বিজয় দিবস পালন করেনি পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো: কটুক্তি ফেসবুকে

বিজয় দিবস

মুজিবুর রহমান ভুইয়া :

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে এই বিজয় অর্জিত হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। সেকারণে ৪৩ বছর ধরে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বিপুল গাম্ভীর্য,  আনন্দ ও উৎসবের মাধ্যমে এই দিন পালন করে আসছে। সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন যথাসাধ্য ভাবমর্যাদার সাথে এ দিন পালন করে থাকে। তবে এর ব্যতিক্রম হচ্ছে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের নেতৃবৃন্দ। বিজয় দিবস পালিত হয় না সেখানে।

গত ১৬ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচরে পাহাড়ী কর্তৃক বাঙালীদের ফলন্ত ও কাঠের বাগান ধ্বংস এবং প্রতিবাদে পাহাড়ীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পাহাড়ী সংগঠনগুলো বাঙালীদের বিরুদ্ধে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এহেন সাম্প্রদায়িক হামলার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই পাহাড়ী সংগঠনগুলো নিজেরা কখনোই বাংলাদেশের বিজয় দিবস পালন করে না। এ বছরও তার অন্যথা হয়নি।

যদিও সারাদেশের ন্যায় পাহাড়ে ব্যাপক আয়োজন ও যথাযোগ্য মর্যাদার মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস পালিত হয়েছে। এজন্য দিনব্যাপী নানাকর্মসুচী পালন করা হয় সরকারীভাবে। পাহাড়ে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনগুলোও ব্যাপক উদ্দীপনার সাথে জাতীয় বিজয় দিবস পালন করেছে। এসব উৎসবে বাঙালীদের পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতির সাথে জড়িত বিপুল সংখ্যক উপজাতীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ উপজাতীয় জনতা অংশগ্রহণ করেছে। তবে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় বিজয় দিবস উপলক্ষে কোনো কর্মসূচী ছিল না।

অব্যাহত চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ও গুমসহনানা সহিংস রাজনৈতিক কর্মসুচী নিয়ে পাহাড়ের বিভিন্ন জনপদে নানা কর্মসূচী দেখা গেলেও মহান বিজয় দিবসের কোন কর্মসুচীতে দেখা যায়নি পাহাড়ের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠন চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ, চুক্তির পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস (সন্তু লারমা) এবং পুর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস (এমএন লারমা) সহ বিভিন্ন উপ-গ্রুপগুলোকে। এমনকি বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি ১৬ বছর ধরে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগকারী জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের বিজয় দিবসে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের স্বতন্ত্র কর্মসূচী ছিল না। এমনকি এসব কোনো সংগঠনই তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো নেতা বিজয় দিবসে শহীদ মিনারে পুস্পমাল্য অর্পন করেনি।

yyyy

শুধু বিজয় দিবস পালন না করাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকদের ফেসবুক আইডি ও তাদের পরিচালিত বিভিন্ন পেইজে বাংলাদেশের জাতীয় বিজয় দিবস নিয়ে কটুক্তি ও অশ্লীল গালিগালাজ করা হয় যা বর্ণণার অযোগ্য। এমনকি বিজয় দিবস বয়কট করার আহ্বান জানানো হয় এসব পেইজ ও আইডিগুলোতে।

মহান বিজয় দিবসের মতো একটি জাতীয় দিবসের কোন কর্মসুচী নিয়ে মাঠে না থাকায় এসব সংগঠনের দেশপ্রেম, দেশাত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পাহাড়ের সচেতনমহল। তাদের মতে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য, দেশপ্রেম, দেশাত্ববোধ নেই তাদের বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। তাদেরকে দেশের স্বাধীনতা বিরোধী দাবী করে সচেতন মহলটি জানতে চায় আসলে এ সংগঠনগুলো কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পাহাড়ে রাজনীতির নামে একের পর এক সহিংসতা করছে।

এ বিষয়ে নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক উপজাতীয় জনপ্রনিধি বলেন, আঞ্চলিক দলগুলো দেশের বা জনগণের স্বার্থে নয়, তারা তাদের নিজেদের স্বার্থেই বিভিন্ন সহিংস কর্মসুচী পালন করে থাকে। দেশ বা জনগনের প্রতি তাদের কোন ‘কমিটমেন্ট’ নেই। তাই বিজয় দিবসের মতো কোন কর্মসুচীতেও তারা শহীদ মিনার বা মাঠে নেই। তিনি আইন করে তাদের সহিংস রাজনীতি নিষিদ্ধ করারও দাবী জানান।

পানছড়ি

বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে কোন কর্মসুচীতে নেই কেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্গ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস’র (সন্তু লারমা) সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা যেকোন জাতীয় দিবসে জনসংহতি সমিতিরি অংশগ্রহণ থাকে দাবী করে পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমরা অনেক ভোরে শহীদ মিনারে যাই বলে আমাদেরকে কেউ দেখেনা। তবে বিজয় দিবসসহ সকল জাতীয় দিবসের প্রতি আমাদের সমান শ্রদ্ধা আছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস সরকারীভাবেই পালন করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের সেরকম ভুমিকা রাখার সুযোগ সীমিত বলে দাবী করেন জেএসএস’র এ নেতা। তবে তিনি বারবারই দাবী করে বলেন, লিডিং ভুমিকা না থাকলেও বিভিন্ন জাতীয় দিবসে জনসংহতি সমিতির অংশগ্রহণ থাকে।

এদিকে এ বিষয়ে জানার জন্য পাহাড়ের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠন চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ‘র কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের প্রধান নিরণ চাকমা’র মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও সংযোগ না পাওয়ায় তার কোন বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

বিজয় দিবস কোন দলীয় দিবস নয় এটা একটা জাতীয় দিবস, তাই বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসকে দলীয় কর্মসুচীতে নিয়ে আসা ঠিক হবেনা দাবী করে পুর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি-জেএসএস‘র (এমএন লারমা) খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক কিরণ চাকমা বলেন, বিজয় দিবস সকলের আনন্দের দিন। আমরা সকলেই দিবসটিকে যথাযোগ্যভাবে পালন করে থাকি।

বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সরকারী কর্মসুচীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দিবসটি নানা কর্মসুচীর মধ্য দিয়ে পালন করলেও জেএসএস (এমএন লারমা)সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনকে এরকম কোন কর্মসুচী পালন করেনি কেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা সরকারী সকল কর্মসুচীতে ছিলাম। জনসংহতি সমিতিকে আলাদা করে বিজয় দিবস পালন করতে হবে এমনটা ঠিক নয় বলেও দাবী করেন তিনি।

এসব দল বিজয় দিবসের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসের প্রাক্কালে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ির তরুনীপাড়া এলাকায় বাঙ্গালিদের প্রায় পনের একর আনারস বাগানের সাড়ে ৪ লাখ ফলন্ত আনারসের গাছ এবং একটি নতুন সেগুন বাগানের কয়েক হাজার সেগুন চারা কেটে ফেলে দেয় পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। আনারস বাগানের মালিক নুরুল ইসলাম, মো. আসাদ, কামাল হোসেন, জামাল হোসেন এবং সেগুন বাগানের মালিক আবছার মাস্টার বাগানে গিয়ে দেখতে পান নিজেদের বাগানের ধ্বংসাবশেষ। তাদের অভিযোগ পাশের গ্রাামের পাহাড়িরাই রাতের আঁধারে তাদের বাগানের গাছগুলো কেটে ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই আনারস ও সেগুন বাগান কেটে ফেলার ঘটনাকে ঘিরে কুতুকছড়ি ইউনিয়নের বগাছড়ি এলাকার বাঙালিদের মাঝে ব্যাপক আকারে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে পাহাড়ী সংগঠনগুলোর জাতীয় দিবস পালন না করা নিয়ে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন ভুইয়া টেলিফোনে পার্বত্যনিউজকে জানান, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পাহাড়ী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো ১৯৭১ সালের মতো এখনো বাঙালীদের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস মেনে নিতে পারেনি। তাই বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জাতির দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে, বিজয় দিবসকে কলঙ্কিত করতে পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, সমতলে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পতাকা না তুললে, জাতীয় সঙ্গীত না গাইলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু পাহাড়ী সংগঠনগুলো এবং তাদের নেতারা বছরের পর বছর জাতীয় বিজয় দবিসকে অবজ্ঞা করে যাচ্ছে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

সমঅধিকার আন্দোলনের মহাসচিব মনিরুজ্জামান মনির পার্বত্যনিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা নানিয়ারচর থেকে বাঙালী উচ্ছেদে পরিকল্পিতভাবে নানা অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। অতীতের একাধিকবার এখানে বাঙালী ফসল, সম্পদের উপর আঘাত হেনেছে পাহাড়ীরা। এ ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। এবারে তারা এরসাথে বিজয় দিবসের গৌরব মলিন করতে চেয়েছে। তারা নিজেরা কোথাও বিজয় দিবস পালন করে না। তাই বাঙালীর বিজয় দিবসকে বিতর্কিত করতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

তিনি বলেন, তারা বাঙালীর স্বাধীনতা মেনে না নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানী, ভারতীয় ও মিয়ানমারের পতাকা উড়িয়েছিল। এখনো তারা জুম্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী বলেই বাঙালীর জাতীয় বিজয় দিবস পালন করে না। নেতৃবৃন্দ এ ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালীদের চিকিৎসাসহ পুনর্বাসন সহায়তা দেয়ার দাবী জানিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, জেএসএস, পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন