৩১ বছরেও উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি

fec-image

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কক্সবাজার উপকূলের মানুষের জন্য ছিল এক ভয়ানক রাত ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল। ঘণ্টায় ২৪০ কিমি গতিবেগে বাতাস আর প্রায় ২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস নিয়ে রাত প্রায় বারোটা নাগাদ উপকূলে আছড়ে পড়ে হারিকেনের শক্তিসম্পন্ন প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়।

এর আগে শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) থেকে গুমোট পরিবেশে বাতাসসহ বৃষ্টি হচ্ছিল। খবর পেয়েছিলাম পাশের গ্রামে মেঝ মেয়েটি সন্তানসহ অসুস্থ। কাঁচা রাস্তা, তার উপর বৃষ্টি হওয়ায় তাদের দেখতে যেতে পারিনি। এখনকার মতো মোবাইল যোগাযোগ ছিল না বলে আর খবরও নিতে পারিনি তাদের কি অবস্থা? অপেক্ষায় ছিলাম বৃষ্টিটা থামলে মেয়ের বাসায় গিয়ে নাতি ও তার সেবা করব। কিন্তু সোমবার (২৯ এপ্রিল) জলোচ্ছ্বাসের পর বৃষ্টি থামলেও চারপাশ ছিল লণ্ডভণ্ড।

প্রায় ২০ ফিট উঁচুই বয়ে যাওয়া জলোচ্ছ্বাসে অন্য উপকূলবাসীর মতো আমার মেয়ে ও নাতিরা তাদের দাদিসহ ভেসে গিয়ে প্রাণ হারায়। তাদের মরদেহটি পর্যন্ত আর দেখা হয়নি। ৩১ বছরে এলাকার অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। জীবন সায়াহ্নে এসে মৃত্যুর প্রহর গুনছি। এখন চারপাশে করোনা নামে একটি ভাইরাসের ভয়ে সব কিছু স্তব্ধ। এরপরও মেয়ে এবং নাতি ও তাদের পরিবারের সবাইকে হারানোর স্মৃতি আমায় পিছু ছাড়েনি। আজ (২৯ এপ্রিল) তাদের কথা বেশি মনে পড়ছে।

কক্সবাজার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজুম ইউনিয়নের বাসিন্দা তার বাড়িতে বসে ভয়াল ২৯ এপ্রিলের রাতে স্বজন হারানোর সেই স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে বুধবার আবেগ তাড়িত হন রহিমা বেগম (৬৫)। তিনি সে দিন পাশের গ্রাম মেহরিয়া পাড়া বিয়ে দেয়া মেয়ে-নাতিসহ সবাইকে হারিয়েছিলেন।

শুধু তিনি নন, উপকূলের শত শত মানুষ তার মতো আপনজনকে হারিয়ে এখনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। প্রায় আড়াই যুগ সময় পিছনে ফেলে এসেছেন জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত মানুষ। কিন্তু হারানোর বেদনা তাদের কখনো নিস্তার দেয়নি। উপকূলবাসীর স্বজন হারানোর সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজকের দিনে ভারাক্রান্ত মনে কেউ মিলাদ পড়িয়ে, কেউ বা বিলাপে সান্তনা খোঁজার চেষ্টা চালাবেন।

১৯৯১ সালের এ দিনে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকা তছনছ করে মহা ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল। রাতের অন্ধকারে মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির এই তাণ্ডব। এর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি উপকুলের মানুষ আর কখনো হয়নি। তাই ১৯৯১ সালের পর থেকে ২৯ এপ্রিল আসলে স্বজন হারা মানুষের কান্নায় এখনও ভারি হয় উপকূলের পরিবেশ। সেদিন জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে অকালে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মৃতি উপকূলবাসীকে এখনো তাড়ায়। বেদনা অশ্রু ভারাক্রান্ত হন তারা।

ক্ষতিগ্রস্তদের মতে, সেদিন আবহাওয়া বিভাগ উপকূলীয় এলাকায় ৯নং সতর্ক সংকেত জারি করলেও অজ্ঞতার বশে লোকজন নিরাপদ স্থানে না যাওয়ায় মহা দুর্যোগের শিকার হন। রাত ১০টার পর ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় সাগরের পানি মুহূর্তেই লোকালয়ে ঢুকে জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলায় অনেক মা হারায় সন্তান, স্বামী হারায় স্ত্রী, ভাই হারায় বোনকে। অনেক পরিবার আছে যাদের গোটা পরিবারই পানির স্রোতে হারিয়ে গেছে। ২৯ এপ্রিলের সে ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনও কাঁদেন স্বজন হারানো উপকূলবাসী।

প্রশাসনের হিসাব মতে, ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় ১৯ জেলার ১০২ থানা ও ৯টি পৌরসভায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন নিহত, ১২ হাজার ১২৫ জন নিখোঁজ, ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪ জন আহত হন। মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছ-পালা, চিংড়ি ঘের, স্কুল-মাদরাসা, পানের বরজ, লাখ লাখ গবাদি পশু, ব্রিজ কালভার্ট ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষতি সাধিত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার। তাই ৩১ বছর পরও অতীতের স্মৃতি মুছতে পারেনি উপকূলবাসী।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৫৬১ সালের জলোচ্ছ্বাসেও উপকূলের বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ১৭৬২ সালে, ১৭৯৫ সালের ৩ জুন, ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবরে, ১৯০৫ সালের ২৯ এপ্রিলে, ১৯৬৩ সালের ২৭ মে, ১৯৭২ সালের অক্টোবরে, ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মহেশখালী কুতুবদিয়া-দ্বীপসহ উপকূলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়া খুদিয়ার টেক নামক একটি এলাকা পুরো বিলীন হয়ে গেছে।

১৯৯১ সালের এ দিনে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর উপ-দ্বীপ ধলঘাটা-মাতারবাড়ি, পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়ন, কুতুবদিয়ার প্রায় পুরো উপজেলা এবং সদরের বৃহত্তর গোমাতলী এলাকায়। ওখানে অধিকাংশ বাড়ি থেকে পরিবারের ৫-৬ জন লোক মারা যান। অনেক যৌথ পরিবারে ৪০ জন মারা যায়। তাই এ দিনটিতে এখনও স্বজন হারানোর বেদনায় বিলাপ করেন অনেকে।

এতকিছুর পরও কক্সবাজারের উপকূলে পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। বিদ্ধমান ৫ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রের অধিকাংশ ব্যবহার অনুপযোগী। শুধু সাইক্লোন সেল্টার নয়, উপকূলের কয়েকশ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনো চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে এসব উপকূলীয় বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছিল। ওই ভাঙা বাঁধ এখনোও পরিপূর্ণ মেরামত হয়নি।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি, ধলঘাটা ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত এবং ৯৬টি সাইক্লোন সেল্টার ব্যবহার উপযোগী হলেও এত মানুষের মাঝে এসব কিছুই না, আরো আশ্রয় কেন্দ্র বাড়ানো দরকার।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইয়াছিন বলেন, মহেশখালীতে যে সব ঘূণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। তার পাশাপাশি নতুন করে আরো আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। এছাড়াও মুজিব কিল্লা নির্মাণ হয়ে গেলে আরো বেশি মানুষ ও জানমালের আশ্রয় হবে এসব কেন্দ্রে।

মহেশখালী কুতুবদিয়ার সাংসদ আলহাজ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, আমাদের মহেশখালী দ্বীপটি ভৌগলিকভাবে দূর্যোগের মধ্যে থাকি , মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর দৃষ্টি রয়েছে মহেশখালীসহ পুরো উপকূলীয় এলাকা সমূহকে টেকসই বেড়িবাঁধ যেমন সুপার ডাইকের মতো করে নির্মাণ করা হবে, তা হলে বেড়িবাঁধের উচ্চতা হবে প্রায় ৭ ফুট। পুরো প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে। সেটি দ্রুত সময়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম নিয়মিত চলমান। এছাড়া যেখানে প্রয়োজন সেখানে নতুন আরও কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন