ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে বাধ্যতামূলক হচ্ছে ভোকেশনাল শিক্ষা

fec-image

২০২১ সালে ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীতে সব শিক্ষার্থীকে ভোকেশনাল শিক্ষা নিতে হবে। আগামী বছর আরও ৬৪০ স্কুল-মাদ্রাসায় মাধ্যমিকে চালু হবে ভোকেশনাল শাখা। এজন্য সরকারের বেতন-ভাতায় বার্ষিক ব্যয় বাড়বে ১৪৫৭ কোটি টাকা।

ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই বাধ্যতামূলক ভোকেশনাল (বৃত্তিমূলক) শিক্ষা চালু হচ্ছে। হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর প্রতিটি শিক্ষার্থী গ্রহণ করবে এই প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা। এছাড়া নবম-দশম শ্রেণীর প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষার্থীকেও নিতে হবে এই শিক্ষা।

পাশাপাশি ভোকেশনাল শিক্ষার বিস্তারে নতুন করে আরও ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল শাখা খোলা হবে।

বর্তমানে ১ হাজার ৯৯৩টি প্রতিষ্ঠানে এই শাখা চালু আছে।

মাধ্যমিকে ভোকেশনাল শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদেরকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষা নিতে হবে।

এসব উদ্যোগের ফলে পঞ্চম শ্রেণীর পরই একজন শিক্ষার্থীর কারিগরি শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। এতে দক্ষ জনবল তৈরি হবে, যা টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা।

এসব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে রবিবার (১৯ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়।

সভায় ২০২১ সালে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। বৈঠকে আগামী বছর ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণীতে ভোকেশনাল শাখা চালুর সিদ্ধান্তও হয়।

জানা গেছে, ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীর ধারাবাহিকতায় সভায় দেশের ৩০ হাজার স্কুল-মাদ্রাসার নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্যও ভোকেশনালের কমপক্ষে একটি করে ট্রেড চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে ২৭ মে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী বিশ্বে নতুন প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দক্ষতা। দক্ষতা না থাকলে প্রতিযোগিতাশীল বিশ্বে কেউ টিকে থাকতে পারবে না।

এ কারণে শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকার প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়।

এই লক্ষ্য অর্জনে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিু মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সাধারণ ধারার প্রতিটি স্কুল-মাদ্রাসায় প্রাক-বৃত্তি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগের রূপকল্প-২০৪১, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আলোকে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও সাধারণ শিক্ষা ধারায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কোর্স চালুর কথা উল্লেখ আছে।

ভোকেশনাল শিক্ষা চালুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনটি অংশ আলাদা করা হয়েছে- ৬৪০টি মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-মাদ্রাসায় (নবম-দশম) বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু, নিম্ন মাধ্যমিক (ষষ্ঠ-অষ্টম) পর্যায়ের সব প্রতিষ্ঠানে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের সব প্রতিষ্ঠানে (সব স্কুল ও মাদ্রাসা) বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু। ইতিমধ্যে প্রথম দুই অংশের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে এবং প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু হয়েছে। তৃতীয় অংশের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে আগামী ২৭ মে ফের সভা বসবে। এর আগে একটি কমিটিকে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষা খাত বিনিয়োগ কর্মসূচির (সেসিপ) থেকে নতুন এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে। লক্ষ্য অনুযায়ী প্রাক-বৃত্তিমূলক স্তরের প্রতি শ্রেণীতে একটি করে ট্রেড থাকবে। এর নাম চিন্তা করা হয়েছে- প্রকৌশল-১ (ষষ্ঠ), প্রকৌশল-২ (সপ্তম) ও প্রকৌশল-৩ (অষ্টম)। আর নবম শ্রেণীর প্রতিটি বিভাগের (বিজ্ঞান, মানবিক ও বিজনেস স্টাডিজ) শিক্ষার্থীকেই বৃত্তিমূলক শিক্ষার অংশ হিসেবে প্রবর্তিত ট্রেড (বিষয়) নিতে হবে।

জানা গেছে, এই দুটি দিক চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে একটি সভা গত ৫ মে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগে হয়। অতিরিক্ত সচিব একেএম জাকির হোসেন ভূঞার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীতে ভোকেশনাল শিক্ষা চালু করার ক্রেডিট আওয়ার নির্ধারণসহ দক্ষতা মান অর্জনে ১০০ নম্বরের বিষয় চালু, কোর্স পরিচালনার উপকরণ, শিক্ষক নিয়োগ এবং পাঠদানের রুটিন, বিষয়ের নম্বর বণ্টনসহ বিভিন্ন কাজ রয়েছে। বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২১ সাল থেকে ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীতে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত হয়।

মাধ্যমিকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা:

ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীর ধারাবাহিকতায় নবম-দশম শ্রেণীর প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অন্তত একটি ট্রেডে হলেও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়ার আলোচনা হয় সভায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের ৩০ হাজার স্কুল-মাদ্রাসাতেই একটি করে ট্রেডে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করা হলে অন্তত ৩০ হাজার শিক্ষকসহ ১ লাখ ২০ হাজার জনবল নিয়োগ করতে হবে। সেটা বিশাল খরচের ব্যাপার। তারপরও প্রস্তাব অনুযায়ী একটি করে ট্রেডে ভোকেশনাল শিক্ষা চালু করতে শিক্ষক নিয়োগ ও এমপিওভুক্তি, কারিকুলাম ও পাঠ্যবই তৈরি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ল্যাবরেটরি নির্মাণসহ সংশ্লিষ্ট খাতে কত টাকা লাগবে, তা নির্ধারণের জন্য সভায় একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কমিটি এ ব্যাপারে বিস্তারিত রোডম্যাপ তৈরি করবে। ওই কমিটির প্রতিবেদনসহ পরবর্তী সভা ২৭ মে হবে।

৬৪০ প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল শাখা:

বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিস্তারে আরও দুটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে- ৬৪০টি স্কুল ও মাদ্রাসায় ভোকেশনাল শাখা চালু এবং যে কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে ভোকেশনাল শিক্ষা চালু করতে পারবে।

দ্বিতীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বলা হয়, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান নিজে ল্যাবরেটরি ও অবকাঠামো তৈরি করে ভোকেশনাল চালু করে তাহলে সরকার শিক্ষকদের বেতনভাতা বা এমপিও দেবে।

বর্তমানে ১ হাজার ৯৯৩টি স্কুল ও মাদ্রাসায় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শাখা হিসেবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু আছে। নতুন আরও ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল শিক্ষা যুক্ত হলে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হবে ২৫৩৩টি। নতুন প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল শিক্ষা চালু করতে ইতিমধ্যে কারিগরি বোর্ড ১২টি ট্রেড নির্বাচন করেছে। প্রাথমিকভাবে পছন্দ অনুসারে দুটি করে ট্রেড চালু করতে পারবে। জানা গেছে, আঞ্চলিক চাহিদা অনুযায়ী ট্রেডগুলো দেয়া হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ৬৪০ প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল চালু করতে চাহিদা নিরূপণ শেষে কাজ বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ৬১৪টিতে অতিরিক্ত ৩টি শ্রেণীকক্ষ নির্মাণের কাজ চলছে। সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে।

এছাড়া অন্যান্য কাজ শেষ করতে ইতিমধ্যে কারিগরি বোর্ড, সেসিপ এবং এনটিআরসিএকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৭৯৭ কোটি টাকা লাগবে বলে প্রাথমিক হিসাবে উঠে এসেছে।

উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৩ হাজার ৮২০টি স্কুল-মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত আছে। এমপিওবিহীন আছে আরও ৬ সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান। নতুন ৬৪০টিসহ ২ হাজার ৫৩৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃত্তিমূলক শিক্ষার আওতাভুক্ত হবে।

এক হিসাবে দেখা গেছে, এমপিওভুক্ত অবশিষ্ট ২১ হাজার ১৮৭টি মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণীতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করতে গেলে ন্যূনতম ২ জন ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর, ১ জন কম্পিউটার প্রদর্শক এবং ১ জন ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট/শপ অ্যাসিসটেন্ট/কম্পিউটার ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট প্রয়োজন হবে। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিওভুক্তির জন্য সরকারের ব্যয় হবে ১ হাজার ৪৫৬ কোটি ৮১ লাখ ৮১ হাজার টাকা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন