রাষ্ট্র আদিবাসীদের বৈচিত্র্যকে স্বীকার না করে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত- সন্তু লারমা

Santu_Larma

স্টাফ রিপোর্টার:

পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেছেন, `বাংলাদেশে ৫৪টিরও অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীরা তাদের বৈচিত্র্যময় সাংষ্কৃতিক রক্ষায় প্রতিনিয়ত লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের এই সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রাষ্ট্র আদিবাসীদের এই বৈচিত্র্যকে স্বীকার না করে এটিকে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্রে প্রতিনিয়িত লিপ্ত আছে’।

তিনি আরো বলেন, `যেহেতু আদিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেক দুর্বল তাই সাংষ্কৃতিক অধিকারের মতো অন্য সব ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে শোষিত ও পদদলিত হচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিকে সংগঠিত করে পাহাড়ের আদিবাসীরা পার্বত্য চট্ট্রগাম চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী আদিবাসীদের রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার জন্য প্রতিনিয়ত নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
আদিবাসীদের বেঁচে থাকার অধিকারসহ সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় তিনি সকলকে রাজনৈতিক সচেতন হবার আহ্বান জানান এবং বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা অর্জনের উপর গুরুত্ব দেন। শাসকগোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন, সাংষ্কৃতিক আন্দোলন জোরেশোরে গড়ে তোলার আহ্বান জানান।’

‘আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষা এবং উন্নয়ন: বর্তমান প্রেক্ষিত’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও সংহতিমূলক সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান আজ বিকাল সাড়ে ৩টায় ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা এ কথা বলেন। কাপেং ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরাম যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লুবনা মারিয়া; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজীব মীর; ইউএনডিপি সিএইচটিডিএফ এর প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ চাকমা; বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরামের সহ সভাপতি সোহেল হাজং প্রমুখ। আলোচনার শুরুতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। সভা পরিচালনা করেন রিপন বানাই।

লুবনা মারিয়া বলেন, `আদিবাসীদের অধিকারের লড়াই, সাংস্কৃতিক লড়াই এসবই রাজণীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়েই আদিবাসীদের বেঁচে থাকার অধিকার অর্জন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, যে দেশের সংষ্কৃতি যত বেশী বৈচিত্র্য সেই দেশ তত বেশী সমৃদ্ধ। এটা আমাদের সরকারকে বুঝতে হবে এবং আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষাসহ চর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান’।

রাজীব মীর বলেন, `কৃষ্টি থেকেই সংস্কৃতি শব্দের উৎপত্তি। আর কৃষ্টি হচ্ছে কৃষি যা উৎপাদন ব্যবস্থার মূল। সুতরাং সংস্কৃতি বিষয়টা উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জড়িত। যখন আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয় তখন তাদের কৃষি, তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। এর ফলে আদিবাসীরা যেমন উচ্ছেদ হয় তেমনি তার সংস্কৃতিও উচ্ছেদ হয়। তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের নাম নিশানা মুছে ফেলার রাজণীতি চলছে। এর জন্য আদিবাসীসহ সকল স্তরের প্রগতিশীল মানুষদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে’।
প্রসেনজিৎ চাকমা বলেন, `পৃথিবীর মোট ২০ ভাগ ভূমিতে আদিবাসীরা আছে এবং পৃথিবীর ৮০ ভাগ সংষ্কৃতিই আদিবাসীদের সংষ্কৃতি। অর্থাৎ পৃথিবীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হলে আদিবাসী সংস্কৃতিকে বৃহত্তর স্বার্থেই টিকিয়ে রাখতে হবে। তানাহলে এই পৃথিবী এক ঘেয়েমি হয়ে যাবে। উন্নয়ন সংস্থা, সরকারসহ সকলকে আদিবাসীদের সংষ্কৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান’।

সোহেল হাজং বলেন, `সব ক্ষেত্রেই সরকার আদিবাসীদের সাথে প্রতারনা করছে। আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষার নামে নামমাত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সরকার আদিবাসীদের সাথে প্রতারনা করছে। আদিবাসীদের জন্য নির্মিত সাংস্কৃতিক চর্চা প্রতিষ্ঠানগুলো অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এগুলোর জন্য পর্যাপ্ত বাজেটও নেই। নতুন ৩টি সাংষ্কৃতিক প্রতিষ্ঠান একাডেমী তৈরির প্রতিশ্রুতিও কবে বাস্তবায়ন হবে তা আদিবাসীরা জানে না’।

প্রবন্ধে পল্লব চাকমা বলেন, `বাংলাদেশ একটি বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জাতি ছাড়াও ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। এসব আদিবাসী জাতিসমূহ যুগ যুগ ধরে নিজস্ব সমৃদ্ধ সমাজ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ধর্ম-ভাষা ও স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি নিয়ে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। বৈচিত্র্যময় তাদের ভাষা, রীতি-নীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ ও উৎসব-অনুষ্ঠান। বিশ্বায়নের প্রভাব, তথাকথিত আকাশ-সংস্কৃতি ও নানা অপসংস্কৃতির ছোবলে আদিবাসীদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আজ চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন