মগদের নির্মমতাকেও হার মানানো গল্প
পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নৃশংসতা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী ও ভয়ংকর মগরা। ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হত্যা, লাশ গুম, সাগরে নিক্ষেপ- এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করছে না। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা পালিয়ে আসছেন বাংলাদেশে। তাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের মুসলমান ভাই-বোনরা তাদের প্রাণ বাঁচাতে সহযোগিতা করবেন। মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী ও মগদের অত্যাচারে যখন বাঁচার কোনো আশা নেই তখন এমন আস্থা নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদীর তীর কিংবা কোনো জঙ্গলে এসে অপেক্ষা করছেন নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের।
কিন্তু সব হারিয়ে রোহিঙ্গারা যখন শুধু জীবনটা বাঁচাতে নাফ নদী পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় তখন তাদের সেই অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের এমনই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন আব্দুল্লাহিল বাকি নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি এই মুহূর্তে রয়েছেন কুতুপালংয়ে।
মঙ্গলবার তিনি টেলিফোনে পরিবর্তন ডটকমকে বলেছেন, ‘আমি মগ দেখিনি, আমি শাহপরীর দ্বীপের কিছু দুর্বৃত্ত মাঝি দেখেছি।’
আসুন তার বর্ণনাতেই জানা যাক হৃদয়স্পর্শী সেই অভিজ্ঞতার কথা-
গত ১৩ সেপ্টেম্বরের কথা। প্রথমে টেকনাফের এক বয়স্ক শায়খুল হাদীস আমাদেরকে জানালেন, মিয়ানমার সীমান্তে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আটকে পড়েছে, যারা টাকার অভাবে বাংলাদেশে আসতে পারছে না। উনি আরও বললেন, যারা বাংলাদেশে চলে এসেছে তারা কেউ না খেয়ে মরে যাবে না ইনশাল্লাহ। কিন্তু ওপারে যারা টাকার অভাবে আসতে পারছে না তারা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে আছে। কারণ সেখানে তাদের কোন খাবার নেই, নেই কোনো আশ্রয়। আপনারা যদি সত্যি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কিছু করতে চান তবে এই অসহায় মানুষগুলোকে উদ্ধার করুন।
‘১৪ সেপ্টেম্বর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া কিছু ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার সীমান্তে নাক্ষংদিয়া দ্বীপে হাজার হাজার নারী, শিশু আটকে পড়ে আছে। তারা বাঁচার জন্য মুসলিম উম্মাহর কাছে কাকুতি-মিনতি জানাচ্ছেন। কিন্তু কোনো মাঝি তাদের পার করছেন না। কারণ তাদের পকেটে একটি কানাকড়িও নেই। আহ! কি নির্দয় এই মাঝিগুলো! কি পাষাণ এদের হৃদয়গুলো! যাই হোক, আমরা কয়জন আল্লাহর নগণ্য বান্দা আল্লাহর ওপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই অধম বান্দাগুলো জীবিত থাকতে কাউকে টাকার অভাবে ওপারে মরতে দেওয়া হবে না ইনশাল্লাহ।’
‘পরদিন ১৫ সেপ্টেম্বরের কথা। আমাদের চারজনের একটি টিম পৌঁছে গেলাম শাহপরীর দ্বীপে। মিশন- মিয়ানমারের নাক্ষংদিয়া। কথা হল স্থানীয়দের সাথে। জানতে চাইলাম মাঝিদের নাম পরিচয় ও ঠিকানা। কথা বলতে বলতে একজনের থেকে পেয়েও গেলাম স্থানীয় এক মাঝির নাম ও ঠিকানা। তার নাম নুরুল কবীর, ঠিকানা শাহপরীর দ্বীপের মাঝপাড়া। ছুটে চলল আমাদের টিম মাঝপাড়ার উদ্দেশ্যে। সিএনজি ড্রাইভার দেখিয়ে দিলেন আমাদের কবীর মাঝির বাড়ি। ড্রাইভারই আমাদেরকে দেখয়ে দিল নুরুল কবীরকে।’
‘ষাটোর্ধ্ব একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। তিনি জানালেন, বিগত দিনগুলোতে কিভাবে রোহিঙ্গাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন এই কবীর মাঝি। বললেন, তিনি নিজের নৌকায় করে তাদেরকে এনেছেন, নিজের বাড়িতে রেখে তাদেরকে খাওয়াইছেন। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম কবীর চাচাকে পেয়ে। আল্লাহই যেন আমাদের মিলিয়ে দিল সবকিছু।’
ৱকবীর চাচার সঙ্গে দর কষাকষি হল, প্রতি নৌকা ২২ হাজার টাকা এবং প্রতি নৌকায় পনের জন করে প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষ আসতে পারবে। সাথে ছোট বাচ্চারা ফ্রি। আমরা কালবিলম্ব না করে রাজি হয়ে গেলাম। আজকেই নুরুল কবীরের চারটি নৌকা যাবে নাক্ষংদিয়ার উদ্দেশ্যে। কথা হল মাঝিদের সাথেও। তারা বিভিন্ন কারগুজারি শুনালেন, জানালেন কিভাবে মজলুম রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সময় তারা জীবন বাঁচিয়েছেন। আমরাও আবেগ-আপ্লুত হয়ে গেলাম তাদের কথা শুনে। আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহকে স্মরণ করছি এবং তার সাহায্য কামনা করছি।’
‘নুরুল কবীর আমাদের জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। চা খেতে খেতেই আমরা কবীরের মাঝিদের জিজ্ঞেস করলাম, ওপারে কি নাসাকা (এখন বিজিপি) বাহিনী থাকে না? তারা জানাল, নাসাকারা একটু দূরে থাকে। তবে তারা পলায়নপর রোহিঙ্গাদের কিছু বলে না। আমি বললাম, সেখানে রিস্ক কেমন? তারা জানল, কোনো রিস্ক নেই। তৎক্ষণাৎ আমাদের একজন ভাই বলে উঠলেন, তাহলে কি আমরা আপনাদের সাথে যেতে পারব? তারাও আগপিছ কোনো কিছু না ভেবেই উত্তর দিল, হ্যাঁ পারবেন!’
‘আমাদের ভাইটি শার্ট-প্যান্ট পরিবর্তন করে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে নিলেন। তাকে দেখতে যেন অবিকল মাঝির মতোই লাগে। তখন দুপুর আড়াইটার কাছাকাছি। আমাদের নৌকা ওপারে পৌঁছানোর পরই মাঝিদের আসল চেহারা বের হয়ে আসলো। আমাদের সামনেই এই মাঝিরা রোহিঙ্গাদের মাল-সামানা নিজেদের নৌকায় উঠালো। রোহিঙ্গারা কাকুতি-মিনতি করছিলো মাঝিদের কাছে। বলছিলো, ভাই আল্লাহর দোহাই লাগে, এইগুলো আমাদের শেষ সম্বল, দীর্ঘ পাহাড়ি রাস্তা বেঁয়ে আমরা অনেক কষ্টে এইগুলো নিয়ে এসেছি। কিন্তু এই মাঝিরা যে দেখতে মানুষের মতো হলেও আসলে জন্তু-জানোয়ার ছাড়া কিছুই নয়।’
‘কয়েকজন রোহিঙ্গা সাগরে মাছ ধরার অনেক দামি একটা জাল নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য। জালটির দাম নাকি লাখ টাকার ওপরে। এই কবীর মাঝির লোকগুলো সেটা নৌকায় উঠানোর চেষ্টা করছিলো। তবে ওরাও এবার জীবন-মরণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ওদের কথা, আমরা মগদের যে জাল নিতে দেয়নি সে জাল আমরা জীবন থাকতে বাংলাদেশি মাঝিদের নিতে দেব না, এতে প্রাণ গেলেও যাক। এবার মাঝিরা কিছুটা পিছু হটল, আগে যা নৌকায় উঠিয়েছিল তাই নিয়েই চলে আসলো।’
‘আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছি, আমাদের সাথী ভাই নৌকাতে অবস্থান করার পরও তাদের ডাকাতি করতে সামান্যতম কুণ্ঠা হলো না। অন্য সময় কী করে একমাত্র আল্লাহই জানে!’
‘ফেরার পথে আমাদের লোককে বিভিন্নভাবে তারা হেনস্তা করা শুরু করে। সাগরের মাঝে এনে ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। তারপর বড় বড় রামদা বের করে প্রদর্শন করা শুরু করলো! জানি না, অস্ত্র প্রদর্শনের পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল! যাই হোক, তারা যে পেশাদার ডাকাত এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলো না।’
‘১৬ সেপ্টেম্বর, আমরা যখন দেখলাম শাহপরীর মাঝি নামক জলদস্যুদের সাথে আমরা পেরে উঠব না তখন আমরা কুতুপালং ক্যাম্পের অসহায় রোহিঙ্গাদের দিকে মনোযোগ দিলাম। কুতুপালংয়ের শেষ মাথায় একজনের দেখা মিলল যিনি শাহপরীর জলদস্যুদের নির্যাতনের জীবন্ত সাক্ষী।’
‘তার ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের সাথে পাঁচ হাজার টাকা চুক্তি হয়েছিল শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। নৌকাতে উঠার সময়ই তাদের থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। সাগরের মাঝ পথে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে মহিলাদের কানের দুল, নাকের ফুল থেকে শুরু করে সব খুলে নেয় ওই মানুষরূপী জানোয়ারগুলো। পুরুষদের একটি লুঙ্গি ছাড়া আর কোনো কিছু রাখেনি তারা। হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে গরু-ছাগল যা এনেছিল সবই মাঝি নামক জলদস্যুগুলো রেখে দেয়।’
‘আব্দুল হামিদ নামের ওই ভাই আরও জানালো, শাহপরীর দ্বীপের তীরে না এসে সাগরের মাঝে গলা পানিতেই তাদের সবাইকে লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয়। বড়রা চলে আসতে পারলেও শিশুরা সবাই আসতে পারেনি। কারণ বড়দের গলা পানি আর শিশুদের ডুবা পানি। আর অনেক মহিলার চারটা-পাঁচটা বাচ্চা। একজন মহিলা কয়জনকে আনবে? দুই একজন বাচ্চাকে এনেছে, বাকিদের সাগরে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করে দিয়ে এসেছে।’
‘সেই ভাই জানালো, তাদের নৌকারই কয়েকজন শিশু শাহপরীর দ্বীপের তীরেই মারা গেছে। ভাইরাল হয়ে যাওয়া একজন বোনের উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহ অনেকেই দেখেছেন। নিশ্চিত থাকুন, ওই বোনকে কোন মগ বা নাসাকা হত্যা করেনি, তাকে শাহপরীর মাঝি নামক জলদস্যুগুলোই হত্যা করেছে। কারণ মগরা মারলে সাগর পর্যন্ত লাশ আসতো না। আর ট্রলার ডুবি হলে অনেক মানুষ মারা যেত। কিন্তু এ রকম একজন নয়, দুইজন নয়, হাজারো বোন আমাদের দেশি মগদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।’
‘যখনই কেউ চাহিদা মতো টাকা পয়সা দিতে পারে না তখনই তাকে সাগরের মাঝ পথে নৌকা থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এভাবে সাগরের মাছের খাবার হয়ে সাগরে বিলীন হয়ে গেছে অসংখ্য নাম-পরিচয়হীন আরাকানি মা-বোন।’
‘এবার শুনুন এ রকমই একজন বোনের বাস্তব কাহিনী। বোনের নাম নূর বেগম, বয়স ত্রিশের কিছু বেশি হবে। সেই বোন তার স্বামী-সন্তান সব হারিয়ে এক কাপড়ে চলে এসেছিল মিয়ানমার সীমান্তে। অনেকের সাথে সেও নৌকায় উঠেছিল, কিন্তু নৌকার মাঝিকে দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না তার। কোন কিছু না পেয়ে নৌকার মাঝি আলম তাকে শাহপরীর দ্বীপে আটকে রাখে। পঞ্চাশ হাজার টাকা না দিলে তাকে জবাই করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় সে। তিন দিন অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পর তাকে বিশ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
‘নূর বেগমের একজন আত্মীয় সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তিনি হেলাল নামক শাহপরীর এক বিকাশ এজেন্টের নম্বরে বিশ হাজার টাকা দিলে আলম মাঝি তাকে ছেড়ে দেয়। আলম শাহপরীর দ্বীপের ডাঙ্গা পাড়ার মোতালেবের ছেলে।’
‘আজ (মঙ্গলবার) সকালেও নূর বেগমকে ফোন দিয়েছিলাম, তিনি জানালেন, এখন তিনি একটি ক্যাম্পে খাবার ও থাকার খুব কষ্টে আছেন।’
‘নূর বেগম আমাকে জানিয়েছেন, তিনি দুনিয়াতে কোন বিচার চান না। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু আজকে যদি নুরুল কবীর ও আলম গংদের বিচার না হয়, তবে আমাদের ভবিষ্যতেও উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মা-বোনের লাশ দেখতে হবে। প্রোফাইল পিকচার বানাতে হবে সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা শিশুর লাশ। আমরা দূর থেকে মগ বৌদ্ধদের কিছু করতে পারছি না, কিন্তু তাই বলে কি শাহপরীর দ্বীপের মাঝি নামক জলদস্যুদেরও কিছু করতে পারব না?’
লেখক: বাকী বিল্লাহ, রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত কর্মী
সূত্র: পরিবর্তন