মাদক ও সন্ত্রাসীদের আস্তানা রোহিঙ্গা ক্যাম্প

fec-image

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো ইয়াবা ও মাদকের ঘাটি হিসেবে রূপ নিয়েছে। এছাড়াও কতিপয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা শিবিরের অভ্যান্তরে গড়ে তুলেছে আস্তানা। দিনের বেলায় যেমন-তেমন রাতের বেলায় পুরো ক্যাম্প এলাকা জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে থাকেন এসব সন্তাসীরা। তাদের আয়ের উৎস হচ্ছে ইয়াবা ও মাদক ব্যবসা। যার ফলে সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ও মাদক নিয়ে এসে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে যাচ্ছে তারা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, এই দুই উপজেলায় ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরে ইয়াবা সেবন ও বিক্রির আস্তানা রয়েছে পাঁচ শতাধিক। র‌্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের চালান মিয়ানমার থেকে এসব আস্তানায় নিয়ে আসে রোহিঙ্গা পুরুষরা। পরে সেখান থেকে ওই মাদকদ্রব্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিয়ে থাকে রোহিঙ্গা নারীরা।

সুত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পে ইয়াবা, মানব পাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বাড়ছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। চলছে অস্ত্রের মহড়াও। বাড়ছে খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্ত অবস্থান থাকলেও অনেক সময় ক্যাম্পের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসীদের উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হয়। কারণ রোহিঙ্গারা গুজব ছড়িয়ে যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে দ্বিধা করেনা।

বালুখালী সীমান্তে বসবাসকারী স্থানীয় নাগরিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সীমান্ত মাত্র আধা কিলোমিটার। এক সময় রাখাইনের রোহিঙ্গা ইয়াবা ও মাদকের গডফাদার গুলো বর্তমানে অবস্থান করছে ক্যাম্পে। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে মিয়নামার রাখাইন ইয়াবা গডফাদারদের সাথে। কথাবার্তার মাধ্যমে তারা সীমান্তের কাটাতার পর্যন্ত নিয়ে আসে ইয়াবা, সেখান থেকে ক্যাম্পের রোহিঙ্গা গডফাদার গুলো তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে নিয়ে এসে মজুদ করে থাকে ক্যাম্পে। সুযোগ বুঝে পরে পাচার করে দিয়ে থাকে।

বালুখালী ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনের বালুখালী নামক স্থানের ইয়াবা গডফাদার জামাল উদ্দিন, বলীবাজার এলাকার শওকত আলী, মংডু চিনগীরি পাড়ার ডাঃ ছলিম, তার ভাই আকতার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বালুখালী দুই নাম্বার ক্যাম্পে। উখিয়ার ২২ ক্যাম্পে রয়েছে তাদের একটি শক্তিশালী ইয়াবা ও মাদক সিন্ডিকেট। মূলতঃ এদের মাধ্যমে সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা ও মাদকের চালান আসে বলে ওই রোহিঙ্গা নেতা জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হচ্ছে, রোহিঙ্গা ততই অপকর্মের দিকে চলে যাচ্ছে। আজ থেকে ২ বছর আগে মানবতার দোহাই দিয়ে যাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম আমরা, সেসব রোহিঙ্গারাই এখন আমাদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, স্থানীয় এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে আগে একটা যে সু-সম্পর্ক ছিল তা এখন নেই। রোহিঙ্গার বিভিন্ন আচার, আচারণে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।

তিনি আরো বলেন, সীমান্ত এলাকা দিয়ে ইয়াবা ও মাদক নিয়ে এসে ক্যাম্পে মজুদ করে থাকে রোহিঙ্গারা। প্রতিদিন রাতে ক্যাম্পে অভ্যান্তরে বসে থাকে ইয়াবা ও মাদকের হাট। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিষয় গুলো জানলেও নানান কারণে তারা অভিযান চালাতে সক্ষম হয়না। তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইয়াবা, মাদক এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বন্ধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি দাবি জানান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা সংকটের গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন রোহিঙ্গা। এছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও ৩২ রোহিঙ্গা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের প্রবেশের পর ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। যার মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী সংক্রান্ত মামলা ৩১ টি। এসব মামলায় আসামি ১০৮৮ রোহিঙ্গা। তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল মনসুর জানান, শুধু ক্যাম্পে নয়, ক্যাম্পের বাইরেও ইয়াবা এবং মাদক প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করা আছে। এ ব্যাপারে কারো ছাড় নেই। ইয়াবাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইতিমধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। আর ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য ক্যাম্পের অভ্যান্তরে ৫টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এতে ৩শতাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য রয়েছে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সরকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তৎমধ্যে পাহাড়ি অঞ্চল ঘেষে ক্যাম্পে কাটাতারের বেড়া স্থাপন, এপিবিএনের সদস্য নিয়োগ, ইনভেস্টিগেশন সেন্টার এবং ক্যাম্প জুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন। এ বিষয়ে তিনি বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। বুধবার মন্ত্রণালয়ে এই সংক্রান্ত একটি জরুরী বৈঠক রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা ১১ লাখের বেশি। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এদিকে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর কারসাজিতে পরপর দুই বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যেখানে রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড ও সহিংস আচরণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আস্তানা রোহিঙ্গা ক্যাম্প, মাদক ও সন্ত্রাসীদের
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন