পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌলিক ইস্যু বনাম চ্যালেঞ্জসমূহ
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অনন্য অঞ্চল যেখানে উপজাতি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। ভূ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য এই অঞ্চল স্বতন্ত্র। তবে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে উত্তেজনা ও সংঘাত দেখা দেয়। এর ফলে এই অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এই লেখাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ইস্যু, উপজাতি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর সমস্যাগুলো এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌলিক ইস্যু
ভূমি অধিকার এবং মালিকানা সংকট
ভূমি অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সমস্যা। উপজাতি জনগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে জমি চাষাবাদ এবং বসবাস করে আসছে। তাদের অভিযোগ, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসন এবং স্থানীয় বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের (রাস্তাঘাট, ব্রিজ, পর্যটন, বিভিন্ন অফিস নির্মাণ ইত্যাদি) ফলে উপজাতিরা তাদের জমি হারিয়েছে। ফলে ভূমি মালিকানা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
বাঙালি জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ
১৯৭০/৮০-এর দশকে সরকারি উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু হয়। তবে এই পুনর্বাসনের ফলে তারা কতিপয় স্বার্থান্বেষী উপজাতি গোষ্ঠীর শত্রুতে পরিণত হয়। অনেক বাঙালি পরিবার উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বারা অপহরণ, হত্যা, এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া এবং জমি জোরপূর্বক দখল করার অভিযোগও রয়েছে।
উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রভাব
কিছু সশস্ত্র উপজাতি গোষ্ঠী (যেমন: জেএসএস, ইউপিডিএফ) চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং সহিংস কর্মকাণ্ড চালিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করছে। তারা নিজেরাই অনেক সময় পাহাড়ি জনগণের স্বার্থহানী করছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাধারণ উপজাতি জনগণের সংগ্রাম
উপজাতি জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয়। তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি নির্দিষ্ট উপজাতি গোষ্ঠীর দাপটের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পে এই সব শান্তিপ্রিয় উপজাতি জনগোষ্ঠীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী এনজিও সংস্থার একমুখী নীতিও তাদের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।
পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব
অনেকক্ষেত্রে, বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সহযোগিতার অভাব দেখা যায়। উভয় পক্ষ নিজেদের সমস্যার জন্য অপর পক্ষকে দায়ী করে। এই দূরত্ব শত্রুতা বৃদ্ধি করে এবং সম্প্রীতির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
চ্যালেঞ্জসমূহ
শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অভাব
১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এর অনেক ধারা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিশেষ করে ভূমি কমিশনের কার্যকারিতা এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিরস্ত্রীকরণে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি।
সন্ত্রাস এবং নিরাপত্তা সংকট
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি এবং সহিংস কর্মকাণ্ড পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীর জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে।
উন্নয়ন এবং অংশগ্রহণের ঘাটতি
পার্বত্য অঞ্চলে নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও এসব প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ কম। ফলে প্রকল্পগুলো অনেক সময় স্থানীয়দের প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হয়।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সংকট
পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। এ কারণে পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীই মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত।
শান্তি ও সমাধানের উপায়
পার্বত্য-বাঙালি সম্প্রীতি বৃদ্ধি
পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করলে সংঘাত হ্রাস পাবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিক্ষা, এবং সহাবস্থানমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে এই সম্প্রীতি বাড়ানো যেতে পারে।
সাধারণ উপজাতিদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
সাধারণ উপজাতি জনগোষ্ঠী শান্তিপ্রিয় এবং তারা উন্নয়ন চায়। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, এবং অধিকার রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী তাদের নিরস্ত্রীকরণ এবং চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভূমি সমস্যার টেকসই সমাধান
ভূমি কমিশনকে স্বচ্ছ এবং কার্যকর করে উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ সমাধান করতে হবে।
উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে উপজাতি ও বাঙালিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
সম্ভাব্য ফলাফল
বাঙালি ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তরিকতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। এতে সন্ত্রাস কমবে এবং সাধারণ জনগণ উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারবে।
শেষ কথা
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদি হলেও এগুলোর সমাধান অসম্ভব নয়। উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি করলে এই অঞ্চলে একটি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারের উচিত শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, সন্ত্রাস দমন, এবং উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে উপজাতি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক