বাঘাইছড়িতে পাহাড়ি এলাকায় পানিসংকট মানুষের দুর্ভোগ চরমে
সালাউদ্দিন শাহিন, বাঘাইছড়ি:
রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পাঁচশতাধিক গ্রামে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অপরিকল্পিক জুম চাষ ও বন উজাড়, ছড়া ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় এঅবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সাজেকসহ দুর্গম এলাকায় পাঁচশতাধিক গ্রামে অর্ধলক্ষাধিক বেশি লোকের বসবাস। এ সব লোকজন যুগ যুগ ধরে ঝরনা, ছড়া ও ঝিরি থেকে পানি ব্যবহার করে জীবন-যাপন করে আসছেন। অব্যাহত বৃক্ষ নিধনের ও বৃষ্টি কম হওয়ার ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এতে শুস্ক মৌসুমের ওই সব গ্রামগুলোতে তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দুই-থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গিয়েও পানি মিলছে না। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে বসবাস করে আসলেও পানির অভাবে এখন বেশ কয়েকটি গ্রাম ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছে বলে জানা গেছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাঘাইছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পাঁচ শতাধিক গ্রাম রয়েছে। এসব গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক লোকের বসবাস। গড়ে উঠা গ্রামগুলো সমতল এলাকা চেয়ে এক থেকে দুই হাজার ফুট উপরে। সেখানে নলকূপ কিংবা রিংওয়েল বসানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ লোকজন বড় বড় পাহাড়ের ওপরে বসবাস করেন। তাঁদের একমাত্র পানির উৎস ঝরনা,ছড়া ও ঝিরি। সম্প্রতি সংরক্ষিত বন উজাড় হওয়ায় এখন আর আগের মত পানি মিলছে না। ফলে পানির অভাব দিন দিন তীব্র হচ্ছে বলে জানা গেছে।
গ্রামবাসী জানান, অন্যান্য বছর এপ্রিল মাসে পানি সংকট থাকে বেশি। কিন্তু এবছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পানি পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের বেশি দূরে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ঝরনা ও ছড়াগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় ছোট ছোট পাথরের কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে কোনো রকমে পানি পাওয়া গেছেও সেগুলো পানে অনুপযোগী। পানি না পেয়ে বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করছেন অনেকেই। এতে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন গ্রামে ডায়রিয়াসহ পানিবাহীত রোগ। পানি সংকট সমাধান করা না গেলে পানিবাহীত রোগে মহামারি আকার ধারণ করবে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বড় বড় টিলার ওপর গ্রামগুলো। এক গ্রামে ৩০ থেকে ৫০ পরিবার। গ্রামগুলোর আশপাশে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জুম চাষ ও বনদুস্যুরা গাছ কেটে সাবাড় করে ফেরেছেন। এতে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। নয় নম্বর পাড়া, আট নম্বর পাড়া শিয়ালদাই, হাচ্ছে পাড়া, অরুনপাড়া ও লংকরসহ চার থেকে পাঁচশতাধিক গ্রামে পানির জন্য হাহাকার বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
সাজেকের শিয়ালদাই গ্রামের কার্বরী ভুজন ত্রিপুরা ও লক্ষ্মী বালা চাকমা বলেন, গত বছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো পানির অভাব ছিল না। এবছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে পানি সংকট শুরু হয়। আজ থেকে আট থেকে দশ বছর আগে গ্রামের আশপাশের ছড়াগুলোতে সারা বছর পানি পাওয়া যেত। জুম চাষ ও বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় দিন দিন পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। বর্তমানে ওই সব ছড়া ও ঝরনা গুলো শুকিয়ে গেছে। যেসব পানি সংগ্রহ করা হচ্ছে সেই পানিও ব্যবহারের অনুপযোগী। এই পানি ব্যবহার করে অনেকে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সামনে আরও বয়াবহ হবে বলে তিনি জানান।
সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অতুলাল চাকমা বলেন, গত বছর এবং বছর কয়েকটি গ্রামে এলজিএসপির বরাদ্দ থেকে ছড়া ও ঝরনার পানি নির্দিষ্ট জায়গা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এখন আর আগেরমত ঝরনা ও ছড়ায় পানি নেই। সেকারণে পানির অভাব বেশি। বর্তমানে শত শত পরিবার পানির সংকটে রয়েছে। দিন দিন দুর্ভোগ বাড়ছে বলে তিনি জানান।
বাঘাইছড়ি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. আবদুল রাজ্জাক বলেন, অর্ধলক্ষাধিকেরও বেশি মানুষ পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করেন। সেখানে সমতল এলাকা চেয়ে এক থেকে দুই হাজার ফুট উপরে। সেখানে টিউবওয়েল কিংবা রিংওয়েল বসানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব গ্রামে পানি সরবরাহ করতে দাতা সংস্থা প্রয়োজন হবে। আগে বন ছিল এখন বন নেই পানিও নেই।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চৌধুরী বলেন, আমি সম্প্রতি সাজেকে গিয়ে পানির অভাব অনুভব করেছি। দুর্গম এলাকায় পানি ও স্যানেটিশনের বিষয়ে অস্ট্রোলিয়ায় প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ ছড়া মৃতপ্রায়। এতে পাহাড়ি এলাকায় দিন দিন পানি সংকট বাড়ছে বলে তিনি জানান।