মহালছড়িতে উৎসব মুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ পূজা ও প্রবারণা উৎসব উদযাপন

1381354_10151702713004212_1020035913_n
 

মহালছড়ি(খাগড়াছড়ি) সংবাদদাতাঃ
মহালছড়ি উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল আযহা’র আনন্দ উৎসবের আমেজ কাটতে না কাটতেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমাকে ঘিরে সর্বত্র লেগেছে উৎসবের আমেজ।  প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় বাজছে উৎসবের সূর। ধনী-গরিব সকলের ঘরে ঘরে চলছে প্রবারণা পুর্ণিমার উৎসব। চলতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল আযহা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমা খুব কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় সকল সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। বর্ষাব্রতের সমাপ্তি এবং মাসব্যাপী কঠিন চীবর দান উৎসবের সূচনা করে বলে প্রবারণা পুর্ণিমাকে বৌদ্ধদের আনন্দের দিনও বলা হয়।

মাসব্যাপী উৎসবের আনন্দে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আর মুসলিম যেন জাতিগত সব বিভেদ ভুলে মিলেছে এক কাতারে। পাহাড়ের এই উৎসব ভুলিয়ে দিয়েছে জাতিগত বিভেদ। সবাই ভুলে গেছে কে পাহাড়ী বা কে বাঙ্গালী। সবাই মেতে উঠেছে ধর্মীয় উৎসবের অনাবিল এক আনন্দ আয়োজনে। তৈরী হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। সব মিলে ধর্মীয় উৎসবগুলো জাতিগত ভেদাভেদের শেকড়কে উপড়ে ফেলেছে। সকলের আন্তরিকতাপূর্ণ উপস্থিতিতে উৎসবগুলো হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত।

সারাদেশের ন্যায় মহালছড়িতেও উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গা পূজা। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন প্রতিমা। শিল্পীর মননশীল চিন্তায় আর নিপুণ হাতের প্রাণবন্ত কারুকাজে প্রতিমাগুলোকে সাজানো হয়েছে নান্দনিক সাজে। পাশাপাশি নয়নাভিরাম সাজে সাজানো হয়েছে পূজামন্ডপ। আর কেনা-কাটায়ও পিছিয়ে ছিলনা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গোৎসব সম্পন্ন করতে প্রতিটি মন্ডপে নেয়া হয়েছিল বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। টহলে ছিল নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর মোবাইল টিম। ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে শারদীয় দূর্গোৎসব ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিমা দুর্গাকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ।

হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপূজা শেষ হতে না হতেই ১৬ অক্টোবর পালিত হলো মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল আযহা। পবিত্র ঈদ-উল আযহা পালনেও যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা ও পশু কোরবানি দিয়েছে ধর্মপ্রাণ মুসল্লীরা।  এ উৎসবকে ঘিরে জমজমাট ছিল কোরবানীর পশুর হাটগুলো। বাপ-ছেলের গরু টানাটানির দৃশ্যগুলোও ছিল চোখে লেগে থাকার মত। ঈদের দিন শত শত ধর্মপ্রাণ মুসল্লী ঈদগাহ মাঠে নামাজ পড়তে গেলে বড়দের সাথে ছোট ছোট কোমল মতি ছেলেরাও  জামাতে অংশগ্রহন করেছিলো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা রং-বেরঙের বাহারী পোশাক পরে দলে দলে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য আকর্ষণীয়।

এদিকে মুসলমানদের ঈদের আনন্দ কাটতে না কাটতেই শুরু হলো বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা। এ পুর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত পালন সমাপ্তি, কঠিন চীবর দান উৎসব শুরু, ভূল-ত্রুটি ক্ষমা প্রার্থনা করে পরিশুদ্ধতা অর্জন, অভিধর্ম দেশনা করে তাবতিংস স্বর্গ থেকে বুদ্ধের প্রত্যাবর্তন, বুদ্ধ কর্তৃক যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন প্রভৃতি কারণে প্রবারণা পুর্ণিমা বৌদ্ধ জগতে একটি অনন্য স্মরণীয় উৎসব। এদিন থেকে মাসব্যপী চলবে বিভিন্ন বিহারে ঐতিহ্যবাহী উৎসব দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। কঠিন চীবর দানোৎসবকে সামনে রেখে পাহাড়ী জনপদের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলছে উৎসব প্রস্তুতি। এ উৎসবে তাদের নতুন জামা-কাপড় কেনাকাটার রেওয়াজ না থাকলেও এই ধর্মীয় উৎসব আয়োজন ও পালনে তাদের মাঝে উৎসাহের কোনো কমতি নেই।

আগামী ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত পার্বত্য জনপদের বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারগুলোতে পালন করা হবে ঐতিহ্যবাহী কঠিন চীবর দানোৎসব। এ সময় পাহাড়ে রাতের আকাশে আকাশে ভেসে বেড়াবে ফানুস বাতির আলোকসজ্জা।
মহালছড়ি’র প্রতিটি বৌদ্ধ মন্দিরকে প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। প্রতিদিন শত শত দায়ক-দায়িকা অংশ নিচ্ছেন বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপন প্রস্তুতির কাজে। দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবকে ঘিরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের এ ধর্মীয় উৎসবগুলোতে থাকেনা কোন জাতিগত ভেদাভেদ। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতিতে এই ধর্মীয় উৎসবগুলো হয়ে উঠে প্রাণবন্ত।
এ ত্রিমুখী উৎসব উপলক্ষে মহালছড়ি’র বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় শোভা পেয়েছে নানা রংঙের ডিজিটাল ব্যানার। শারদীয় দূর্গা পূজার শুভেচ্ছা, ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা ও কঠির চীবর দানের শুভেচ্ছা লিখা ডিজিটাল ব্যানারগুলো অনুষ্ঠানকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছে বলে মত ব্যক্ত করেন অভিজ্ঞ মহল।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতারা এই ত্রিমূখী উৎসবকে কাজে লাগিয়ে পোষ্টার ও  ব্যানারের মাধ্যমে নিজেদেরকে সবার সামনে উপস্থাপন করার এক ধরনের চেষ্টা চালিয়েছেন।
 এই ত্রিমুখী আনন্দে যাতে ভাটা না পড়ে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সেনাবাহিনীও। মহালছড়ি জোন অধিনায়ক লে: কর্ণেল শহীদুল ইসলাম বলেন, মহালছড়ি উপজেলায় আইন শৃংখলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে আনন্দ উৎসব করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। তিনি আরো বলেন, ত্রিমূখী উৎসবে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে একে অপরের দাওয়াতে অংশগ্রহন করতে দেখা গেছে।

সবমিলিয়ে সম্প্রীতির এক উজ্জল দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন তিনি। মহালছড়ি থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সামিউল কবির জানান, উৎসবগুলোকে ঘিরে সব ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের টহল রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন