লাইলাতুল মে’রাজ : করণীয় ও বর্জনীয় আমল

download

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

মি‘রাজ শব্দের অর্থ উর্ধ্বগমন, উর্ধে আরোহণ, আরোহণের সিঁড়ি। যেহেতু হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর এক মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এজন্য তাঁর এই ভ্রমণকে মি‘রাজ বলা হয়। এ ভ্রমণ যেহেতু রাতের পর রাত অব্যাহত ছিলো, সেজন্যে একে ইসরা’ও বলা হয়। কুরআনুল কারীমে এই শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। নবূয়তের একাদশ ও দ্বাদশ বৎসরের মধ্যবর্তী সময়ে , হিজরতের প্রায় বছর দেড়েক আগে, রজব মাসে রাসূল (স.)-এর মি‘রাজ সংঘটিত হয়। মহানবীর জীবনে সংঘটিত আশ্চর্য বিষয়াবলীর মধ্যে মি‘রাজ অন্যতম। মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধুকে মক্কার মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা এবং তথা হতে উর্ধ্ব জগত পর্যন্ত স্বশরীরে , আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাদি দেখাবার জন্য ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন। এই বিস্ময়কর ঘটনাটি পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈল ও সূরা নাজমে উল্লেখ রয়েছে। এবং অসংখ্য হাদীসে মি‘রাজের ঘটনা বর্ণিত আছে।

একজন মুমিনকে যে সব অদৃশ্য সত্যের প্রতি ঈমান আনতে হয়, মি‘রাজে নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স.)-কে তা স্বচক্ষে দেখানো হয়েছে। তবে ঠিক কোন মাস বা তারিখে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল তা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়নি। রাসূলুল্লাহ (স.) একটি হাদীসেও মি‘রাজের তারিখ বর্ণনা করেননি। সাহাবীগণও কখনো রাসূলুল্লাহ (স.) কে মি‘রাজের তারিখ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেননি। এর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি। পরবর্তী যুগের তাবেঈগণও মিরাজের তারিখ সম্পর্কে কোনো আলোচনা করেননি। মিরাজের রাতের শিক্ষাগুলো ছিল তাদের কাছে মুখ্য। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ ও ঐতিহাসিকগণ যখন এর তারিখ নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা এর তারিখের বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি বরং এ বিষয়ে প্রায় ২০ টি মত রয়েছে। তার কারণ হলো, এ রাতটি সাহাবীদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি হিসেবে পরিচিত ছিলনা। তবে ২৭ তারিখের যে মতটি আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে সেটি তাবেঈ ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণের অনেকগুলো মতের থেকে একটি প্রসিদ্ধ মত। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফরকানী (রহ.) বলেন, মিরাজের ঘটনাটি ৪৫ জন সাহাবায়ে কেরাম হতে নকল করা হয়েছে। (মহাবিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, ড.ঈসা মাহদী)।

মহানবী (স.) মি‘রাজ থেকে ফেরার সময় আল্লাহ তায়ালা তার একনিষ্ঠ ইবাদত ও আনুগত্য হিসেবে মু’মিনদের মি‘রাজস্বরুপ পাঁচ ওয়াক্ত নামায প্রদান করেন। আর পরবর্তী সময়ে তথা মদিনায় হিজরতের পর ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে গেলে তা পরিচালনার জন্য যে নীতিমালা প্রয়োজন হবে তার প্রতি নির্দেশকরত: আল্লাহ নীতিমালা পেশ করেন। সেই মৌলিক নীতিগুলোর উপর সমষ্টিগতভাবে মানবজীবনের মূল ভিত্তি গড়ে তোলাই ইসলামের আসল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। (সূরা বনী ইসরাঈল : ২৩-২৭)।

কুরআনের সে নীতিমালাসমূহ নিম্নরূপ :

০১. এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করা। ০২. পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করা। ০৩. নিকট আত্মীয় ও অভাবীদের অধিকার দেয়া। ০৪. অপব্যয় থেকে বিরত থাকা। ০৫. দুস্থ-অভাবীদের সাথে সুন্দর আচরণ করা। ০৬. অর্থ ব্যয়ে ভারসাম্যতা রক্ষা করা। ০৭. দারিদ্র্যতার ভয়ে সন্তান হত্যা করা যাবেনা। ০৮. যেনা ব্যভিচারের নিকটেও যাওয়া যাবেনা। ০৯. প্রাণ হত্যা না করা। ১০. এতিমের ধনমাল ভক্ষণ না করা। ১১. অঙ্গীকার বা আমানত পূর্ণ করা। ১২. মাপে ওজনে সঠিক দেয়া। ১৩.ভিত্তিহীন ধারণার পেছনে না পড়া। ১৪. যমিনে বাহাদুরী করে চলা যাবেনা।

পাঁচ ওয়াক্ত নামায ছাড়া মি‘রাজ উপলক্ষে আল্লাহর নিকট থেকে আরও দু’টি উপহার পাওয়া গেলো। একটি হচ্ছে সূরা বাকারার শেষ আয়াত সমষ্টি, যাতে ইসলামের মৌল আকীদাগুলো এবং ঈমানের পূর্ণতার বিষয় বিবৃত করার পর এই মর্মে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, মুসিবতের দিন এখন সমাপ্ত-প্রায়। দ্বিতীয় হচ্ছে এই সুসংবাদ যে, উম্মতে মুহাম্মদীর ভেতর যারা অন্তত শিরক থেকে বেঁচে থাকবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।(রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন)।

উল্লেখ্য যে, রজব মাসে আইয়ামে বীজের রোজা ছাড়া অন্য কোন রোযার কথা নবী করীম (স.) বলেননি। পাশাপাশি তাহাজ্জুদ নামায ছাড়া আর কোন নফল নামাযের কথাও বলেননি। হাদীস শরীফে শবে বরাত ও শবে মে‘রাজের নামায বলে কোন নামাযের কথা আসেনি। মি‘রাজের রাত্রিতে বিশেষ নফল নামায আদায়ের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। (হাদীসের নামে জালিয়াতি : প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর)। রাসূলুল্লাহ (স.) শুধু বিশেষ কোন রাত্রিতে নামায পড়তেন না। এবং বিশেষ কোন রাত্রিতে তা পড়ার জন্য তিনি কাউকে বলেননি। তবে রামাদান মাসে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে দুই ভাবে।

প্রথমত : সাধারণভাবে রামাদানে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে। দ্বিতীয়ত: লাইলাতুল কাদরে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে। কিন্তু অন্য কোন বিশেষ রাত্রির বিশেষ কিয়ামের কথা কোন হাদীসে আসেনি। এমনকি কদরের রাতে যে কিয়ামের কথা বলা হয়েছে তার নামও কিন্তু কদরের রাতের নামায নয়। আর শবে মি‘রাজ ও শবে বরাতের নামাযের কথা তো বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশের কোন কোন এলাকার মসজিদে এই দুই রাত্রিতে জামা‘তের সাথে ১২ রাক‘আত নামায আদায় করা হয় এবং এই নামায শেষে আবার রামাদানের মত বিতরের নামাযকেও জামা‘আতেরসাথে আদায় করা হয়। রজব মাসের কোনো রাতের বিশেষ ফজিলতের কোনো বর্ণনা বা মেরাজের রাতের ফজিলত সম্পর্কে যে কয়টি হাদীস আমাদের সমাজে চালু আছে তার প্রায় সবগুলোই মুহাদ্দিসগণের বিচারে জাল ও বানোয়াট। বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থে পাওয়া না গেলেও কয়েকজন মুহাদ্দিস দুর্বল সনদে রজবের প্রথম রাতে দু‘আ কবুল হওয়া সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। (মুসান্নাফু আব্দুর রাজ্জাক, ৪র্থ খ-,পৃষ্ঠা.৩১৭)।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তকে সেই দুর্বল হাদীসের ফযীলতের বর্ণনা বিদ্যমান। লাইলাতুল মেরাজের রোজা ও বিশেষ ইবাদাত সেই বর্ণনারই অংশ মাত্র। (বিদ‘আতের রেড়াজালে ইবাদাত)। মিরাজের রাত নিয়ে এরূপ বাড়াবাড়ি এবং বিশেষ বিশেষ ইবাদতের প্রচলন নি:সন্দেহে দীনের মধ্যে নতুনত্ব আরোপ তথা বিদ‘আত।(বিদ‘আতের পরিচয় ও পরিণাম, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)। দাওয়াতি কাজের উদ্দেশ্য- যাতে প্রকৃত বিষয়গুলো মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। কোন ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য নয় বরং নানা বিভ্রান্তি দূর করাই লেখার স্বার্থকতা। ইবাদতের ক্ষেত্রে আবেগ দিয়ে কোন বিষয় লেখা ঠিক নয়। তাই সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে আমল করা সকল মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে কুরআন-হাদীস বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন