জটিলতার জালে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক কূটনীতি


স্বৈরশাসক হাসিনার প্রকাশ্য সমর্থক ছিল ভারত। মনে করা হয় ভারত দ্বারা বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত হতো। শেখ হাসিনার পুতুল সরকার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে উৎখাতের পর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নানা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। দুই দেশের মধ্যে তৈরি হওয়া নানা সুযোগ-সুবিধার সম্পর্কে দ্রুত ভাটা পড়ে। চুক্তিগুলো স্থগিত হয়ে পড়ে। দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে চলে বাক্যবাণ নিক্ষেপ।
এর মধ্যে ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশি সাত ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে। পণ্যগুলো হলো- কমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, প্যাকেট জাত খাবার, প্লাস্টিক পণ্য ও তৈরি পোশাকের কিছু আইটেম। প্রশ্ন হলো, এই আইটেমগুলো কতটি বাংলাদেশি কোম্পানি রপ্তানি করত। উত্তরে চলে আসে একটিমাত্র কোম্পানির নাম। আর সেটা হচ্ছে প্রাণ-আরএফএল।
শুরুটা ১৯৯৭ সাল থেকে। এরপর ২০০৮ সালে প্রাণ-আরএফএল ভারতের ত্রিপুরায় কারখানা তৈরি করে। বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত লাগুয়া ত্রিপুরায় কাঁচামাল পাঠানোর সহজ হয়। এই সুবাদে ভারতের কলকাতা, গোহাটি, আগরতলা, শিলং এবং ত্রিপুরার সুবিধাজনক পজিশনে প্রাণের ফ্যাক্টরি রয়েছে। এর সুবাধে ভারতের সাত বোন রাজ্য- মিজোরাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও আসামে রয়েছে প্রাণের বেশ কয়েকটি বড় ডিপো। এসব সাপ্লাই চেইন থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোতে প্রাণ কোম্পানির সব আইটেম বেশ জনপ্রিয়।
স্বাভাবিক ছিল এই কোম্পানির পণ্যবাজার। ঝামেলা শুরু হয় ২০১৯ সালের দিকে। ওই সময় কলকাতায় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো- সিআইডি দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সাত বোন খ্যাত রাজ্যগুলোয় গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে। সিআইডি জানায়, গ্রেফতারকৃত রাজেশ ঘোষ ও বিধান কীর্তনীয়া দুজনই প্রাণ কোম্পানির কর্মী।
এর আগে ওই কোম্পানির আরো কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। ওই সব ঘটনায় সিআইডির মিডিয়া শাখার মাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ করা হয়। তবে ওই কোম্পানি কখনো স্বীকারোক্তি দেয়নি এবং আবার ভারত সরকারও অফিসিয়ালি কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি।
তবে গত ১৫ বছরে ওই কোম্পানির জন্য হুমকি না হলেও এখন বর্তমান পর্যায়ে হুমকি বলে মনে করা হতে পারে। প্রশ্ন হলো- ভারত যদি সত্যি বাংলাদেশি পণ্যে নিষেধাজ্ঞা দিত, তাহলে স্থলবন্দর বন্ধ করে নদী বন্দরের সুযোগ দিতো না। স্থলবন্দর ব্যবহারে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না কিন্তু নদীবন্দর ব্যবহারে সেটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দুই মার্কিন নাগরিককে গ্রেফতার করা হয় সাত বোন রাজ্যে। সাত বোন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিঘ্ন চলাচল এবং এসব তথ্য গোপন রাখতে এমনটা করা হতে পারে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি করতে পারে?
প্রসঙ্গক্রমে আরো কিছু কথা চলে আসে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ২ লাখ ভারতীয়কে নাগরিত্ব দেয়া হয়েছে- এমনই দাবি একটি সূত্রের। এদের কেউ কেউ নাকি বিভিন্ন ব্যবসা, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। তবে এদের বড় একটা অংশ দোকানদার বলেও শোনা যায়। গোয়েন্দা সংস্থার ভাষায়, এই দোকানগুলোকে কোনার দোকান বলে। যা আমরা টংঘর বা মুদির দোকান বলে জানি।
যশোর-চৌমুহনী রোড, সিলেট-হবিগঞ্জ হাইওয়ে ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে এরকম অনেক দোকান রয়েছে, যারা সবাই জন্মগত বাংলাদেশী নয়। ৯০ দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের খাদেমকে গ্রেফতার করেছিল ডিজিএফআই। তার কাছে সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা ওয়ারলেস সেট পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মসজিদে কাজ করার পাশাপাশি টঙে দোকানদারি করত। যার সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দাদের যোগসূত্র পাওয়া যায়।
দুই দেশের এই রকম পূর্বাপর জটিল পরিস্থিতিগুলো বর্তমানে সন্দেহের ডালপালা আরো জটিল করেছে। এরকম সন্দেহের কারণে দুই দেশের জটিল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যা শেষমেষ বাণিজ্য বিরোধের সন্ধিক্ষণে জটিল রূপ লাভ করেছে।