আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস

যে কারণে বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর খরচ বেশি

fec-image

বাংলাদেশে আছে সারি সারি ঝাউবন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি বিশ্বের ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) সুন্দরবন। বিস্ময়কর সৌন্দর্যের বাংলাদেশ এমনভাবে সাজানো যে, দেশের যেকোনো প্রান্তে গেলে কোনো না কোনো আকর্ষণীয় স্থান চোখে পড়বেই। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এত সাজানো প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ নেই।

কিন্তু পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিদেশি পর্যটক খুব একটা দেখা না গেলেও অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। ট্যুর অপারেটরসহ নানা সংস্থার হিসেবে স্বাভাবিক সময় বছরে ৭০ থেকে ৮০ লাখ পর্যটক দেশের মধ্যেই ভ্রমণ করে বা বেড়াতে যায় তাদের পছন্দের জায়গাগুলোতে, যার শীর্ষে আছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। খবর বিবিসির

বেসরকারি চাকুরীজীবী তামান্না খায়ের বলছেন, আশেপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো পর্যটকবান্ধব পরিবেশ কম কিন্তু এখানে খরচ অনেক বেশি।

“আমার কাছে মনে হয় এখানে খরচ অনেক বেশি। একই খরচ দিয়ে বাইরের অনেক দেশের তুলনায় আরও ভালোভাবে থাকা যায়। এমনি হয়তো এখন এখানে ভালো রিসোর্ট হোটেল আছে কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় এগুলোতে খরচ বেশি”।

তামান্না খায়ের বাইরের দেশ বলতে ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ও থাইল্যান্ডের প্রসঙ্গ টেনেছেন। বাস্তবতা হলো এসব দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ বিদেশি পর্যটক বেড়াতে যায় বাংলাদেশ তার ধারে কাছেও নেই।

এমনকি যে পরিমাণ বাংলাদেশি প্রতি বছর এসব দেশে বেড়াতে যায় তার তুলনায় বিদেশিদের এখানে আসার হার অনেক কম। করোনাভাইরাস মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বিদেশ থেকে ১৬ লাখেরও বেশি বিদেশি পর্যটক এলেও এদের বেশিরভাগই আসলে প্রবাসী বাংলাদেশি। প্রকৃত অর্থে বিদেশি পর্যটক ছিলো আড়াই লাখের মতো।

তবে সব মিলিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ৮০-৯০ লাখ পর্যটক বছরজুড়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। এ কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের নিয়ে কাজ করা ট্যুর অপারেটরদের সংখ্যাও বেশ বেড়েছে।

ঝটিকা সফর নামে একটি প্রতিষ্ঠান গত তিন বছর ধরে পরিচালনা করছেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তার মতে বাংলাদেশের পর্যটন স্থাপনাগুলোতে অতিরিক্ত ব্যয়ের মূল কারণ সিন্ডিকেট ব্যবসা আর কয়েকটি বিশেষ সময়ে পর্যটকদের অতিমাত্রায় ভিড় করা।

“ট্যুরিজম স্পটগুলোতে আলাদা সিন্ডিকেট থাকে। পূর্ণিমায় সুন্দরবন যাবেন কিন্তু সব শিপের ভাড়া একযোগে বাড়িয়ে দেয়া হয়। হাওরেও একই অবস্থা। সাজেকেও তাই। আগে যেটা ছিলো দামটা ধারণা করতে পারতাম কিন্তু এখন ওরা একটা সিন্ডিকেট। আমার তিন বছরের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কক্সবাজারেই আমি নেই না পর্যটকদের। কারণ দাম। এতো হোটেল তাও এতো দাম”।

অর্থাৎ এখানে পর্যটন স্পটভিত্তিক ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে সবকিছুর দামই বাড়িয়ে তোলে বলেই পর্যটকদের খরচ প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় সেবা বা বিনোদনের কোন সুযোগ পাওয়া যায় না বলেই বিদেশিরা সাধারণত এখানে আসতে আগ্রহী হয় না।

কিন্তু বাংলাদেশে পর্যটন একটি বিশেষ মৌসুম আর সুনির্দিষ্ট কিছু ইভেন্টভিত্তিক হওয়াকেই অতিরিক্ত দামের প্রধান কারণ বলে অনেকে মনে করেন। যেমনটি বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক সামসাদ নওরীন।

“আমাদের এখানে একটা মৌসুমে অনেক বেশি টুরিস্ট আসে। আর অন্য মৌসুমে থাকেই না। সে কারণে পিক সিজনে ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করে। এখানে যদি সারা বছর বিভিন্ন ট্যুরিজম থাকতো তাহলে এমন হতো না। পশ্চিমা বিশ্বে শীতের সময় টুরিস্টরা অন্য দিকে যায়। আমাদের এদিকে শীতে বেড়াতে যায় বেশি। একইভাবে গ্রীষ্ম বা বর্ষা মৌসুমেও পর্যটক টানার ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে অসামঞ্জস্যতাটা দেখা যেতো না”।

আর এই অসামঞ্জস্যতাই দেশের ট্যুরিজমকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে বলে মনে করেন তিনি।

অর্থাৎ সারা বছরের টাকা এক শীত মৌসুম বা কয়েকটি উৎসবের সময় তুলে নেয়ার মতো ব্যবসায়িক নীতিই দেশের পর্যটনকে ব্যয়বহুল করে ফেলেছে।

তবে এ অভিযোগ মানতে রাজি নন দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন নগরী কক্সেসবাজারের হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ।

“পর্যটকরা বিভিন্ন ক্যাটাগরির হয়। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন বাজেট থাকে। কক্সবাজারকে ব্যয়বহুল বলা যায় না। এখানে ৫০০ বা ১০০০ থেকে বিভিন্ন দামের হোটেল আছে। দামীও আছে। যে যেভাবে চায়। এখন আপনি ভারত বা নেপাল যেতে পারেন। ভারতের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো ওখানে ভিন্ন ধরণের ব্যবস্থাপনা আছে”।

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী কদর বলছেন, পর্যটন ব্যয় বাস্তবতার নিরিখে খুব বেশি বলে তারা মনে করেন না তবে পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি মনে হয়।

“যারা এই খাতে ব্যবসা করেন তাদের অবকাঠামোগত সুবিধার ওপর ভিত্তি করে দাম হিসেব করেন। আমাদের সম্ভাবনা আছে কিন্তু সেভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। সে কারণেই কিছু ইউনিট (বেসরকারি) গড়ে তোলার কারণে তাদের বিনিয়োগ বেশি হয়েছে ও সার্ভিস চার্জ বেশি আছে। কিন্তু সার্বিকভাবে ট্যুরিজম ব্যয় এখানে বেশি বলে যেটা বলা হয় সেটা খুব বেশি যুক্তিসংগত নয়”।

তিনি বলছেন সরকার পর্যটন খাততে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করায় পর্যটন স্পট গুলোতে খরচের তুলনায় সুযোগ সুবিধা ও নিরাপত্তা বেড়েছে সে কারণেই পর্যটক সংখ্যাও বাড়ছে।

আবার বেসরকারি খাতও এগিয়ে আসায় বিলাসবহুল ট্যুরিজম ফ্যাসিলিটিজ তৈরি হয়েছে যা পর্যটন খাতকে অনেকদূর এগিয়ে নেবে বলেই মনে করছে সরকার।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন