সৌদি আরব থেকেও বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা

fec-image

এবার বাঙালি সেজে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসছে রোহিঙ্গারা। গত দুই মাসে শতাধিক রোহিঙ্গা সৌদি আরব থেকে ফেরত এসে কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তারা জানিয়েছে, সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশি কূটনীতিকরা টাকার বিনিময়ে ও দালালদের মাধ্যমে আটক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরার কাগজ সরবরাহ করছে।

এর আগে গত জানুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বসবাস করা ১৩ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছিল সৌদি আরব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ শরাণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা বেশ কিছু রোহিঙ্গা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এর কার্যালয়ে যৌথ নিবন্ধন সক্ষাৎকার গ্রহণের অনুমতি চেয়ে ক্যাম্প ইনচার্জকে লিখিত আবেদন করেছে। তবে আমরা এখনও কাউকে অনুমতি দেইনি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’

কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোয় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সৌদি আরবসহ নানা দেশে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

সরেজমিনে টেকনাফের নয়াপাড়া, মৌচনি ও লেদা শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা, সেখানকার বাসিন্দা ও ফেরত আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই মাসে শতাধিক রোহিঙ্গা সৌদি আরব থেকে ফেরত এসে এসব ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা রোহিঙ্গাও রয়েছে তাদের মধ্যে। ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের দাবি, দালালদের সহযোগিতায় সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে অবৈধ কাগজপত্র নিয়ে বাঙালি সেজে এদেশে ফিরে এসেছে তারা। তাদের মধ্যে অনেকেই ফেরত আসার আগে সৌদি পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর কারাগারেও ছিল।

সৌদি আরব থেকে ফিরে কক্সবাজারের টেকনাফের নয়াপাড়া মৌচনি ক্যাম্পের ই-ব্লকে আশ্রয় নিয়েছেন শমসুল আলম (৩২)। তার বাড়ি মিয়ানমারের হইজ্যাবিল গ্রামে। বুধবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে ওই শিবিরের ছোট একটি পানের দোকানে শমসুল আলমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানিয়েছেন, ‘মিয়ানমার থেকে এসে ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশি হিসেবে ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে কাতার হয়ে সৌদি আরবে যাই। ৯ লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি ও বাংলাদেশের দালালের মাধ্যমে বাঙালি পাসপোর্ট করাই। পাসপোর্টে নাম ছিল আজিম উল্লাহ। সৌদিতে পৌঁছার পর সেদেশে আগে থেকে বসবাসকারী মামা ছলিম উল্লাহ আমাকে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে জেদ্দায় ফার্নিচারের কারখানায় চাকরি হয়। এভাবে চার বছর চলে যায়। এরপর গত বছরের শুরুতে হঠাৎ ফার্নিচার কারখানা থেকে সেদেশের পুলিশ আমাকে আটক করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। কারাগারে দুটি বছর কেটে যায়। এরপর দালালের মাধ্যমে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি হয়। ১৭’শ রিয়াল (বাংলাদেশি প্রায় ৪০ হাজার টাকা) আমাকে বাঙালি সাজিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা হয়। আমার মামা টাকা পরিশোধ করার তিনদিন পর আমাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পরও আমাকে আটকানো হয়েছিল। সেখানে ৫০ রিয়াল দিলে ছেড়ে দেয় সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা। অবশেষে বাসে করে টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে পরিবারের কাছে পৌঁছাই। দুই বছর আগে আমার পরিবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা আট জন রোহিঙ্গা একসঙ্গে ফেরত আসি সৌদি আরব থেকে।’

অক্টোবরের মাঝামাঝিতে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে ফেরেন মোহাম্মদ হারুন (৫০) নামে এক রোহিঙ্গা। তিনি টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ-ব্লকে আশ্রয় নিয়েছেন। টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জকে একটি লিখিত আবেদন করেন তিনি। আবদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত চার বছর তিনি সৌদি আরবে অবস্থান করায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয়ে যৌথ নিবন্ধন সক্ষাৎকার দিতে পারেননি। তিনি ‘একজন খাঁটি রোহিঙ্গা’ হিসেবে এখন এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার অনুমতি চান।

মোহাম্মদ হারুন জানালেন, ‘সৌদি আরব যেতে চার বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছিলাম। পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে এখান থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে যাই। সেদেশে একটি দোকানে চাকরি করছিলাম। কিন্তু আকামার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও থেকে যাই। নতুন করে আকামা বা কাজের অনুমতি নিতে অনেক টাকা লাগে বলে তা নেইনি। এখানে ফেরার আগে সৌদি পুলিশের হাতে আটক হয়ে সেখানকার কারাগারে ছিলাম।’

তিনি আরও জানান, ‘এখন সৌদি পুলিশ অবৈধভাবে বসবাসকারীদের ধরে ধরে ফেরত পাঠাচ্ছে। সেদেশে অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে। কিন্তু মিয়ানমার কোনও রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায় না। ফলে রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশি কিছু কর্মকর্তাকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে বাঙালি সেজে এদেশে ফেরত আসছে। আমিও কিছু টাকা দিয়েছি।’  কিন্তু টাকার পরিমাণ বলতে চাননি।

মোহাম্মদ হারুনের সঙ্গে আসা আরও এক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের রামুতে আশ্রয় নিয়েছেন। একই কথা বলেছেন সদ্য সৌদিফেরত মোহাম্মদ নুর ও ইলিয়াছসহ বেশ কয়েকজন। তারা ইতোমধ্যে ক্যাম্পে ইনচার্জের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন ইউএনএইচসিআর এর নিবন্ধন তালিকায় নাম লেখানোর জন্য।

তবে ইউএনএইচসিআর এর কক্সবাজারের মুখপাত্র লুইস ডনোভান বলেছেন, সৌদি আরব থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ফেরত আসছে, এমন খবর তাদের কাছে নেই।

টেকনাফ মৌচনি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ জসিম বলেন, ‘আমার ক্যাম্পে ১০ জনের বেশি রোহিঙ্গা বাঙালি সেজে সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছে। তার মধ্যে কিছু রোহিঙ্গা ত্রাণ সামগ্রী পাচ্ছে। আবার অনেকে ত্রাণের জন্য আবেদন করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ শমসু আলম নামে এক রোহিঙ্গা সৌদি আরব থেকে এসে এই ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। সে জানিয়েছে সৌদি কারাগারে অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে। তারাও এই দেশে ফেরার চেষ্টা করছে। তবে যাদের কাছে টাকা-পয়সা রয়েছে তারাই আসতে পারছে। কেননা টাকা দিলে তাদের বাঙালি বানিয়ে এই দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।’

সৌদি আরবের দুই বছরেরও বেশি সময় বন্দি থেকে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন রোহিঙ্গা ছানা উল্লাহ। তিনি জানান, ‘বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়ে সৌদি আরব যাই, আবার কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েই ফেরত আসি। রোহিঙ্গাদের কোনও রাষ্ট্র নেই। তাই আমাদের কূটনীতিক সুবিধা পাওয়া কঠিন। ভারত, নেপাল কিংবা পাকিস্তান দূতাবাসে আবেদন করলেও সাড়া মেলে না। সৌদি আরবে থাকা বাংলাদেশি কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে আমাকে কাগজ দিয়েছেন। পরে বাঙালি সেজে এই দেশে চলে আসি। আমার মতো অনেককে কাগজ দিতে কর্মকর্তারা ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়ে থাকেন। তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে এই অর্থ নেন তারা। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বন্দিরা এক কক্ষে না থাকলেও টাকা দিলে তারা বাংলাদেশিদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সহায়তা করেন। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সৌদি রিয়াল দিলে কাগজপত্র করে দেয়। আমরা অনেক টাকা খরচ করে বাংলাদেশে এসেছি।’

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি এবং টেকনাফের জাদিমুড়া ও শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা খালিদ হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা কিছু রোহিঙ্গা কাগজপত্র দেখিয়ে আমার আওতাধীন শিবিরে লিখিত আবেদন করেছে। এ বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। তবে এখনও কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।’

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বলেন, ‘সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়ার খবর শুনেছি। তবে তারা কীভাবে এদেশে পৌঁছেছে তা জানা নেই। তবে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।’

এ দিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবেন জানতে চাইলে কোনও উত্তর দেননি ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা।

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই গোটা বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়।’

সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন থেকে পাসপোর্ট পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জেদ্দায় আমাদের মিশনে প্রায় ৬০ জন লোক কাজ করে এবং এর মধ্যে মাত্র দুজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এবং তারা কেউই পাসপোর্ট সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত নয়।’

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ ও জেদ্দায় পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ দেখাশুনা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে লোক পাঠানো হয়।

পাসপোর্ট কীভাবে ইস্যু হয়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে কোনও ব্যক্তি আবেদন করলে নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই করার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। এখানকার রিপোর্ট পাওয়া সাপেক্ষে সৌদি আরবে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।’

সূত্র: ইনকিলাব

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কূটনীতিকরা, বাঙালি সেজে, রোহিঙ্গারা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন