হিন্দু রোহিঙ্গাদের আদর-যত্নে রাখার নেপথ্যে

পার্বত্যনউজ ডেস্ক:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড়-জঙ্গলে যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রয় নিয়ে লতাপাতা খেয়ে কোনো মতে বেঁচে আছেন, সেনাবাহিনী তাদেরকেও খুঁজে বের করে আটক করছে। আবার পালিয়ে আসার পথে সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেকে। নির্যাতনের শিকার কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদীর ওপারে নো ম্যানস ল্যান্ডে এসে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁবু থেকে কেউ বের হতে পারছেন না। এসব রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ সুপেয় পানি ও খাদ্যাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে মারাও যাচ্ছেন।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আরো জানান, তাদের পাশাপাশি আকিয়াব ও বুচিডংয়ের বিভিন্ন গ্রামের অনেক মানুষ বাংলাদেশে আসার জন্য সীমান্তে জড়ো হয়েছেন। নো ম্যানস ল্যান্ডের দামনখালী, নাইক্ষ্যংদিয়া ও খুন্নাই্যাপাড়া এলাকায় তাঁবু করে অপেক্ষা করছেন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণপাড়া সীমান্ত থেকে এসব তাঁবু প্রত্যক্ষ করছেন সীমান্তের বাসিন্দারা। এসব রোহিঙ্গার বেশির ভাগই রাখাইনের বুচিডং ও রাচিডং এলাকা থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য নো ম্যানস ল্যান্ডে আসেন। গতকাল রোববার সকালে একটি শিশু নাফ নদীর লবণাক্ত পানি পান করার সময় নদীতে ডুবে মারা গেছে।

এ দিকে গত শনিবার রাত ১০টায় নাফ নদীর জোয়ারে আবারো ৩ রোহিঙ্গা নারীর লাশ ভেসে এসেছে। লাশ তিনটি গতকাল সকালে দাফন করা হয়েছে। গত ৮ অক্টোবর রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৭টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি শিশু, ১৭ জন নারী ও চারজন পুরুষ।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইনুদ্দিন খান বলেন, নৌকাডুবির পর থেকে টেকনাফের কোনো না কোনো পয়েন্ট থেকে রোহিঙ্গাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রাতেও সাবরাংয়ের খুরেরমুখ এলাকায় জোয়ারে ভেসে আসে তিন নারীর অর্ধগলিত লাশ।

এ দিকে গত রাতে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। গতকাল দুপুরে শাহপরীর দ্বীপ জেটিসংলগ্ন বরফ ফ্যাক্টরিতে আশ্রয় নেয়া তালেব ও তাহেরা দম্পতির সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের গ্রাম কাইন্দাপাড়া জ্বালিয়ে দেয় সেনারা। এরপর তারা পালিয়ে আশ্রয় নেন নাপিতের ডেইল গ্রামে। কয়েক দিন ধরে এই গ্রামেও ঘন ঘন সেনারা এসে গ্রামবাসীকে হুমকি দিতে থাকলে বাধ্য হয়ে তারা পালিয়ে আসেন।

এ স্থানে আরো ৬৩ রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের সাথে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বেশির ভাগই বুচিডং জেলার। তাদের ভাষ্যমতে, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তারা ঘর থেকে বের হন। এরপর পাহাড়-জঙ্গল, খাল-বিল পার হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেন। তাদের পালিয়ে আসার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, সেখানে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

কয়েক সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো অবরুদ্ধ করে রাখে সেনারা। গ্রাম থেকে তারা কোথাও বের হতে পারছেন না। তারা আরো জানিয়েছেন, মংডু থেকে ২৫ কিলোমিটার পূর্বে বুচিডং ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত রাচিডং এলাকা থেকে অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। তারা বলেন, রাচিডং, বুচিডং ও মংডু এলাকা বিভক্তকারী ময়ু পর্বতমালার বিভিন্ন পাহাড়, জঙ্গলে ১০-১২ দিন ধরে আটকা পড়েছেন এসব রোহিঙ্গা। খাদ্য ও চিকিৎসা সঙ্কট এরই মধ্যে কয়েকজন মারা গেছে। অনেকেই জঙ্গল ও পাহাড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন। এদের কারো লাশ মিলছে, কারো মিলছে না।

বুচিডংয়ের কিয়াদং এলাকার বদিউর রহমানের ছেলে মো: সোলতান তার পরিবারের ১৪ সদস্য নিয়ে থাইংখালী বাঘগোনায় অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে বাতাসে শুধুই লাশের গন্ধ। এখনো গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনী ও মগরা পাহারা দিচ্ছে। তিনি তার পরিবার সদস্য নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে টেকনাফে প্রবেশ করেন। থাইংখালী বাঘঘোনা অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া ছালেহ আহমদ জানান, তাদের গ্রামের নাম বুচিডংয়ের তামিম। তিনি বলেন, ‘কোনো গ্রামে মানুষ নেই। গরু মরে আছে, মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পড়ে আছে। চার দিকে শুধু পচা গন্ধ।’

মংডুতে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর ভাঙচুরে বাধ্য করে ভিডিও করছে সেনারা : এ দিকে রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার প্রতিটি নেম্রের রোহিঙ্গা গ্রামের ২০টি করে ঘর ভাঙার দৃশ্য ধারণ করে সেই ভিডিও শুক্রবারের মধ্যে সেনা ক্যাম্পে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয় স্থানীয় সেনা প্রশাসন। এ নির্দেশ অমান্য করলে বাড়িকরে আগুন দিয়ে রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মারা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়।

সীমান্তের ওপারের সূত্র জানায়, মংডু ৬ নম্বর নেম্রের রোহিঙ্গাদেরকে নিজেদের বাড়িঘর ভাঙচুরে বাধ্য করে ভিডিও ধারণ করছে সেনা প্রশাসন। শুক্রবার বিকেলে বস্যু পাড়া ও আইজ্জা পাড়ায় সেনাসদস্যরা ঢুকে অস্ত্রের মুখে নিজেদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করে। এ সময় সেনাসদস্যরা তা ভিডিও করে।

উল্লেখ্য, মংডুর ৬ নম্বর নেম্রের ৭-৮টি গ্রামে আগে হামলা করেনি সৈন্যরা। যেকোনো মুহূর্তে সেনাদের হাতে জীবন হারানোর আশঙ্কার মধ্যেও প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা এখনো সেখানে বাস করছেন। অন্য দিকে মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা হিন্দুদের পুরস্কৃত করছে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।

রোহিঙ্গা মুসলমানেরা হিন্দুদের হত্যা করছে এমন মিথ্যা ও বানোয়াট সাক্ষ্যদাতা হিন্দুদের পুরস্কৃত করছে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। মুসলমানবিদ্বেষী বৌদ্ধ ভিক্ষু উইরাথু ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গত শুক্রবার মংডু সফরকালে এক বৌদ্ধবিহারে হিন্দুদের পুরস্কৃত করে। হিন্দুদেরকে তাদের দেয়া বিবৃতিতে অটল থাকার জন্য অর্থ প্রদান করা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র আরো জানিয়েছে, মংডুর ফকিরা বাজারে পাহাড়ের গণকবর থেকে উত্তোলিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের লাশকে হিন্দুর লাশ বলে প্রচার এবং হত্যার দায় মুসলমানদের ওপর দিতে কতিপয় হিন্দুকে বাধ্য করে প্রশাসন। প্রাণ বাঁচাতে হিন্দুরা বর্মি সেনাবাহিনীর শিখিয়ে দেয়া বুলি মিডিয়ার সামনে বলতে বাধ্য হয়। সেসব হিন্দুকেই পুরস্কৃত করেছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।

অশ্বিন উইরাথু গত বুধবার আকিয়াব হয়ে মংডু যান। সেখানকার রাখাইনদের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উসকানি দেয়। প্রয়োজনে রাজপথে নামারও নির্দেশ দেয় সে। এ দিকে গুপ্তচরের সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হিন্দু নারীদের মংডুর সেনা সদর দফতরে রাখা হয়েছে। বাড়ি-গাড়ি ও জমি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে তাদের কাছ থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানবিরোধী স্টেটমেন্ট নিয়েছে সেনাবাহিনী। সেসব প্রচার করা হচ্ছে মিয়ানমারের গণমাধ্যমে।

সূত্র: নয়াদিগন্ত

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন