ইহুদি বসতি ছিল সাজেকে

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকুরিতে সর্বপথম যে ক্যাম্পে আমি উঠি সেটা কাসালং ভ্যালির মাসালং আর্মি ক্যাম্প; সময়টা ১৯৮৭ সাল। তখন আমি তরুণ লেফটেন্যান্ট। ক্যাম্পে উঠি না বলে, নামি বলাই অধিক যুক্তিসংগত। কেননা, মাসালং ক্যাম্প এবং ক্যাম্প সংলগ্ন মাসালং বাজারটি সমতল একটি ভ্যালিতে দুই নদীর মোহনায় অবস্থিত ছিল। আমাদের জোন সদর ছিল বাঘাইহাট। সেখান থেকে ১৪/১৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে, পাহাড় মাড়িয়ে এসে এই সমতল স্থানটিতে নামতে হতো।

উল্লিখিত নদী দুটির একটির নাম কাসালং এবং অন্যটির নাম মাসালং। কাসালং বড় এবং মাসালং ছোট। নদী হিসাবে কাসালং মোটামুটি ঠিক আছে, কিন্তু মাসালংকে নদী না বলে ঝিরি বা ছড়া বলাই ভাল। মাসালং এলাকাটি রাংগামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত হলেও এখানে পৌঁছাতে হয় খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও বাঘাইহাট হয়ে। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা হয়ে বাঘাইহাট পর্যন্ত তখন ইটের (brick soling) রাস্তা ছিল।

মাসালং সেনা ক্যাম্প থেকে ১২/১৩ কিলোমিটার পূর্বদিকে ছিল সাজেকের অবস্থান। সেখানে সামরিক/আধা সামরিক উপস্থিতি হিসেবে পাকিস্তান আমল থেকেই ছিল একটি বিওপি, যা ছিল বিজিবি’র একটি কোম্পানি সদর। আর মাসালং বাজারে ছিল একটি পুলিশ ফাঁড়ি। সেই সময় সাজেকের অধিবাসী হিসেবে আশে পাশে ছিল কিছু পাহাড়ী বসতি। যারা মূলত ছিল মিজোরামের লুসাই নৃগোষ্ঠীর অন্তর্গত এবং অনেক আগেই তারা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গেছে। সাজেক তখন নিতান্তই নিরব নিভৃত আর অগম্য (inaccessible) একটি এলাকা/ভ্যালি ছিল। পর্যটন বা পর্যটন কেন্দ্রের কোনো আভাস সেখানে মোটেই ছিল না, এমনকি বাইরের কোনো কাক পক্ষীও তার খবর জানতো না।

১৯৮৭ সালে আমার প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্যাম্প জীবন শুরু হলেও সৈনিক জীবনে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ আমার ১৯৮৬’র প্রথম দিকে। তখন আমার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। আমাদের ইউনিটের একটি ক্যাম্প ছিল খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাংগায়। আমি তখন সবেমাত্র কমিশন পেয়ে জয়েন করেছি আমার ইউনিটে; রেজিমেন্টেশন চলছে। সেনাবাহিনীর নতুন কমিশন প্রাপ্ত অফিসারগণ হচ্ছে সদ্যজাত শিশুর মতো। তাদের হাতে ধরে ধরে সব কাজ তথা সব এপয়েন্টমেন্ট, পদ-পদবীর দায় দায়িত্ব ইত্যাদি শেখানো হয় মাস খানেক। এই সময়কালটাকেই রেজিমেন্টেশন পিরিয়ড বলা হয়। এই সময়টাতে ইউনিটের মালি, ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে অধিনায়ক পর্যন্ত সবাই তার প্রশিক্ষক/শিক্ষক এবং সে সবার ছাত্র। ‘বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র…,’ অনেকটা সেই দশা আমার।

রেজিমেন্টেশন চলাকালীন অবস্থায় খাওয়া, থাকা এবং রাতে ঘুমানো সবই করতে হয় সৈনিকদের সাথে একত্রে, তাদের মেসে/ব্যারাকে। সেই রেজিমেন্টেশনেরই এক প্রশিক্ষণ হিসেবে একদিন আমাকে ছোট এক কনভয়ের সাথে কনভয় কমান্ডারের দায়িত্ব এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী অধ্যুষিত এলাকায় গাড়ি নিয়ে মুভ করার কৌশল শেখানোর জন্য পাঠানো হলে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আমাদের মাটিরাংগা ক্যাম্পে। সেই আমার প্রথম পাহাড় তথা পার্বত্যচট্টগ্রাম যাত্রা।

ফটিকছড়ি বাজার পার হয়ে আমতলি নামক স্থানে কনভয় থামিয়ে সবাইকে নামিয়ে সারিবদ্ধ করে সবার অস্ত্রে লাইভ এমুনিশন লোড করানো হলো। এতক্ষণ অস্ত্র এবং গুলি আলাদা আলাদা অবস্থানে ছিল; অস্ত্র ছিল কাঁধে কিংবা হাতে আর গুলি পৌচে (pouch)। এখান থেকে অস্ত্র সর্বদা লোডেড অবস্থায় থাকবে। কারণ, আমতলির পরই খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি থানার সীমানা। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সন্ত্রাস/শান্তিবাহিনী অধ্যুষিত এলাকা শুরু। তাই সদা প্রস্তুত; চোখ কান দেমাগ সর্বদা হুঁশিয়ার।

অস্ত্র লোডিং শেষে আবার যাত্রা শুরু হলো। গাড়িগুলো ধীরে ধীরে বন পাহাড়ের নির্জনতা খান খান করে ঘড় ঘড় শব্দে উপরে উঠা শুরু করলো। শুরু হলো আমার প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনী অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ। তবে সেদিন আমার বিশেষ কোনো অপারেশনাল দায় দায়িত্ব না থাকায় শিক্ষানবিশ হিসাবে মেহমানের মতো যাওয়া এবং একদিন থেকে আবার মেহমানের মতো ফিরে আসা। সাথে করে নিয়ে এলাম পাহাড়ে ঢুকার প্রথম অভিজ্ঞতা। তবে এই বিষয়ে আজ আমি বিস্তারিত কিছু লিখিবো না। কারণ আজ আমার প্রধান স্মৃতিচারণ থাকবে আমার জীবনের প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্যাম্প জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে।

বলছিলাম মাসালং ক্যাম্পের কথা। মাসালং ক্যাম্পে আমার অবস্থান অল্প সময়ের জন্য হলেও সময়টি ছিল খুব মধুর। যৌবনের প্রথম প্রহর, দু’চোখে যা দেখি তাই ভাল লাগে, রোমানাটিক লাগে। দৈনিন্দিন কাজ/ টহল কার্যক্রমের মধ্যেও রোমাঞ্চ খুঁজে পাই। দু’এক দিন পর পর নিবেদিতপ্রাণ (Diehard) একদল সৈন্য নিয়ে নির্জন নিভৃত মাসালং-সাজেক ভ্যালির ছড়া ঝিরি চড়াই-উতরাই চষে বেড়ানোর মধ্যেও ছিল রোমাঞ্চের হাতছানি। যতদিন ছিলাম সেই ক্যাম্পে তখন প্রতিমাসেই দু’একবার দুরপাল্লার টহলে (LRP অর্থাৎ Long Range Patrol) সাজেক যেতাম মূলত এলাকার উপর আমাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। মাসালং ক্যাম্প থেকে সাজেক যাওয়ার জন্য তখন আমরা কিছুদূর মাসালং ছড়ার ঝিরিপথ এবং তারপর পাহাড়ী চড়াই-উতরাই পথ ব্যবহার করতাম।

সাজেকের নাম তখন লোকজন তেমন একটা না জানলেও সাজেকের কমলা সেই সময় বেশ বিখ্যাত ছিল। সাজেকের এই কমলা অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে সাজেকে উৎপন্ন হতো না; পার্শ্ববর্তী মিজোরাম থেকে আসতো। যেমন আমরা আগে বলতে শুনতাম, ‘ছাতকের কমলা’। আসলে ছাতকেও কখনো বাণিজ্যিকভাবে কোনো কমলা উৎপন্ন হতো না; কমলা আসতো মেঘালয় থেকে।

আমি যে সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে সাজেকে আমি ছোট একটি ইহুদি বসতিও দেখেছিলাম। সম্ভবত এটাই বাংলাদেশে বসবাসকারী কোনো ইহুদি বসতি ছিল। এই ইহুদিরা পার্শ্ববর্তী মিজোরাম রাজ্য থেকে এসেছিল। মিজোরামে তখন মেনাশি গোত্রের (Bnei Menashe) একটি ইহুদি জাতির বসবাস ছিল। তারা খ্রিস্টান থেকে কনভার্ট হয়েছিল এবং তারা নিজেদের হারানো দশটি ইহুদি জাতির (10 Lost Jewish Tribes) একটি বলে দাবি করতো। এখন বোধহয় সেই ইহুদি বসতি আর সাজেকে নেই। পর্যটনের কারণেই হোক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক হয়তো মিজোরামে ফিরে গেছে। শুনেছি মিজোরামে এখনো ইহুদিদের একটি ট্রাইব/গোত্র বসবাস করে।

মাসালং বাজার তখন ছিল কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলি পেপার মিলের (KPM) প্রধান কাঁচামাল তথা বাঁশ কালেকশনের অন্যতম কেন্দ্র। মাসালং ক্যাম্পে যে ঘরে আমি থাকতাম, তা ছিল KPM এর একটি ডাকবাংলো। যা মাসালং ক্যাম্প কমান্ডারের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রিসোর্ট টাইপ সেই কাঠের বাংলোটি ছিল ঠিক কাসালং নদীর পাড়েই।

যেদিন বৃষ্টি হতো, সেদিন কাসালং নদীতে বইতো প্রচন্ড স্রোত। বড় বড় শিলাখন্ডে আঘাত পেয়ে/বাধাগ্রস্ত হয়ে সেই স্রোতের গর্জন হয়ে উঠতো ভয়ংকর। রাতের বেলা সে গর্জন আরো তীব্র হয়ে উঠতো কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারতো না মোটেই। নদীর উপর সেই ঘরে শুয়ে নদীর কলতান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পরতাম টেরই পেতাম না।

শুধু মাঝে মধ্যে রাতের নির্জনতা খান খান করে, সমগ্র বনভূমি প্রকম্পিত করে গর্জে উঠতো বারশিঙ্গা সাম্বার হরিণের ডাক। সেই ডাক পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে মুখরিত করে তুলতো সমগ্র বন, পাহাড় আর উপত্যকা।

তক্ষকের (gecko) কথা কি আর বলবো; দিনরাত, যখন তখন একটা রিদমিক ফ্রিকোয়েন্সিতে চড়া ও স্পষ্ট স্বরে ডেকে উঠে কান ঝালাপালা করে তুলতো এই সরীসৃপটি। আমার বাংলোর কারের (ceiling) উপরেও ছিল ওদের বাসা। তক্ষকের ডাক অনেক দূর থেকে শোনা যায়। কক্‌কক্‌ আওয়াজ দিয়ে ডাক শুরু হয়, অতঃপর ‘তক্‌-ক্কা’, ‘তক্‌-ক্কা’ ডাকে বেশ কয়েক বার চলতে থাকে এবং শেষের দিকে স্বর নিচু হয়ে আসে।

এই ক্যাম্পেই আমি জীবনে প্রথম ধনেশ পাখি (Pied Hornbill) দেখেছিলাম তার প্রাকৃতিক পরিবেশে। প্রায়ই সন্ধ্যার প্রাক্কালে সুবিশাল ঠোঁট বিশিষ্ট বিশাল আকৃতির এই পাখি ঝাঁক বেঁধে ক্যাম্পের উপর দিয়ে বেশ নিচু হয়েই উড়ে যেত নীড়ে। উড়ার সময় এদের বিশাল পাখার সঞ্চালনে এক ধরনের অদ্বুদ অদ্ভুত (অনেকটা ধীর লয়ের তুলোধোনার মতো) শব্দ হতো।

কাসালং নদীর পাড়ে অবস্থিত হওয়ার কারণে এই ক্যাম্পে আমাদের আরো একটি মজার বিষয় ও সুবিধা ছিল; প্রতিদিন ফ্রেস মাছ খাওয়া। এই জন্য সৈনিকদের মধ্যে যারা মাছ ধরায় পারদর্শী ছিল, তাদের দিয়ে একটি মৎস শিকার পার্টি গঠন করা হয়েছিল। বড়শি দিয়েও যখন তখন মাছ ধরা যেত। একবার বিশাল একটা রুই (দশ কেজি তো হবেই) ধরেছিল ওরা। রাতে মেস ইনচার্জ সেই মাছের বিশাল মাথাটি ভুনা করে আমার টেবিলে এনে হাজির। আমার মনে হয়, কোনো শাশুড়ি তার মেয়ে জামাইয়ের পাতে এমন একটি মাছের মাথা তুলে দিতে পারলে ধন্য হয়ে যেত! অবশ্য পুরোটা মাথা খেতে পারিনি আমি। বাকিটা ওরা ভাগাভাগি করে খেয়েছিল।

এই ক্যাম্পেই আমি প্রথম হরিণের মাংশ খাই। সেটাও এই নদী থেকে পাওয়া। স্রোতের তোড়ে আহত হয়ে ভেসে এসেছিল মাঝারি সাইজের এক সাম্বার হরিণ। আটকে ছিল এক বড় পাথরে। আমরা ক্যাম্পের প্রায় চল্লিশ জন সদস্য কয়েক বেলা খেয়েছিলাম সেই হরিণের মাংশ।

মাসালং-সাজেক ভ্যালি নিয়ে তাই আমার অনেক স্মৃতি। কিন্তু আজ সাজেক ভ্যালির এই ড্রোন ছবিতে এত রংচঙে সাজেক দেখে সত্যি অবাক ও হতাশ হয়েছি; মনও খারাপ হয়েছে। পর্যটনকে বিকাশের নামে সাজেকের এই আমূল পরিবর্তন গ্রহণ করতে পারলাম না। আমি পর্যটন বিরোধী নই; পর্যটনের নান্দনিক বিকাশ হোক সেটা আমিও চাই। তবে একটা পরিকল্পনা মাফিক এগুনো উচিত। সাজেকে আজ যত্রতত্র অপরিকল্পিত অজস্র রঙবেরঙ ঘরবাড়ি, হোটেল, রেসোর্ট, বাংলোর সমাহার আর রাতের বেলা আলোর ঝলকানি। পাহাড়ের নিরবতা আর নির্জনতা খান খান করে ভেঙে দিনভর সাজেক পানে ছুটে চলেছে যান্ত্রিক সব বাহন। আমি যখন মাসালং ছড়া বেয়ে টহল করতে করতে সাজেক ভ্যালি ঘুরে বেড়াতাম তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি, দূর পার্বত্য চট্টগ্রামের নিভৃত এই অগম্য সাজেকের এই পাহাড়ী পাড়া/বসতি এমনভাবে তার রূপ বদলাবে। (৩১/০১/২০২২)

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন