মহালছড়িতে বেড়েই চলেছে নারী নির্যাতন : অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

3

মহালছড়ি (খাগড়াছড়ি) সংবাদদাতা :

খাগড়াছড়ি’র মহালছড়িতে নারী অপহরণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরাধীরা কোন না কোন উপায়ে অথবা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতা পেয়ে বার বার এ ধরণের ঘটনা ঘটানোর সাহস পাচ্ছে। অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেকারণে একের পর এক অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন সচেতন মহল । মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা পুুরো উপজেলায় ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার শান্তিনগর গ্রামের মো. জাফর এর কন্যা মোছাম্মৎ বিলকিছ আক্তার (১৮) কে বাড়ি থেকে তিন সন্তানের জনক মো রঞ্জু হামিদ (২৮) জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করার ৫দিন পর স্বামীর বাড়ীতে শারিরীক নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ করেছে মেয়েটির পরিবার। গত ২৬ জানুয়ারী রবিবার বিকাল ২ টার  সময় চৌংড়াছড়ি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। থানায় মামলা হওয়ার পরও এখনো পর্যন্ত কোন আসামী গ্রেফতার করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেন মেয়েটির পরিবার। পুলিশ এখনো উদঘাটন করতে পারেনি বিলকিছ আক্তারের মৃত্যু রহস্য।

পুলিশের ভাষ্যমতে, মেয়েটি বিষ পান জনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর মেয়েটির মা শাহানারা বেগম থানায় এসে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন। পরবর্তী দু’দিন পর মেয়েটির বাবা জাফর আহাম্মদ শারীরিক নির্যাতনে হত্যার অভিযোগে ৫ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। একই ঘটনায় দু’টি দুই ধরণের মামলা হওয়ায় আইনি জটিলতা দেখা দেয়। পুলিশের পক্ষ থেকে মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

বিলকিছ আক্তারের হত্যার ঘটনার এক মাস পেরুতে না পেরুতেই  জেলার মহালছড়ি উপজেলায় মাইসছড়ি ইউনিয়নের কেয়াংঘাট এলাকায় ২৯ মার্চ শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ভারতী চাকমা (৩০) নামে বিবস্ত্র ও অর্ধগলিত অবস্থায় এক মহিলার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে ক্যায়াংঘাট ইউনিয়নের করল্যাছড়ি হেডম্যান পাড়ার মৃত অজয় কুমার চাকমার মেয়ে।

ভারতী চাকমার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ভারতী চাকমা সেদিন চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি পৌঁছে মোটর সাইকেল যোগে বাড়িতে যাবার পথে পশ্চিম ক্যায়াংঘাট এলাকায় পৌঁছলে কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী তাকে প্রথমে একটি সেগুন বাগানে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের পর হত্যা করে। এরপর তারা লাশটি টেনে নিয়ে গিয়ে পশ্চিম কিয়াংঘাটের পাহাড়ি গ্রামের পাশের একটি আমবাগানে লাশটি ফেলে রেখে যায়। সেখানে লাশটি পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দিলে গত ২৯ মার্চ বিকালে পুলিশ গিয়ে বিবস্ত্র ও অর্ধগলিত অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে। ভারতী চাকমা’র ছোট ভাই সঞ্চয় চাকমা বাদী হয়ে সন্দেহ জনক ৫ জনের বিরুদ্ধে মহালছড়ি থানায় মামলা করে। মামলার এজাহারভুক্ত সন্দেহ জনক আসামী জহুর আলী পিতা- ফয়সালকে পুলিশ আটক করলেও অপরাপর আসামী এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে বলে জানা গেছে। এই মামলাটিও এখনো পর্যন্ত কোন অগ্রগতি হয়নি।

ভারতী চাকমা’র হত্যার ঘটনার ঠিক একমাস পর আবারো মহালছড়িতে গত ৭ মে ১২ বছরের এক কিশোরী অপহরণের পর দুই সপ্তাহের অধিক সময় ধরে আটক রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে দুষ্কৃতিকারীরা। গত ২১মে বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে সন্দেহ জনকভাবে এলাকায় ঘোরাফেরা করার সময় মেয়েটির বড় ভাই ও স্থানীয় লোকজনের সহযোগীতায় মহালছড়ির মানিক ডাক্তার পাড়ার মৃত মতিউর রহমান এর পুত্র মো: আব্দুস ছালাম (২৬) ও নার্সারী পাড়ার মৃত- বেলায়েত গাজীর পুত্র  মো: মাইনউদ্দিন (৩৬) নামে দুই অপহরণকারীকে স্থানীয় লোকজন আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। অপহরণকারীদের তথ্যের ভিত্তিতে কাটিং টিলা নামক গভীর জঙ্গল থেকে কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়।

ধর্ষিতা কিশোরীর ভাষ্যমতে, গত ৭ মে সকাল আনুমানিক  ৮টায় মহালছড়ি’র মেয়েটির খালু  মো: শরীফের বাসা থেকে  বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য মাটিরাঙ্গা উদ্দেশ্যে বের হয় । বাসা থেকে বের হয়ে বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছামাত্র সেখানে আগে থেকে অপেক্ষারত আবদুস ছালাম ও মাঈন উদ্দিন মোটর সাইকেল দিয়ে মেয়েটিকে তাইন্দং বাবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে অত্যন্ত সুকৌশলে অপহরণের উদ্দেশ্য দীঘিনালাতে নিয়ে যায় । সেখানে বাসা ভাড়া করে কিশোরীকে আটকে রেখে অপহরণকারীরা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর পূর্বক পালাক্রমে ধর্ষন করে । তখন মেয়েটি চিৎকার করতে চাইলে তাকে মৃত্যুর ভয় দেখানো হয় । দীঘিনালায় কিছুদিন রাখার পর কিশোরীকে সেখান থেকে এনে মহালছড়ির মাইসছড়ি ইউনিয়নের কাটিংটিলা নামক স্থানে গভীর জঙ্গলের ভিতর আটকে রেখে সেখানেও মেয়েটিকে  ক’দিন যাবত ধর্ষন করেছে। মহালছড়ি থানা পুলিশের সূত্রমতে দুই আসামীকে গ্রেফতার দেখিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় খাগড়াছড়ি জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

ঘটনার মাত্র ২ দিনের ব্যবধানে উপজেলার মহালছড়ি’র চৌংড়াছড়ি হেডম্যান পাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও মহালছড়ি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ১৫ বছর বয়সী এক মারমা কিশোরীকে বিভিন্ন প্রলোভনে আকৃষ্ট করে ২৩ মে শুক্রবার সারারাত ব্যাপী গভীর জঙ্গলে আটক করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে অভিযুক্তদের দাবী, কিশোরীটির সম্মতিতে এরা মেয়েটিকে নিয়ে গেছে। ২৪ মে শনিবার সকালে কাটিংটিলা নামক গভীর জঙ্গল থেকে মেয়েটিকে এলাকাবাসী উদ্ধার করেছে। ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে শনিবার  সকালে চৌংড়াছড়ি গ্রামের বাসিন্দা মো: আলম এর পুত্র মো: শাহাজান (২২) ও মো: আরফান গোয়াল এর পুত্র মো: সারোয়ার(৩২) কে গ্রেফতার করার পর এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে পড়ে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ও মহালছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার লাবনী চাকমা ইভটিজিং আইনে দু’জনকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেন। আসামীদের লঘুদন্ডে ছেড়ে দেওয়ায় চৌংড়াছড়ি গ্রামে পাহাড়ী ও বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন মিলে আবারও গ্রাম্য শালিস বসে। সেখানে ওই অভিযুক্ত ছেলেদের দু’জনকে আবারও  ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে উভয়ের কাছে ভবিষ্যতে আর এধরণের অপরাধ কখনো করবেনা বলে মুচলেখা নিয়ে অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় থানায় আর কোন মামলা হয়নি।

এলাকায় কয়েকদিনের ব্যবধানে একের পর এক এ ধরণের ঘটনা ঘটায় শংকিত হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। অপরাধীদের শান্তি না হলে ভবিষ্যতে অপরাধমূলক কর্মকান্ড আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞ মহল। নিরপেক্ষ তদন্ত পূর্বক সুষ্ঠ বিচার পেতে দেশের নারী সংগঠনগুলোর সহযোগিতা কামনা করেছেন নির্যাতনের শিকার পরিবারবর্গ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন