‘পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাব মোতায়েনের বিরুদ্ধে সারাদেশ জুড়ে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে’

Silver jubilee program4

ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রজতজয়ন্তী পালিত: শহীদদের ক্রেস্ট প্রদান ও লড়াইয়ের চেতনা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) প্রতিষ্ঠার রজত জয়ন্তীতে মঙ্গলবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা পাদদেশে এক সমাবেশ ও র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।    

দালালি-লেজুড়বৃত্তি ও সকল প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ২৫ বছরএই ব্যানারের শ্লোগান সামনে রেখে সকাল ১০:৩০টায় বেলুন উড়িয়ে রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সভাপতি ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) এর সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসাপিসিপি’র রজতজয়ন্তী সফল হোক ফেস্টুন সম্বলিত ২৫ বছরের প্রতীক হিসেবে ২৫টি বেলুন উড়ানো হয়। অনুষ্ঠানের বিশেষত্ব ছিল বিগত আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে নিহত নিহতদের প্রতি সম্মাননা প্রদানের নিদর্শনস্বরূপ নিহত পরিবার প্রতিনিধিদের নিকট ক্রেস্ট প্রদান। সকাল ১০:১৫টায় পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি থুইক্যচিং মারমা অতিথিদের নিয়ে মঞ্চে আরোহন করেন। পিসিপি’র বাছাইকৃত কর্মীগণ মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিদের রজতজয়ন্তীর ব্যাজ পরিয়ে দেন।

অনুষ্ঠানে সংগঠনের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি থুইক্যচিং মারমার সভাপতিত্বে পিসিপি’র সাবেক গুরুত্বপূর্ণ বেশ ক’জন নেতাসহ বন্ধুপ্রতিম জাতীয় প্রগতিশীল সংগঠনের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন পিসিপি’র সাবেক সহ:সভাপতি ও বর্তমানে ইউপিডিএফ-এর সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা, নব্বইয়ের দশকে ছাত্র আন্দোলনের নেতা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সংগঠক ও বর্তমানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, পিসিপি’র সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য ও বর্তমানে ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় সদস্য উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা, ইউপিডিএফ বান্দরবান জেলা শাখার আহ্বায়ক ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি সামিউল আলম রিচি, জাতীয় ছাত্রদলের তৌফিক হাসান পাপ্পু, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর ফাহিম চৌধুরী উদয়, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রীনা দেওয়ান, সাজেক নারী সমাজের সভানেত্রী নিরুপা চাকমা, সাজেক ভূমিরক্ষা কমিটির সভাপতি জ্ঞানেন্দু চাকমা, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য কাজলী ত্রিপুরা,পিসিপি’র প্রাক্তন সহ:সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সংসদের সভাপতি সর্বোত্তম চাকমা ও পিসিপি’র সাবেক সভাপতি দীপঙ্কর ত্রিপুরা।

রজত জয়ন্তী সমাবেশের উদ্বোধক প্রসিত বিকাশ খীসা তার ভাষণে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের গঠনের প্রথম দিকের ইতিহাস স্মরণ করে বলেন, লড়াই সংগ্রামে আপোষহীন ভূমিকা পালন করেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বর্তমান ধারাটিই মূলধারায় পরিণত হয়েছে। সংগ্রামী ধারাকে যেন চেনা না যায় বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে একই নামে সংগঠন সৃষ্টি করা হয়েছে। নুতন প্রজন্মকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে বলে মন্তব্য করেন। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সমর্থনের কথা স্মরণ করেন। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের কথাও স্মরণ করেন তিনি। পরবর্তীতে শাসকচক্রের সাথে আঁতাত করে ভিন্ন পথ ধরার জন্য তিনি দেশের একশ্রেণীর ছাত্রনেতা, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেন। স্বৈরশাসকের সাথে সমঝোতা করে ক্ষমতায় ভাগীদার হবার জন্য তিনি তাদের নিন্দা জানান।

নব্বইয়ের দশকের ছাত্র নেতা বর্তমানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম সমাবেশে বলেন, অপরাজেয় বাংলা হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতীক। এই মূর্তিকে শাসকশ্রেণী শুধু পাথরের মূর্তি হিসেবে দেখাতে চায়। কিন্তু আমরা বিপ্লবীরা তাতে প্রাণ দিতে চাই। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের হাত থেকে বাচতে ’৭১ সালে জনগণ সশস্ত্র লড়াই করেছিল। কিন্তু শাসক গোষ্ঠী চতুরতার সঙ্গে এই লড়াইয়ের ইতিহাসকে গোপন রাখতে চায়। তিনি আরো বলেন, একমাত্র জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামের শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই সকল ধরনের নিপীড়ন নির্যাতনের জবাব দেয়া যায়। তিনি আরো বলেন, জনগণই ইতিহাস সৃষ্টির নায়ক এবং লড়াই সংগ্রামকে অগ্রসর করতে  ইতিহাসের সেই নায়কদের সামনে আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাব মোতায়েনের বিরুদ্ধে সারাদেশ জুড়ে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সিমন চাকমা, শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ওয়াম্রাসং মারমা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন পিসিপি’র সাবেক নেতা মিঠুন চাকমা। রজতজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত এবছরের প্রচারপত্রের শ্লোগানের মূল হেডিং ছিলো- ’৮৯-এর ছাত্র-গণ জাগরণের চেতনা পুনরুজ্জীবিত করুন! পার্বত্য চট্টগ্রামে বিতর্কিত ’র‌্যাব’ মোতায়েনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন!
 
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য কাজলী ত্রিপুরা বলেন, যারা নির্যাতিত হয় তারাই নির্যাতনের মর্ম বোঝে। ঘিলাছড়িতে যখন নারী নারী নির্যাতন সংঘটিত হয় তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রীনা দেওয়ান বলেন, বহু বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। র‌্যাব মোতায়েন করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে যাবে এই কথা বলে তিনি সমতলের সকল বিপ্লবী প্রগতিশীল সংগঠন ও জনগনের প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাব মোতায়েনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার জন্য আহ্বান জানান।

ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি সামিউল আলম রিচি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাব নামিয়ে দিয়ে জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমন করা সম্ভব হবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সংসদের সভাপতি সর্বোত্তম চাকমা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আপোষহীন ধারার সাথে সম্পৃক্ত থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি দীপংকর ত্রিপুরা নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী সমাজকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পতাকাতলে সমবেত করতে সংগঠনের কাজ আরও জোরদার করতে আহ্বান জানান।

সভায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাজ করতে এযাবৎ যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করে নিহতদের পরিবারের কাছে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। ইউপিডিএফএর সভাপতি এই ক্রেস্ট প্রদান করেন।
নিহত ভরদ্বাজমুনির পরিবারের পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার মেয়ে কৃপাবালা চাকমা। নিহত সুকেশ চাকমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার পিতা হামেস কুমার চাকমা, নিহত রূপন চাকমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন শুভপ্রিয় চাকমা।  নিহত মনতোষ চাকমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার ছোটভাই অঙ্গদ চাকমা।  নিহত কুসুমপ্রিয় চাকমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার বড়ভাই শান্তিপ্রিয় চাকমা।  নিহত অমর বিকাশ চাকমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার পিতা চিত্তরঞ্জন চাকমা।  নিহত মংশে মারমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার ছোটভাই চরেম্্রা মারমা।  নিহত দেবোত্তম চাকমার পক্ষ থেকে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা।  নিহত হেমন্ত চাকমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন সুশান্ত চাকমা(ধনমনি)।  নিহত অনিমেষ চাকমার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার ছোটবোন শতাব্দি চাকমা।  নিহত পঞ্চসেন ত্রিপুরার পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তার সহধর্মিনী চম্পা ত্রিপুরা।  নিহত শান্ত চাকমার ছোট ভাই সুশান্ত চাকমা পরিবারের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন।

সভা অনুষ্ঠানের শেষদিকে সভাপতি থুইক্যচিং মারমা উপস্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সকল সদস্যকে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে লড়াই সংগ্রামে আপোষহীন থাকার অঙ্গীকার করতে বলেন এবং উপস্থিত পিসিপির সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে হাত উঁচিয়ে লড়াইয়ে আপোষহীন থাকার শপথ ব্যক্ত করেন। সভা শেষে প্রায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্যদের অংশগ্রহণে একটি বিরাট র‌্যালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে, প্রেসক্লাব ঘুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম হলে এসে সমাপ্ত হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন