“বাঙালিদের নিরাপত্তা ও জীবনধারণ রীতিমতো হুমকির মুখে”

রামগড়ে পাহাড়ি-বাঙালি ভূমিবিরোধ

fec-image

শান্তি চুক্তির পরবর্তী সময় থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩২ গ্রামের বাসিন্দারা প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় চাষাবাদ, বনজ ও ফলদবৃক্ষ রোপণ করে আসছেন। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে সন্ধ্যা হওয়ার আগে ওইসব এলাকা থেকে ফিরে আসতে হয়।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালি ভূমিবিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে। বাঙালিদের নামে সরকারি বরাদ্দকৃত বহু প্লট পাহাড়িরা দখল করে নেয়। বাঙালিদের নিরাপত্তা ও জীবনধারণ রীতিমতো হুমকির মুখে। উপজাতীয়দের থেকে ভূমি উদ্ধার এবং ভূমির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আবেদন জানিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন বাঙালিরা।

স্মারকলিপিতে বলা হয়- রামগড় উপজেলার তৈচালাপাড়া গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা বাটনা শিবির, তৈসাগাড়া, থানা চন্দ্রপাড়া এলাকায় ১৯৮০-৮১ সালে খাসজমিতে সরকার প্রদত্ত ৫.০০ একর করে টিলাভূমি বন্দোবস্ত পান। ওইসব এলাকার বসতবাড়ি এবং বাগ-বাগিচা সৃজনের মাধ্যমে এবং নিয়মিত সরকারকে ভূমির খাজনা পরিশোধ করে বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালে শান্তিবাহিনী ব্যাপক হারে বাঙালি গণহত্যা চালালে পুরো পাহাড়ি অঞ্চলে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎকালীন বিডিআর ক্যাম্পসংলগ্ন তৈচালা এলাকার গুচ্ছগ্রাম তৈরি করে। একই সাথে বিক্ষিপ্ত পাহাড়ি এলাকায় সব বাঙালি বসতি সরিয়ে গুচ্ছগ্রামে নিয়ে আসে। মাসে পরিবার প্রতি ৮৫ কেজি মিশ্র গম ও চাল দেয়া হয়। আশ্বাস দেয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি পরিস্থিতি বিরাজমান হলে আবার তাদের বসতবাটিতে পুনর্বাসন করা হবে। ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পাদিত সরকারের শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পরও বাঙালিদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে গুচ্ছগ্রামে গাদাগাদি করে বসবাস করে আসছেন। তৎকালীন এক পরিবার এখন একাধিক পরিবারের সৃষ্টি হওয়ায় গুচ্ছগ্রামে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এমতাবস্থায় গুচ্ছবাসীরা আশপাশের স্থানীয় জমিজমা ক্রয় করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। কিন্তু এখনো অনেক পরিবার গুচ্ছগ্রামে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। শান্তি চুক্তির পরবর্তী সময় থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩২ গ্রামের বাসিন্দারা প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় চাষাবাদ, বনজ ও ফলদবৃক্ষ রোপণ করে আসছেন। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে সন্ধ্যা হওয়ার আগে ওইসব এলাকা থেকে ফিরে আসতে হয়।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের পরবর্তী সময় থেকে পাহাড়ি সশস্ত্র সদস্যরা গ্রামবাসীকে ওইসব এলাকায় যেতে নিষেধ করে। বিভিন্ন সময় হামলা, মারধর ও অপহরণের মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসীরা বান্দরবানের কয়েকটি উপজেলা থেকে উপজাতীয় পরিবার এনে জোরপূর্বক বাঙালিদের ভিটায় বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে ওইসব এলাকায় ব্যাপক আকারে বাঙালিদের ভূমি দখল করে নিচ্ছে।

২১ জুন ২০২৩ বাটনাশিবির ভূমিরক্ষা কমিটির উদ্যোগে ওইসব এলাকার ভূমি উদ্ধার এবং ছয় দফা দাবিতে রামগড় উপজেলা সদরে ভূমি মালিকরা মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ওই কর্মসূচিতে নির্যাতিত ভূমি মালিকরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য দেন।

ওই ছয় দফা দাবি হলো- ১. বাটনাশিবির এলাকার গ্রামবাসীদের সব বে-দখলকৃত ভূমি উদ্ধার; ২. বাটনাশিবির এলাকায় সব গ্রামবাসীকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাকরণ; ৩. বাটনাশিবির এলাকায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা বিধান; ৪. বাদপড়া গুচ্ছগ্রামবাসীর তালিকা তৈরি করে রেশন সুবিধা প্রদান; ৫. গ্রামবাসীকে স্বাবলম্বী হতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সরকারি বেসরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার প্রদান ও ৬. বাটনাশিবির গুচ্ছগ্রামবাসীর জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। উপর্যুক্ত এলাকার ভূমি মালিকদের অন্য কোনো জমিজমা নেই। এসব ভূমি তাদের শেষ সফল। ভূমিগুলো উদ্ধার এবং নিরাপত্তাসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।

রামগড়ে পাহাড়ি-বাঙালি ভূমি বিরোধ নতুন নয়। ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল রামগড়ের বড়পিলাক ও ছনখোলায় সহিংসতায় তিনজন নিহত, বেশ কয়েকজন আহত এবং রামগড় ও মানিকছড়িতে বহু ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সহিংস ঘটনার পর রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ১৯৭৯ সাল থেকে দু’-তিন বছরে সরকার আড়াই থেকে সাড়ে চার লাখ ভূমিহীন-নদীভাঙনের শিকার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে এসে সরকারি খাস জমিতে তাদের পুনর্বাসিত করে। সরকার কোনো বাঙালি পরিবারকে পাহাড়িদের নিজস্ব দখলি বা খতিয়ানভুক্ত জমিতে বসতি স্থাপন করতে দেয়নি। ব্রিটিশ আমল থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দারবান পার্বত্য তিন জেলায় লাখ লাখ একর খাসজমি, টিলা ও পাহাড় রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার ও মিজোরোম থেকে আগত পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ মনে করে পাহাড়ি এলাকার সব পাহাড় ও জমিজমা তাদের। পার্বত্য তিন জেলায় কয়েক হাজার বাঙালি আছে যারা শত শত বছর ধরে পুরুষানুক্রমে এখানে ভিটা বাড়ি ও জমিজমা নিয়ে বসবাস করে আসছেন। তারাও ভূমি নিয়ে নিদারুণ বৈষম্যের শিকার।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে ভূমির ওপর একক আধিপত্য হেডম্যানদের। কয়েকটি গ্রাম বা মৌজার প্রধান হলেন হেডম্যান। হেডম্যানরা মারা গেলে তাদের বংশধররা নেতৃত্বে আসেন। জমি বিক্রি করতে গেলে ক্রেতা-বিক্রেতার স্থায়ী সনদ দেন জেলা প্রশাসক বা সার্কেলপ্রধান। তবে হেডম্যানরা যা লিখে দেন তাই বাস্তবায়ন হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির একক নিয়ন্ত্রক হেডম্যানদের কারণে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে।

তিন পার্বত্য জেলায় ৩৮৯ জন হেডম্যানের মধ্যে মাত্র তিনজন বাঙালি। তাদের কাছে অন্য সম্প্রদায়ের পাহাড়ি এবং বাঙালিরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। এই তিন সম্প্রদায়ের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করছে তিন পার্বত্য জেলায়। ‘কাগজ যার জমি তার’ আইন দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন অধিকাংশ পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠী (https://www.cht360 degree.com) HYPERLINK “https:// www.cht360degree.com)%7c/”.)

১৮৭১ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন-চতুর্থাংশ এলাকা সরকারি বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আমলে জনসংহতি সমিতির ১৯৯৩ সালের দাবিনামায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বমোট ৪৪৬.০৪ বর্গমাইল এলাকা জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদের এখতিয়ারভুক্ত উল্লেখ করা হয়েছে। মোদ্দা কথা বাংলাদেশ সরকারের আমলে, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ ভূমির মালিকানা সরকারের ছিল। যা সরকারি দলিল মোতাবেক প্রমাণিত ও পাহাড়ি নেতারা কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃত (Amena Muhsin, The Politics of Nationalism-1997, pp 89-92, 204; Maher Islam,

https://www.parbattanews.com/)HYPERLINK “https://www.parbattanews.com/)%7C”.) তিন পার্বত্য জেলায় ২৪ বছরেও ভূমি জরিপ ও আদমশুমারি হয়নি। সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পরও ভূমি জরিপ ও আদমশুমারিতে শুরু থেকে বাধা দিয়ে আসছে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। একবার ভূমি জরিপের কাজ করতে গেলে সন্ত্রাসীরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়।

পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধিত) আইন-২০১৬ নামে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত ৫২ শতাংশ বাঙালির মধ্যে শঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। কারণ গঠিত কমিশনে পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠী ভূমিহীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের ৯ জন সদস্যের মধ্যে তিনজন সার্কেল চিফ, তিনজন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও একজন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মোট সাতজন সবাই উপজাতি। দু’জন সরকারের প্রতিনিধি। ভূমি কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ নেই। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে ভূমি সমস্যা সবচেয়ে বেশি খাগড়াছড়িতে। আনুপাতিক হারে বাঙালিদের প্রতিনিধি নিয়ে ভূমি কমিশন নতুন করে গঠন করা প্রয়োজন।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পাহাড়ি, বাঙালি, ভূমি বিরোধ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন