রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে শিশু জন্মাহার, নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা

fec-image

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ১০০ শিশু। রোহিঙ্গাদের ঊর্ধ্বমুখী জন্মহার যেমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনি বড় সঙ্কটও তৈরি করছে। পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্ব নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। এখন প্রায় দেড় লাখ শিশু রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। যারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক (যদি স্বীকৃত হয়), আবার পিতা-মাতার নাগরিকত্বের সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক নয়। জাতীয়তা এবং নাগরিকত্ব জাবড়া পাকিয়ে আছে। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক জটিল পরিস্থিতি।

ক্যাম্পে সরেজমিনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এক বেলা খায়, আরেক বেলা উপোস থাকে। বেশিরভাগ পরিবারই সন্তান জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশে। কোনো কোনো পরিবারে চারের অধিক সন্তান আছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যেভাবে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে পরামর্শ দেওয়ার কথা ছিল, সেভাবে করা হচ্ছে না। বর্তমানে ১১২টি দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করে ক্যাম্পগুলোতে। বিদেশি অনুদান কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা অর্থও ঠিকভাবে পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, অন্তত অর্ধশত এনজিও লাভবান হচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ ভাগাভাগিও করেছে। যদিও এনজিওর কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, মিয়ানমারে ধন-সম্পদ সবই ছিল তাদের। জান্তা সরকার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে কয়েক বছর ভালোই ছিলেন তারা। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে অনুদান কমেছে।

দেশ রোহিঙ্গাশূন্য করতেই মিয়ানমার সরকার হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছে । এখন মিয়ারমারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ হলেও তারা অর্থনৈতিকভাবে আগের মতো দাঁড়াতে পারবেন না। তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। নতুন করে আবার নিজ বাসভূমিতে ফিরিয়ে নিলে আগে যে পরিমাণ জমিজমা ছিল তা ফিরে পাওয়ার বিষয়েও সংশয় রয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গাদের আবেদন, স্থায়ীভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।

আইএসসিজির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জেআরপিতে ৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে এসেছে মাত্র ৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে ১০০ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৫ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০১৯ সালে ৯২ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার আসে। ২০২০, ২০২১, ২০২২ ও ২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রতিশ্রুতির ৬০, ৭৩ ও ৬৩ ও ৪৫ ভাগ সহায়তা পাওয়া গেছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে তারা। বর্তমান সরকার মানবিক বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দেন। নারী-পুরুষ মিলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১৫টি ক্যাম্প তৈরি করে তারা বসবাস করছে। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, অন্তত ৭টি শর্ত পূরণ হলে তারা দেশে ফিরবেন। শর্তগুলো হচ্ছে- তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে, মিয়ানমারের অন্য নাগরিকরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায় তা তাদের দিতে হবে, মগ ও জান্তার নিয়ন্ত্রণে থাকা সহায়-সম্পদগুলো ফেরত দিতে হবে, গৃহপালিত পশু ফেরত দিতে হবে, গ্রিন কালারের আইডি কার্ড ফেরত ও নতুন করে কার্ড তৈরি করে দিতে হবে ও তাদের ওপর আর অত্যাচার করতে পারবে না। পাশাপাশি তাদের সন্তানদের নাগরিকত্ব দিতে হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি ক্যাম্পেই রোহিঙ্গাদের আনাগোনা বেড়েছে। বিভিন্ন এনজিওর তৎপরতা দেখা গেছে। ব্র্যাক, কষ্ট, মুক্তি, ইউনিসেফ, ডিআরসি, ইউএনএইচসিআর, থাই, এমএসএফসহ অন্তত অর্ধশত এনজিও রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করছে। এনজিওকর্মীরা রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষদের নানা পরামর্শ দেন। শিক্ষালয়ে শিশুদের পড়াশোনা করান। বাংলা ভাষায় কাউকে পড়ানো হয় না। বার্মার ও ইংরেজি ভাষায় শিশুদের পাঠদান হচ্ছে বেশি। ঘনঘন সন্তান না নিতে নারীদের বলা হচ্ছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলা হচ্ছে।

রহিমউল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা জানান, এনজিওরা বিনামূল্যে জন্ম নিয়ন্ত্রক জিনিস সাপ্লাই দিচ্ছে। দুই বছরে তার দুটি সন্তান হয়েছে। এখন সন্তানের সংখ্যা ৫। তিনি জানান, ‘প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে আসছে। আমরা চাই নিজ দেশে ফিরতে। কিন্তু যাওয়ার কয়েক মাস পর সরকারের অত্যাচার আরও বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশেই আসতে হবে।’

জানা গেছে, বর্তমানে ১০ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যেককে ভাউচারের মাধ্যমে প্রতি মাসে ১২ মার্কিন ডলার সমমূল্যের খাদ্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আগে দেওয়া হতো ৩০ ডলারের। ১২৩টি দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করছে। আন্তর্জাতিক এনজিও আছে ২১টি। এসব এনজিও বিভিন্নভাবে অর্থ এনে রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয়ের কথা বলছে। এই অর্থের একটি অংশ ব্যয় হয় এনজিওর কর্মকর্তাদের পেছনে। রোহিঙ্গাদের চাহিদা মেটাতে ৪৩৪.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশে মোট ৪৯৪.২ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছিল। ২০১৮ সালে ৯৫০.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পরিকল্পনা করা হয়। তবে আসে ৬৫৫.০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারপর থেকে অনুদান কম আসছে। কিছু এনজিও লাভবান হচ্ছে বলে কথা রয়েছে।

আরও দেখা গেছে, তালাকের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হিল্লা বিয়ে হচ্ছে। চার সন্তানের জননী এক নারী আগের স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে চাইলে হিল্লাপন্থা বেছে নেওয়া হচ্ছে। তাজনিরমাখলা ক্যাম্পের বি-সি/২০ ব্লকের বায়তুল মোকাররম মসজিদের ইমাম সিরাজুল হক বলেন, নবীজী ৮টি বিয়ে করেছেন। আমরা চারটি বিয়ে করতে পারি। আবার হিল্লা বিয়েও ইসলামে জায়েজ।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বহুকামিতাও ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে সন্তানের সংখ্যা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের একটা অংশ প্রেম-পরকীয়া, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ব্যভিচার, ধর্ষণ, সহিংসতা প্রভৃতিতে জড়িয়ে পড়ছে।

ডেনিস রিফিউজিস কাউন্সিল নামে একটি এনজিওর কর্মকর্তা আবু তাহের বলেন, এখানে শিশুরা বেশি অবহেলিত। তারা সর্দি, কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া প্রভৃতি সমস্যায় ভোগে। বয়স্করা ঠান্ডার সমস্যায় ভোগেন। আর নারী ভোগেন মেয়েলি সমস্যায়। ঘনঘন সন্তান না নিতে তাদের বেশি বলা হচ্ছে। ইউনিসেফের সহযোগিতায় প্রায় শতাধিক স্কুল আছে। ক্যাম্পগুলোতে বিয়ের প্রবণতা বেশি। মাসে চার-পাঁচটি করে বিয়ে হচ্ছে। তবে যৌতুক নেই।

স্কুলশিক্ষক সেকেন্দার হায়াত জানান, ইংরেজি ও বার্মার ভাষায় তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। আনোয়ারা বেগম নামে একজন জানান, বার্মিজ এক হাজার মুদ্রা বাংলাদেশে ৭৭ টাকা। সারা দিন পাহাড়ে লাকড়ি সংগ্রহের পর মংদুর পরীরঢাল হাটে তা বিক্রি করে তিন হাজার টাকা আয় করতেন। মিয়ানমারে চাল, মাছ, ডালের দাম হাতের নাগালে, তাই স্বল্প আয়ের মধ্যেই জীবন পেরিয়ে গেছে। তার স্বামী এখনো নিখোঁজ। প্রাণ বাঁচাতে এ দেশে চলে এসেছেন। সূত্র- দেশ রূপান্তর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন