কূটনীতির পাশাপাশি সামরিক সক্ষমতাও প্রয়োজন

fec-image

মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এ এন এম মুনীরুজ্জামান সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি। গণমাধ্যমের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার বাহিনীর অভিযান, সীমান্ত লঙ্ঘন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা ও আরাকানকেন্দ্রিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রশ্ন: বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তে যা ঘটছে, তা কি মিয়ানমারের তরফে উসকানি, নাকি দেশটির অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের তৎপরতার অংশ?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: মিয়ানমারের ভেতরে রাখাইন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে তৎপরতা চলছে, তার মূল গোষ্ঠী হচ্ছে আরাকান আর্মি। সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির অবস্থান যথেষ্ট জোরদার হয়েছে। সেখানকার রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরাকান আর্মির প্রভাব ও সমর্থন বেড়েছে। বলা যায় সামরিক ও রাজনৈতিক—দুভাবেই তারা সেখানে বেশ শক্তিশালী হয়েছে। এ বাস্তবতায় ওই রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে তাতমাদা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে শক্ত অভিযান শুরু করেছে। এ সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলা এসে পড়েছে, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। নিজের দেশে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে পাশের দেশে গোলা পড়ার বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। তবে বাংলাদেশকে সরাসরি উসকানি দেওয়ার জন্য এমনটি তারা করেছে, এটা এখনো আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়নি।

প্রশ্ন: মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে যে কায়দায় বিদ্রোহ বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের চেষ্টা করছে, তাতে একধরনের বেপরোয়া ভাব আছে। তারা তোয়াক্কা করছে না যে এটা করতে গিয়ে সীমান্ত লঙ্ঘন করছে কি না। এর মাধ্যমে কি তারা বাংলাদেশকে কোনো বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: আন্তর্জাতিক সীমান্তে কোনো অভিযান চালাতে হলে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। কারণ, এর সঙ্গে অন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি জড়িত এবং এর প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কিন্তু মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে যেভাবে অভিযান চালাচ্ছে তাতে সেই সম্মানটুকু তারা খুব একটা দেখাচ্ছে না এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতি খুব বিবেচনায় নিচ্ছে বলে মনে হয় না। তাদের অভিযানের ধরন দেখে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের সক্ষমতাকে তারা সম্ভবত খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এভাবে অভিযান চালিয়ে তারা সম্ভবত বাংলাদেশের মনোভাব যাচাই করে দেখছে। তারা হয়তো বুঝতে চাইছে, ভবিষ্যতে বড় কিছু ঘটলে বাংলাদেশ কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় বা দেখাতে পারে।

প্রশ্ন: আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে হঠাৎ এত তৎপর হয়ে উঠল কেন?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: আরাকান আর্মি ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের সামরিক শাখা। ২০০৯ সালে কাচিন প্রদেশে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করে এবং সেখানকার কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মির কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়। তারপর তারা আস্তে আস্তে তাদের স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার করে। তারা মিয়ানমারের ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পালেতওয়া অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে রাখাইন রাজ্যে অভিযান চালাতে শুরু করে। মেজর জেনারেল তুয়ান মার্ট নায়াংয়ের নেতৃত্বে এই বাহিনী সাম্প্রতিক কালে তাদের সক্ষমতা অনেক বাড়িয়েছে। এই বাহিনী রাখাইন জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও নিজের মতো করে থাকার অধিকার এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাখাইন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মতবাদ প্রচার ও সেই লক্ষ্যে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আরকান আর্মি যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের অবস্থান জোরদার করেছে এবং জনগণে মধ্যে একটি অবস্থান গড়ে তুলেছে, তাই মিয়ানমারের সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেছে।

প্রশ্ন: আরাকান আর্মি সামরিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের পেছনে কারা রয়েছে? কোথা থেকে তারা অস্ত্রসহ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পাচ্ছে?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: এটা এখনো খুব পরিষ্কার নয় যে আরাকান আর্মি আসলে কোন দেশ বা গোষ্ঠীর কাছ থেকে সাহায্য ও সমর্থন পেয়ে আসছে।

প্রশ্ন: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে মিয়ানমারে সক্রিয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠীগুলো আগের তুলনায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা বাড়ছে। সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের অবস্থান হারাচ্ছে। বাস্তব অবস্থা কি তাই?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সু চির সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের পর সেখানকার বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠীগুলো তাদের অভিযান ও তৎপরতা বাড়িয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফলতা পাচ্ছে। কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (কেআইএ) এরই মধ্যে তাতমাদার বেশ কিছু স্থাপনা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। কারেন জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। কারেন অঞ্চলে তাদের অবস্থান আগের চেয়ে জোরদার হয়েছে। সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান হারিয়েছে। চিন ল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ) ও চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (সিএনডিএফ) এ দুটি ছোট সংগঠনের সঙ্গে সেখানকার বড় সংগঠন চিন ন্যাশনাল আর্মির সমঝোতা হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী তাতমাদা হটাতে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারে সাধারণ জনগোষ্ঠী, যারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, তারাও বিভিন্ন বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকারবিরোধী লড়াই করছে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যাতে ধরে নেওয়া যায় যে তাতমাদা মিয়ানমারের ওপর তাদের বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

প্রশ্ন: জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ছাড়াও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত অং সান সু চির দলও সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে, তারা পাল্টা জাতীয় ঐক্যের সরকারও গঠন করেছে। মিয়ানমারে বর্তমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: আমরা দেখেছি, সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং অং সান সু চিসহ নির্বাচিত নেতাদের জেলে নেওয়ার পর সে দেশের জনগণ বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। শহরে শহরে রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভ হয়েছে। সেনাবাহিনী কঠোর হাতে সেই বিক্ষোভ দমনের পথ ধরেছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স বা পিডিএফ গড়ে তুলেছে এবং এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। একে গৃহযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় বলা চলে। তবে পিডিএফের সাফল্যের মাত্রা খুব ভারী নয়। কারণ, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা তাদের একতা ধরে রাখতে পারেনি। একই সঙ্গে জনবল বা সমর্থক থাকলেও অস্ত্র ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায় যে মিয়ানমারে বর্তমান যে পরিস্থিতি, তা এখনো পুরোপুরি গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়নি।

প্রশ্ন: মিয়ানমার দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর সামরিক শাসনের অধীনে থেকেছে। সেনাশাসন সেখানে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার ক্ষমতা দখলের পর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, তাকে কি অভূতপূর্ব বলবেন? মিয়ানমারের জনগণ কি আগের মতো আর সেনাশাসন মানতে রাজি নয়।

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: সেনাশাসন মিয়ানমারের জনগণের জন্য নতুন কিছু নয়। সেখানকার জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের অধীনে থেকেছে, এটা ঠিক। কিন্তু স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে গণতন্ত্রের আলো প্রবেশ করতে শুরু করে। সেখানকার জনগণ দীর্ঘদিন পর গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করে। গণতান্ত্রিক শাসনের সময়ে সেখানে একটি ঘটনা খুব দ্রুত ঘটেছে, তা হলো নাগরিক সমাজের বিকাশ। সেখানে খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। অল্প সময়ে গণতান্ত্রিক শাসনে এই অর্জন নজর কাড়ার মতো। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন আবার ক্ষমতা কেড়ে নেয়, তখন সেখানকার জনগণ তা মেনে নেয়নি। তারা আর আগের মতো সেনাশাসন মেনে নিতে রাজি হয়নি। জানমালের অনেক ক্ষতির পরও তারা সেনাশাসনকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়েছে। চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: মিয়ানমারের বর্তমান যে সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং এতে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে যে মাত্রায় বিপর্যস্ত হচ্ছে, তাতে দেশটির ভবিষ্যৎ কী? এর প্রভাব আশপাশের দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর কতটুকু পড়তে পারে?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: মিয়ানমারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল ও নাজুক। তবে এখন পর্যন্ত অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। কোভিডের সময় দেশের অর্থনীতি যে চাপের মুখে পড়েছিল, তা তারা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। সেনাশাসন জারি হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি হওয়ায় অর্থনীতি ধরে রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে মিয়ানমার সম্পদশালী দেশ এবং প্রয়োজনীয় এমন অনেক সম্পদ আছে, যা দিয়ে তারা নিজেরাই চলতে পারে। নতুন যে বিধিনিষেধ মিয়ানমারের ওপর জারি হয়েছে, তা দেশটির জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগে চার দশক তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কাটিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে টিকে থাকতে হয়, সেই অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। এর ওপর ভর করে তারা বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে আগামী বছর মিয়ানমারে প্রবৃদ্ধি হবে ৩ শতাংশ। জ্বালানি ও খাদ্য নিয়ে কিছুটা চাপে থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের হুমকির মুখে নেই মিয়ানমার। দেশটি যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েনি, তাই অর্থনৈতিক উদ্বাস্তু হওয়ার সুযোগ নেই। খুব শিগগির তেমন কিছু হবে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন: কলাম লেখক আলতাফ পারভেজ তাঁর এক লেখায় আরাকান আর্মির বক্তব্যকে উদ্ধৃত করেছেন। আরাকান আর্মি বলেছে, রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরত পাঠাতে হলে তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। তার মানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়ল। আপনার মন্তব্য কী?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: আরাকান আর্মি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সেখানকার অনেক এলাকার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে এমন অঞ্চলও রয়েছে যেখানে তারা নিজেদের প্রশাসন চালাচ্ছে এবং ট্যাক্স আদায় করছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য এসেছে। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চাইছে যে তারা শুধু অভ্যন্তরীণভাবেই শক্তিশালী হয়নি, এখন তারা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা দাবি করতে চাইছে যে এ অঞ্চলে তারা এমন এক শক্তি ও সংগঠন, যাদের বাদ দিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করবে? এর জবাব হচ্ছে এ ধরনের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই।

প্রশ্ন: মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন, রাশিয়া বা ভারতের মতো দেশগুলো কী ভূমিকা পালন করছে?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: আপনি যে তিন দেশের কথা বললেন, এই দেশগুলোই মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন ও মদদ জুগিয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পরও এই দেশগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এই তিন দেশের গভীর কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের কিয়াকপিউতে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হয়েছে। সেখানে তারা তেল শোধনাগার বানাচ্ছে। চীনের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য এ বন্দর ও শোধনাগার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে চীন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মালাক্কা প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে তা ব্যবহার না করেই নিজেদের জ্বালানির সরবরাহ লাইন চালু রাখতে পারবে। এর মাধ্যমে তেল, গ্যাস, এলএনজি সবকিছুর সরবরাহই নিশ্চিত করা যাবে। এখান থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সরাসরি রেললাইন থাকবে। অন্যদিকে ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত সিটওয়ে বন্দর পুনর্নির্মাণ করে ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। এখান থেকে কালাদান মাল্টিমোডাল হাইওয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করতে পারবে। কালাদান সংযোগ হাইওয়ে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার সেখানে অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। তারা সেখানে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্য কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশের পথ। চীনের বিআরআইয়ের ছয়টি করিডরের একটি এ রাজ্য দিয়ে যাবে। রাখাইন রাজ্য যেহেতু এ তিন দেশের জন্যই খুব আকর্ষণীয়, তাই এর কৌশলগত গুরুত্বের দিকটি বাংলাদেশকে বুঝতে হবে এবং এই দিক মাথায় রেখেই এগোতে হবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ এরই মধ্যে মিয়ানমার ইস্যুতে বন্ধুদেশগুলোর সহযোগিতা চেয়েছে। এ ইস্যুতে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যে নীতি ও কৌশল নিয়েছে, তাকে যথাযথ বলে মনে করেন কি?

এ এন এম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশ বন্ধু কিছু দেশের প্রতিনিধিদের ডেকে বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে এবং সহায়তা চেয়েছে। এ থেকে খুব ফল পাওয়া যাবে না। আমরা দেখেছি যে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট যখন তৈরি হয়, তখন আমরা কূটনৈতিকভাবে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছি। আসিয়ান বা সার্ক কেউ আমাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি। মিয়ানমারের ওপর যদি কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে হয় তবে চীন, ভারত ও রাশিয়ার মাধ্যমেই তা করতে হবে। তাদের মাধ্যমেই মিয়ানমারকে এই বার্তা দিতে হবে যে বাংলাদেশ সীমান্তে তারা যা করছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই তিন দেশের কাছে না গিয়ে অন্য কোনো কিছু খুব কাজে দেবে না। পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে আমাদের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যেতে হবে। সেখানে চীন ও রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো ধরনের সংঘাতে জড়ানো যাবে না এবং কূটনৈতিকভাবে এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তবে কূটনীতির পেছনে শক্তি প্রয়োগের সক্ষমতাও থাকতে হবে এবং তা স্বচ্ছভাবে প্রকাশিত হতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার ওপর হুমকি দেখা দিলে জাতীয়ভাবে ঐকমত্যের প্রয়োজন পড়ে। জাতীয় ঐকমত্যের সঙ্গে সামরিক সক্ষমতা যুক্ত হলে তা ডেটরেন্ট পাওয়ার হিসেবে কাজ করে। এই দুটি পেছনে থাকলেই কূটনীতি সঠিকভাবে কাজ করে।

সূত্র: প্রথমআলো

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার, সামরিক সক্ষমতা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন