‘দু’স্থায়ী ঠিকানায় সুজন’র স্বাস্থ্যে দু’চাকরি’

উপজাতি নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানি : স্ট্যাণ্ড রিলিজে ধামাচাপা!

fec-image

স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে চাকরি নেন কক্সবাজারের উখিয়া হলিদিয়া পালং গ্রামের বাসিন্দা সুজন বড়ুয়া। এরপর একের-পর এক রহস্যজনক পদোন্নতি। সর্বশেষ চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক। এদিকে ‘সুজন বড়ুয়া’র বিরুদ্ধে বান্দরবানে সহকর্মীকে (উপজাতি নারী স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে) যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের সত্যতা পেয়েছে সেখানকার জেলা সিভিল সার্জনের গঠিত তদন্ত কমিটি। কিন্তু সুজন’র অলৌকিক স্ট্যাণ্ড রিলিজে ফেনীতে পাড়ি দেয়ায় ধামাচাপা পড়েছে এই যৌন হয়রানির মামলা।

রাঙামাটি জেলা পরিষদের নিয়োগ পূর্ব-শর্তঃ

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের “নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’র” ৮নম্বর শর্ত “স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চাকরি’র জন্য আবেদন করতে হবে। এছাড়া যোগদানের আগে নিতে হবে আগের চাকরি থেকে অব্যাহতি। কোনটিই মানেননি সুজন বড়ুয়া।

জেলা পরিষদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা ব্যতীত বাহিরের প্রার্থীদের আবেদন করার সুযোগই নেই।

রাঙামাটি থেকে বান্দরবানে আশ্রয়ঃ

রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে যোগদানের পর ‘সুজন’র স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি, তথ্য গোপন, দু’চাকরি’র” বিস্তারিত তুলে ধরে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ’র চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে জানায় রাঙামাটির স্থানীয়রা। এর পরই স্ট্যাণ্ড রিলিজ পাড়ি দেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে। সেখান থেকে নিজ-বেতনে বান্দরবান জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে ‘পদায়ন’।

দু’চাকরিতে সুজন’র দেয়া স্থায়ী ঠিকানাঃ

২০০৪ সালে ‘স্বাস্থ্য সহকারী’ পদে চাকরি নেন ‘সুজন বড়ুয়া’। সে সময় তার স্থায়ী ঠিকানা ‘কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলিদিয়া  ইউনিয়নের মরিচ্যা পালং গ্রাম”। ওই গ্রামের বিমল বড়ুয়া তার বাবা। প্রায় ৮ বছর চাকরি করার পর ২০১২ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে ‘উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর’ পদে চাকরি নেন সুজন। এই চাকরিতে স্থায়ী ঠিকানা ‘বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বালুখালী উত্তর ঘুনধুম বড়ুয়া পাড়া’।

যৌন হয়রানিতে বরখাস্থ ও বিভাগীয় মামলাঃ

বান্দরবান জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর হওয়ার পর সহকর্মীকে (উপজাতি নারী স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে) যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনায় বরখাস্তের পাশাপাশি বিভাগীয় মামলা হয় সুজন’র বিরুদ্ধে। ওই সময় জেলার সিভিল সার্জন থানচি উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। যৌন নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই ‘অলৌকিকভাবে’ বান্দরবান থেকে স্ট্যাণ্ড রিলিজ নিয়ে ফেনী পাড়ি দেন সুজন।

ডিএইচএস পদোন্নতিতে নেই সুজনঃ

দীর্ঘদিন পদোন্নতি বন্ধ থাকা জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর (ডিএসআই) থেকে ১৫জনকে জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক (ডিএইচএস) পদে পদোন্নতি দিয়ে গত ২১ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অধিদপ্তর বাছাইকৃত প্রার্থীদের ২২জনের তালিকা পাঠায়। সেই তালিকার ২২ নম্বরে থাকা সুজন বড়–য়া’সহ বাদ পড়েন ৭জন। তবে সুজন দু’বছর ধরে ওই পদের সুযোগ সুবিধা ভোগের পাশাপাশি হয়েছেন ড্রয়িং ডিস্বার্সিং অফিসার।

পদায়নের ছলে যেসব পদোন্নতি এবং নিয়োগঃ

সুজন বড়ুয়া’র ২০০৪ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে চাকরি জীবন শুরু। তথ্য গোপন ও স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি করে ২০১২ সালের শুরুতে উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ। জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক পদে পদায়ন এবং সর্বশেষ নিজ বেতনে এখন বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুদকের চিঠিঃ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, “কক্সবাজার ও বান্দরবানের স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি, তথ্য গোপন, দু’চাকরি, রহস্যজনক পদোন্নতি ও যৌন কেলেঙ্কারি’র” অভিযোগ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালকে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। সুজন’র বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে দুদককে অবহিত করার জন্য দুদক’র ওই পত্রে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগ প্রসঙ্গে সুজনের বক্তব্যঃ

উঠে আসা এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ‘সুজন বড়ুয়া’ বলেন, সবকিছুই ষড়যন্ত্র। কর্মদক্ষতায় পদোন্নতি পেয়েছি। দু’ঠিকানা প্রসঙ্গে বলেন, “পূর্বে উখিয়ার বাসিন্দা ছিলাম ঠিক নাইক্ষ্যংছড়িতে জমি কিনে ২০১১ সালে সেখানকার বাসিন্দা হয়েছি। সুজনের দাবি, বান্দরবানের অতীত সিভিল র্সাজন এসব নিজে তদন্ত করে সুজনকে নিষ্পাপ সনদ দিয়েছেন।

পাহাড়ের বাসিন্দা প্রসঙ্গে আইনজীবীর বক্তব্যঃ

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি এডভোকেট জয়নাল আবদীন সম্রাট বলেন, “পার্বত্য বিধি অনুযায়ি সমতলের অ-উপজাতিরা সেখানকার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পূর্ব অনুমতি ব্যতিত ভূমি ক্রয়, লিজ, নামজারি কোনটিই করার সুযোগ নেই। গোপনে কেউ যদি করেন তা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং দন্ডনীয় অপরাধ।

পরিচালক-স্বাস্থ্যের তদন্ত কমিটিঃ

সম্প্রতি সুজন বড়ুয়া’র বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক-স্থাস্থ্য ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির। তবে এই তদন্ত কমিটি সুজনের “স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি, তথ্যগোপনে একই সংস্থায় দু’চাকরি, উপজাতি নারী স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে যৌন হয়রানি বা তার রহস্যজনক পদোন্নতি’র” সত্যতা যাচাইয়ে নয়! তদন্ত করবে কেলেঙ্কারির খবর সংস্থার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কারা জানিয়েছে। তদন্তে উঠে আসা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা।

তদন্ত কমিটিতে যারা আছেন:

চট্টগ্রামের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপ-পারচিালক) ডা. অসীম কুমার নাথ তদন্ত কমিটির সভাপতি। এছাড়া চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান সদস্য সচিব এবং ফেনীর দাগন ভুইঁয়া উপজেলা পরিবার পরিকল্প কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রুবাইয়াত বিন করিম’কে কমিটির সদস্য। গত ২ সেপ্টেম্বর এই তদন্ত কমিটি গঠনের পর এর অনুলিপি পাঠানো হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, রাঙামাটি, বান্দরবানসহ সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট ৯ দপ্তরে।

তদন্ত কমিটি নিয়ে পরিচালক স্বাস্থ্য’র বক্তব্যঃ

গঠিত এই তদন্ত কমিটির গঠনের উদ্দেশ্য জানতে চাওয়া হয় চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক-স্বাস্থ্যে’র ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর’র নিকট। এ প্রসঙ্গে ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, “সুজন বড়ুয়া’র” বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্মচারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ পাঠিয়েছে। এসব মীমাংসিত বিষয় দাবি করে “সুজন বড়ুয়া” লিখিতভাবে প্রতিকার চায়।

তদন্ত কমিটি“সুজন বড়ুয়ার বিরুদ্ধে উঠা “জাল-জালিয়াতি, তথ্যগোপন, দু’চাকরি, রহস্যজনক পদোন্নতি ও যৌন কেলেঙ্কারি’র” ঘটনায় আপনার দপ্তর থেকে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর’র জবাব, তার বিরুদ্ধে সুর্নিদিষ্ট কোনো বাদি নেই। ঊঠা অভিযোগগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর’কে অবহিত করা হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব মিলেনি স্বাস্থ্যের এই পরিচালকের নিকট।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: সুপ্রিম কোর্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন