মিয়ানমার সঙ্কট: নতুন মিত্র খুঁজবেন শেখ হাসিনা?

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমার উদ্বাস্তু সঙ্কট স্থানীয়জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। পুরনো সম্পর্ক ইতোমধ্যেই টানাপোড়নে পড়েছেঅন্যদিকে কিছু দিন আগেও বৈরী ছিল এমন কারো সাথে অপ্রত্যাশিত নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে। এই অঞ্চলের নতুন ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারত পরস্পরের শত্রু। উভয় দেশই মিয়ানমারের বন্ধুত্ব লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করছেআর রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে।

দীর্ঘ মেয়াদি একটি নীতি সামগ্রিকভাবে বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে ১৯৭৮ সালে এবং তা এখনো চলছে। মিয়ানমার অনেকটা নিখুঁতভাবেই চিন্তা করেছিলবাংলাদেশ নিজের শক্তিতে তার সীমান্তগুলো সুরক্ষিত রাখতে পারবে না। এই বিশ্লেষণ থেকেই তারা জাতিগত নির্মূল অভিযানের ছক কষেছিল।

১৯৭৮ সালের ঘটনাটি ছিল ছোট আকারে১৯৯২ সালে তা বাড়ে এবং সর্বশেষ দফায় তা সর্বোচ্চ আকার লাভ করে। এই নীতি বাস্তবায়নের সময় মিয়ানমার কেবল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সামর্থ্যই যাচাই করেনিসেইসাথে দেশটির আন্তর্জাতিক সমর্থক তথা চীনভারত ও রাশিয়ার কাছ থেকে সমর্থনের নিশ্চয়তার শক্তিও নিরূপণ করেছে। ওই তিনটি দেশই এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে সমর্থন করার মধ্যে কৌশলগত লাভ দেখছে খুবই কম।

বিভিন্ন সূত্রের ভাষ্যমতেবাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফরটি খুব ফলপ্রসূ হয়নি। কাগজে কলমে বিনীত হলেও বাস্তবে শিগগিরই উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখছে না। এদিকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ২৪ডটকম ২৭ অক্টোবর এক প্রতিবেদনে বলেছেসু চি বলেছেনরোহিঙ্গরা ফিরতে খুব একটা আগ্রহী নয়। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধদের কাছ থেকে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। খুব সহসা প্রত্যাবর্তন না হওয়া নিয়ে সচেতনা সৃষ্টির ফলে বাংলাদেশ এখন তার বিদ্যমান কৌশলগত বিকল্পগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করলেও তা তেমন আগ্রহের সৃষ্টি করেনি। তিনি যে বার্তাটি দিয়ে গেছেন তা হলো মিয়ানমারে চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাসহ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার কোনো যুক্তি ভারতের কাছে নেই। অবশ্য বাংলাদেশ দিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে যাওয়ার জন্য ভারত ট্রানজিটের নিশ্চয়তা কামনা করছে এবং এই প্রতিশ্রুতিও চাইছেযাতে বাংলাদেশে তাদের বিদ্রোহীরা আস্তানা গাড়তে না পারে। অবশ্য শেখ হাসিনা কাজটি করেছেন।

এ ধরনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করবেতা নিশ্চিত নয়। তবে শক্তিশালী ভারতের কাছ থেকে কিছু এলেই কেবল বাংলাদেশ কিছু করতে পারে। এই মুহূর্তে বড় কোনো বন্ধুএই পর্যায়ে একমাত্র হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রনা এলে বাংলাদেশের সামনে করণীয় রয়েছে খুবই সীমিত।

আরসা, আইএসআই ও যুক্তরাষ্ট্র

মিয়ানমার জটিলতার পর থেকে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার নার্ভাস হয়ে পড়ার মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অস্বস্তিও প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ায় ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শেখ হাসিনাকে উৎখাতচেষ্টার সাথে সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষটি প্রকাশিত হয়েছে ২৬ অক্টোবর কলকাতা টেলিগ্রাফে। এতে বলা হয়েছে, ‘স্পর্শকাতর একটি ইস্যু’ নিয়ে আলোচনার জন্য কয়েকজন কর্মরত সিনিয়র ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বৈঠক করার পরিকল্পনা ‘অঙ্কুরেই বিনষ্ট’ করা হয়েছে।

আগের প্রতিবেদনগুলোর মতো এতেও আরসা ফ্যাক্টর তুলে ধরে বলা হয়এ ধরনের কাজের সাথে আইএসআই জড়িত। তবে বলা হয়আওয়ামী লীগ তীব্রভাবে আইএসআইবিরোধী। এই বক্তব্যে ভারতের উদ্বেগও প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ ভারতের সৃষ্ট জটিলতার কারণে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছেতাতে করে বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এতে এই আশঙ্কারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছেঅত্যন্ত হাসিনাপন্থী হলেও সেনাবাহিনী পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। ফলে শেখ হাসিনার হয়তো অন্যান্য বন্ধুরবিশেষ করে ভারতের প্রয়োজন হতে পারে। তবে এসবের পরও শেখ হাসিনা মনে হচ্ছে বেশ দুর্ভেদ্য। মিডিয়ার খবর আইএসপিআরও অস্বীকার করেছে।

এদিকে মিয়ানমারের দিকে ভারতের ঝোঁকার ফলে বাংলাদেশে পাকিস্তানের অজনপ্রিয়তার অবসান ঘটেছে এবং ভারতও তা জানে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলে কারা সহায়তা করতে পারেতা খুঁজতে চাইতে পারে বাংলাদেশ। সম্ভাব্য সহায়তাকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে ঐতিহাসিক শত্রু পাকিস্তান এবং তুরস্কসহ তথাকথিত ‘ইসলামি রাষ্ট্রগুলো।’ এ ধরনের কিছু গোপন নয়। বাংলাদেশ যদিও তিনটি ‘ইসলামি’ এনজিওকে রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করতে নিষিদ্ধ করেছেকিন্তু তবুও ইসলামি কার্ড হাতে রয়ে গেছে।

আরসার অবস্থান কিন্তু ভিন্ন। বাংলাদেশের জিহাদি গ্রুপগুলো মোটেই জনপ্রিয় নয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে গঠিত আরসার জনপ্রিয়তা রয়েছে। উল্লেখ্যমিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার সমালোচনা ভারতচীন বা রাশিয়া করেনি। এ কারণেই বাংলাদেশের জিহাদি গ্রুপগুলো জনপ্রিয়তা না পেলেও রোহিঙ্গা এবং সেই সুবাদে আরসার প্রতি সহানুভূতি রয়েছে। আরসা এবং এর সমর্থকদের জন্য বিষয়টি ইতিবাচক।

 

নতুন বন্ধু ও শত্রু?

এদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ব্যাপারে ধৈর্য হ্রাস পেতে শুরু করেছেরোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সঙ্ঘাতের খবর আসতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি উদ্বেগও এখন আগের চেয়ে বেশি করে মিডিয়ায় আসছে।

আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু ইস্যুটি এখন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে শুরু করেছে। যা শেখ হাসিনাকে আরো আগ্রাসীভাবে নতুন মিত্র খোঁজার কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য করবে।

একমাত্র যে পরাশক্তি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেতা হলো যুক্তরাষ্ট্র। বুদ্ধিজীবী মহলে সাধারণভাবে তেমন জনপ্রিয় না হলেও বাংলাদেশের জন্য বিকল্প মিত্র খোঁজাটা সীমিত হতে পারে। ২০১৮ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। শেখ হাসিনার এমন মিত্রের প্রয়োজনযে তার রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের ব্যাপারেও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হলেশুনতে যতই উদ্ভট লাগুক না কেনমিয়ানমার সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান কিছুটা ভূমিকা পালন করতে পারে।

সামনে নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চিত ভবিষ্যত দেখা যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে উদ্বাস্তুদের ঢল নামায় দেশী ও বিদেশী মিত্র সৃষ্টিতে বিপুল পরিবর্তন অনিবার্য বলেই মনে হচ্ছে।

 

সূত্র: south asian monitor

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন