও রয়েছে। কোন ব্যবহারকারী যদি নির্দিষ্ট সময় পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেসেজ মুছে দিতে চান, তাহলে সে অনুযায়ী সময় সেট করা যাবে।

তুরস্কের পত্রিকা ডেইলি সাবাহ জানিয়েছে, হোয়াটসঅ্যাপ প্রাইভেসি পলিসি পরিবর্তন করার কথা ঘোষণা করার পর থেকে প্রতিদিন ২০ লাখ বার ডাউনলোড হয়েছে বিপ।

এখন পর্যন্ত সর্বমোট এই অ্যাপ ডাউনলোড হয়েছে ছয় কোটি বার। অচিরেই এই অ্যাপ ডাউনলোড ১০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন টার্কসেল-এর কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যকার সাম্প্রতিক উষ্ণ সম্পর্ক যে বার্তা দিচ্ছে

টার্কসেল-এর জেনারেল ম্যানেজার মুরাত এরকান ডেইলি সাবাহকে জানিয়েছেন যে গত এক সপ্তাহে বিপ অ্যাপ ডাউনলোড হয়েছে ৬৪ লক্ষ বার।

তিনি বলেন, জন্যপ্রিয় এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীরা ‘গোপনীয়তার স্বর্গ’ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

এই অ্যাপটির গোপনীয়তাকে ব্যাংকের ভল্ট-এর সাথে তুলনা করে মি. এরকান বলেন, “আমরা ব্যবহারকারীদের তথ্যগুলো এনক্রিপটেড ভল্ট-এ রাখি। শুধু ব্যবহারকারীরাই এটি খুলতে পারে। আমরা কিছুই দেখতে পাই না।”

তুরস্কের আরেকটি সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের যোগাযোগ দপ্তর এবং দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হোয়াটসঅ্যাপ-এর নতুন প্রাইভেসি পলিসি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

এতে যোগাযোগের গোপনীয়তা থাকবে না বলে তাদের সন্দেহ এবং সেজন্যই তারা হোয়াটসঅ্যাপ বাদ দিয়ে বিপ অ্যাপ ব্যবহার করা শুরু করবে বলে আরও জানাচ্ছে সংবাদমাধ্যমটি।

বাংলাদেশে কেন বিপ অ্যাপ ডাউনলোড হচ্ছে?

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে যত মোবাইল সেট ব্যবহার করা হয়, তার শতকরা ২৫ শতাংশই স্মার্ট ফোন, অর্থাৎ এই ফোনে ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করা যায় – এই তথ্য জানাচ্ছেন বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের মনিরুল বাশার।

জার্মানির হামবুর্গ -ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিসটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের বিষয়ে নানা পরিসংখ্যান জোগাড় এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে। ওই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে যত মানুষ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেছে তার প্রায় আড়াই শতাংশ আইফোন ব্যবহারকারী ছিল।

এর মানে হলো, বাংলাদেশের সিংহভাগ স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীই এমন সেট ব্যবহার করেন, যেগুলো অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে চালানো হয়।

আর অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীরা গুগল প্লে স্টোর থেকে বিভিন্ন অ্যাপ ডাউনলোড করেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ গত দু’একদিনে বিপ অ্যাপটি ডাউনলোড করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের শিক্ষক মইনুল হোসেন বিবিসি বলেন, অনেক মানুষ বিপ অ্যাপ-এর প্রতি ঝুঁকলেও সেটি হোয়াটসঅ্যাপকে চ্যালেঞ্জ করার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি করতে পারেনি।

“পুরো বিশ্বে হোয়াটসঅ্যাপ ডাউনলোড হয়েছে কমবেশি ২০০ কোটি। অন্যদিকে বিপ অ্যাপ টার্গেট করেছে আগামী কিছুদিনের মধ্যে ১০ কোটি পূর্ণ করবে। সুতরাং বিপ অ্যাপ ধারেকাছেও নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. হোসেন।

তিনি মনে করেন যে বিপ অ্যাপের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ প্রাইভেসি নিয়ে আগের তুলনায় বেশি সচেতন। বাংলাদেশেও অনেক ব্যবহারকারী প্রাইভেসিকে গুরুত্ব দেন। সেজন্য অনেকে বিপ অ্যাপ ডাউনলোড করে থাকতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের অফিস যখন হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে বিপ ব্যবহারের ঘোষণা দিলো, তখন এর একটি প্রভাব পড়েছে বলে উল্লেখ করেন এই বিশ্লেষক।

মইনুল হোসেন বলেন, তুরস্ক যেহেতু একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ, তাই সেদেশের একটি অ্যাপ-এর প্রতি অনেকের একটি আগ্রহ থাকতে পারে। তবে ধর্মীয় কারণে এটি হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা কঠিন বলে মনে করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন