সবুজ পাহাড়ে জুমের সোনালী হাসি
মুজিবুর রহমান ভুইয়া :
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতিরা পাহাড়ের উচু নিচু ঢালুতে জুম চাষ করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। জুমত যায় দে, জুমত যায় দে, যাদে যাদে পধত্তুন পিছ্যা ফিরি রিনি চায়, শস্য ফুলুন দেঘিনে বুক্কো তার জুড়ায়…। এটি চাকমা জনগোষ্ঠীর খুব জনপ্রিয় একটি গান। সারা বছর পরিশ্রম শেষে পাহাড়ী তরুণীরা যখন জুমের পাকা ধান ঘরে তুলতে যায়, তখন তরুন-তরুনীরা মনের আনন্দে গানটি গেয়ে থাকে। জুমে বীজ বপনের পর পাঁচ মাস পরিচর্যা ও রক্ষানাবেক্ষনের পর উৎপাদিত ফসল দেখে হাসি ফুটে ওঠে জুম চাষীদের মুখে।
এ মৌসুমে জুম ক্ষেত থেকে ফসল ঘরে আনতে শুরু হয় উৎফুল্ল জুমিয়া নারী-পুরুষের। কিছু কিছু জুমিয়া ঘরে নবান্ন্ উৎসবের আয়োজনও শুরু হয় এসময়। এ বছর জুমের সোনালী ফসল ঘরে তুলতে পারায় জুম্ম নারী-পুরুষ ফিরে পেয়েছে মুখের হাসি। চোখে ফুটে উঠেছে আশার আলো। পাহাড়ে জুম ক্ষেতে এখন পাকা ফসল তোলার ভরা মৌসুম। জুমিয়াদের ঘরে উঠেছে অনেক পরিশ্রমের জুমের সে সোনালী ফসল। আর ফলানো ফসল ঘরে তুলতে পেরে জুময়িা নারী পুরুষের মুখে ফুঠেছে হাসির ঝিলিক। চোখে-মুখে আশার আলো । জুম্ম নারীরা উৎফুল্ল মনে ব্যস্ত জুমের পাকা ধান কাটতে।
তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, ও বান্দবানের পাহাড়ী জুম ক্ষেতে সবেমাত্র শুরু হয়েছে পাকা ধান কাটা। পাশাপাশি ধুম পড়েছে মারফা, ছিনারগুলা, বেগুন, ধনি মরিচ, ঢেড়ঁশ, কাকরোল, কুমড়াসহ ইত্যাদি ফসল তোলার কাজ। এর পরপরই ঘরে উঠবে তিল, যব এবং সবশেষে ঘরে তোলা হবে তুলা।
জুমচাষীরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল পরিষ্কার করে করে শুকানোর পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে জুম ক্ষেত্র প্রসার করে। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে পোড়া জুমের মাটিতে শুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুড়ে একসঙ্গে ধান তুলা, তিল কাউন, ভুট্টা, ফুটি চিনার, যব ইত্যাদি বীজ বপন করে। আষাঢ়-শ্রাবন মাসে জুমের ফসল পাওয়া শুরু হয়। সে সময় মারফা (পাহাড়ী শশা), কাঁচা মরিচ, চিনার, ভুট্টা পাওয়া যায়। ধান পাকে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। সবশেষে তুলা তিল, যব ঘরে তোলা হয় কার্ত্তিক-অগ্রহায়ন মাসে।
এ বছর খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য তিন জেলার পাহাড়ে জুমের ভালো ফলন হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। স্থানীয়রা জুম চাষীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর কাঙ্খিত বৃষ্টিপাতের ফলে সময়মতো জুমচাষ সম্ভব হয়েছে, ফলনও হয়েছে আশাতীতভাবে।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের হারাধন চাকমা বলেন ভাইবোনছড়া এলাকায় জুমের ফলন গতবারের চেয়ে এবার অনেক ভালো ফলন হয়েছে। জেলার মটিরাঙ্গা সদর ইউনিয়নের প্রশান্ত ত্রিপুরা তার জুমের ফসল কাটতে কাটতে হাস্যোজ্জল মুখে বলেন, এবার আমার জুম থেকে প্রায় ৩০ মন ধান পাবো বলে আশা করছি। মাটিরাঙ্গা সদর ইউনিয়নের আরেক জুমচাষী প্রতিভা ত্রিপুরা বলেন,তিনি এবছর তিন একরের মতো পাহাড়ী জমিতে জুমচাষ করেছেন। এ জুমে উৎপাদিত ফসল দিয়ে আমি আগামী ২০/২২ মাস পর্যন্ত আমার চলে যাবে। এর পাশাপাশি আমি পাহাড়ী ঢালু জমিতে হলুদও রোপন করেছি। এখান থেকে আমি বেশ কিছু অর্থ আমার উপার্জন হবে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গেই কৃষি বিভাগ থেকে আমরা কোন সহযোগিতা না পাওয়ার কথা জানান।
পার্বত্য তিন জেলায় প্রতি বছর কি পরিমান পাহাড়ী ঢালু জমিতে জুম চাষ হয় তার সঠিক হিসাব কৃষি বিভাগ জানাতে না পারলেও বিশেষ পদ্ধতির এ আদি জুম চাষ পার্বত্য মানুষের জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস। বাংলাদেশের একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামেই জুম চাষ হয়ে থাকে।
জুম চাষ সম্পর্কে খাগড়াছড়ি জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর‘র অতিরিক্ত উপ-পরিচালক তরুন ভট্টচার্য্য বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর জুমের ফলন ভালো হয়েছে। রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলা সবচেয়ে ভালো ফলন হয় বলেও তিনি জানান।