পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে পিনাকী ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ ও বাস্তবতা


গত ৫ অক্টোবর ২০২৫ তারিখ ফ্রান্স প্রবাসী সুপরিচিত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে তাঁর স্বভাবসুলভ কায়দায় একটি বিশ্লেষণ নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করেছেন। দুঃখের বিষয় পিনাকী দাদার এই বিশ্লেষণের অধিকাংশ তথ্য-উপাত্ত চরম ত্রুটিপূর্ণ, অন্তঃসারশূন্য এবং অকার্যকর। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিকে ‘স্যাটেলার’ সম্বোধন করায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে পোস্ট করে চরম প্রতিবাদ জানানো পিনাকী দাদার পার্বত্য বাঙ্গালিকে স্যাটেলার সম্বোধন? এ ধরনের আকস্মিক ১৮০ ডিগ্রি দিক পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণ কী হতে পারে? সপরিবারে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভের চেষ্টায় থাকা/গ্রহণকারী পিনাকী দাদার প্রতি ফরাসী/ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিকদের চাপ, নাকি কোনো রাজনৈতিক/স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আর্থিক সংশ্লেষ, নাকি কোনো বিশেষ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে রিসেট (দাদা গণজাগরণ মঞ্চের একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন ও ভারত হয়ে ফ্রান্সে পৌঁছান)! প্রকৃত সত্য কি সেটা হয়তো সময় বলে দিবে। যেহেতু বিদেশে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিষয়ে চরমভাবে নাক গলানো প্রভাবশালী অনলাইন বিশ্লেষকগণ বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে একে অপরের পিছনে লেগে আছেন।

এবার আসি পিনাকী দাদার সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক বক্তব্যের অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিতকরণে। সর্বাগ্রে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, সেটি হলো ব্রিটিশরা কখনো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ফ্রন্টিয়ার বা প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে শাসন করেনি, এটা তাঁরা Backward Tracts বা Totally Excluded Area বা শাসন বহির্ভূত এলাকা হিসেবে শাসন করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। অনুরূপভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ উপজাতি গোষ্ঠীকে যাযাবর হিসেবে বিবেচনা করতো বিধায় ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন কিংবা ১৮৮৫ সালের প্রজাস্বত্ব আইন কোনটাই ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োগ করেনি, এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর The Hill Tracts of Chittagong and The Dwellers Therein নামক গ্রন্থের ২৮ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘A greater portion of the hill tribes, at present living in the Chittagong hills, undoubtedly came about two generations ago from Arracan’।
ব্রিটিশরা শক্তিশালী উপজাতীয় গোত্রপ্রধানগণকে অস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান করে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। শাসন কার্য পরিচালনায় সুবিধার জন্য বর্তমান মং সার্কেল সৃষ্টি করণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন। এই গোত্র প্রধানগণকে মৌখিক উপাধি ‘রাজা’ প্রদান করা হলেও তাদের দাপ্তরিক মর্যাদা হলো ‘সার্কেল চিফ’, যেটি কোনো প্রকার প্রশাসনিক ও নির্বাহী ক্ষমতা ব্যতীত পাহাড়িদের উপর সামান্য প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী ভূমি রাজস্ব আদায় সম্পৃক্ত একটি পদবী এবং যিনি সম্পূর্ণরূপে ডেপুটি কমিশনারের অধীনস্থ। পাহাড়িদের সামাজিক/আভ্যন্তরীণ বিষয় ব্যতীত শাসনকার্যের অন্য কোনো বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের অধিকার পর্যন্ত তাঁর নেই। এই পদবী অদ্যাবধি বলবৎ আছে। ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্কেল পদ্ধতি চালু করে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা মূলত সরকারের হাতে নিয়ে নেয়, যেখানে সার্কেল চিফেরও অংশ আছে এবং মৌজা প্রধান হেডম্যানগণ কমান্ড চ্যানেলে সার্কেল চিফের অধীনস্থ মনে হলেও আসলে জেলা প্রশাসকের অধীনস্থ, সার্কেল চিফ নিয়োগ এবং বরখাস্তকরণে সুপারিশ করতে পারবেন মাত্র, এই ব্যবস্থাও অদ্যাবধি চালু আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনার সকল কার্যক্রম মূলতঃ হেডম্যান কার্যালয়ে সূত্রপাত হয়। তবে জেলা প্রশাসক তথা সরকার সবকিছু পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সর্বময় আইনগত ক্ষমতা সেই ব্রিটিশ শাসকরা তৈরি করে রেখে গেছেন এবং সবচেয়ে সার্থক ও কৌশলী প্রয়োগ ঘটায় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার। ১৮৭৯ সালে দূরদর্শী বৃটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল বন ভূমিকে রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করে, যার পরিমাণ প্রায় ১১ লক্ষ একর। ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করে সৃষ্ট জেলা পার্বত্য চট্টগ্রামকে নন রেগুলেটেড জেলা হিসেবে বিবেচনা করে কার্যতঃ ভোটের অধিকার না দিয়ে মূলধারার শাসন ব্যবস্থার বাইরে রেখে দেয়। অন্য কথায় ব্রিটিশরা সামন্ত প্রভুগণ ব্যতীত পাহাড়ের কাউকে গোনায় ধরেনি, সামন্ত প্রভুগণও কোন দিন জনগণের অধিকারের দাবি নিয়ে ব্রিটিশদের দরবারে যায়নি। ১৮৮১ সালের Rules for Territorial Circles in the Chittagong Hill Tracts, ১৮৯২ সালের Rules for the Administration of the Chittagong Hill Tracts এর ধারাবাহিকতায় ১ মে ১৯০০ সালের The Chittagong Hill Tracts Regulation এর মাধ্যমে সামন্ত ভূস্বামীদের কর্তৃত্বের সামান্য আইনগত ভিত্তি দিয়ে ব্রিটিশরা পাহাড়ে তাদের শাসন বহির্ভূত শোষণ সুসংঘটিত করেছিলো, হাস্যকর হলেও ঐ আইন আজ অবধি পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবত্ আছে এবং সে অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসিত হচ্ছে।
ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য হাল চাষ প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলো এবং হাল চাষিদের জমির স্থায়ী মালিকানা প্রদানের ঘোষণা দেয়। জুম চাষে অভ্যস্ত পাহাড়িদের হাল চাষ শেখানোর জন্য পার্শ্ববর্তী জেলা চট্টগ্রাম থেকে হাইল্যা চাষিদের চাষের জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদানের বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। বর্ণবাদী ও ধূর্ত সামন্ত প্রভুরা (সার্কেল চিফ, দেওয়ান, রোয়াজা, পাড়া প্রধানগণ ও প্রভাবশালীরা) সাধারণ পাহাড়িদের হাল চাষের কাল্পনিক কুফল এবং বাড়তি ভূমি রাজস্বের ভয় দেখিয়ে হাল চাষ থেকে দূরে রাখে। কিন্তু নিজেরা ঠিকই মোক্ষম সময়ে শত শত একর জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে নেয়। এভাবেই ইতিহাসে প্রথম ব্যাপক আকারে বাঙ্গালির পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন ঘটে এবং তাঁরা সঠিকভাবে ভূমির মালিকানাও লাভ করে। যদিও পাহাড়ি সামন্ত প্রভুদের বর্ণবাদী আচরণে বহু জুমিয়া পরিবার রয়ে যায় ভূমিহীন। এসব করুণ কাহিনির সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ডক্টর আনন্দ বিকাশ চাকমা রচিত ‘কার্পাস মহল থেকে শান্তিচুক্তি’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে।
ক্রমান্বয়ে জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রাপ্তির সুফল ও হাল চাষের প্রয়োজনীয়তা পাহাড়িরা বুঝতে শিখে এবং শেষ পর্যন্ত অল্প অল্প জমি বন্দোবস্ত প্রাপ্তি তথা চাষের জন্য নিজেরা তৈরি করে বা আয়ত্তে নিতে থাকে। হাল চাষ পদ্ধতি রপ্তকরণের আগ্রহের সুবাদে পাহাড়ি ও বাঙ্গালিদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য এক অনন্য গভীরতা লাভ করে। ১৯১০-১৯২৬ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম ভূমি জরিপ পরিচালিত হয়, এতে মূলত হাল চাষের জন্য দখলকৃত/বরাদ্দকৃত জমি ব্যক্তি নামে রেকর্ড হয়। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের বিদায়ের পর তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের সাথেও উচ্চ শিক্ষিত এবং ধূর্ত পাহাড়ি সামন্ত সমাজ আরো ব্যাপক সখ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কৌশলী পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামকে ১৯৫৬ সালে ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’, ১৯৬২ সালে ‘ট্রাইবেল এরিয়া’ মর্যাদা দিলেও ১৯৬৪ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের অন্যান্য অবিচ্ছেদ্য অংশের মর্যাদায় নিয়ে আসেন। এই সবই করা হয়েছে সামন্ত প্রভুদের হাতে রেখে। চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায়ের মৃত্যুর পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাথে চাকমা রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠতা বহুগুণ বেড়ে যায়। রাজা ত্রিদিব রায় হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি আজ অবধি পাকিস্তানের ইতিহাসে একই সাথে সেনাবাহিনীর সম্মানিত মেজর এবং গভর্নরের এডিসি হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। পাহাড়ি সামন্ত সমাজের চাহিদা মোতাবেক পাকিস্তান সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৫০ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন তথা জমিদারী উচ্ছেদ প্রয়োগ হতে বিরত থেকে হিল রেগুলেশন বহাল রেখে এসএ জরিপ পরিচালনা করে ১৯৬২ সাল নাগাদ, এতে পাকিস্তান সরকারের কাপ্তাই হ্রদ তৈরি এবং পাহাড়ি সামন্ত প্রভুদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার দ্বৈত উদ্দেশ্য অত্যন্ত সফলভাবে অর্জিত হয়। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের জলে সমাধি ঘটে লাখো জীবন ও জীবীকার, পাহাড়ি ও বাঙ্গালি মিলে প্রায় লাখখানেক লোক হয় সর্বস্ব হারা, পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা দেয় সবচেয়ে বড় ভৌগোলিক পরিবর্তন এবং তীব্র অসন্তোষ। তবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি এবং পুনর্বাসনের অর্থের চরম নয়ছয় করে পাহাড়ি সামন্ত সমাজ রইলেন শাসকগোষ্ঠী সাথে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধের পাশাপাশি পাকিস্তান সরকারের অন্য মেগা প্রজেক্টটি হলো ১৯৫১-৫৩ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কর্ণফুলী পেপার মিল। এই মিলের সুবাদেও প্রচুর বাঙ্গালির পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন ঘটে। সরকার ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী পেপার মিলের নামে কাচালং ও রেইংক্ষঙের ১২৬০০০ একর বাঁশ সমৃদ্ধ বনভূমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়, সীতা পাহাড় এলাকায় ৬৮২ একর বন একই প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হয়েছে চারা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। ১৯৪৯-৫০ সালে আসাম ও পশ্চিম বঙ্গের বেশ কয়েক হাজার মুসলিম শরণার্থীকে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করেছিলো, তবে অধিকাংশ পাহাড়ি জীবন যাপনে অভ্যস্ত নয় বিধায় আবার ফিরে গেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ কোনো ভূমি জরিপ হতে দেওয়া হয়নি। তবে উন্মুক্ত উৎসের তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে যে, উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সরকার আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আংশিক ভূমি জরিপ পরিচালনা করে ভূমি ম্যাপ হালনাগাদ করেছে, যে কার্যক্রম থেমে থেমে চলে শেষ হয় ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৫ সালে। এখন কোনো ভূমি মালিক তার জরুরি প্রয়োজনে জমাবন্দী ও খাজনার দাখিলাসহ ম্যাপের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন করলে নিরাপত্তাজনিত কারণে সংশ্লিষ্ট ভূমির আশপাশ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২০/২৫টি দাগের কার্বন ছাপ কপি বা Traced অনুলিপি Revised in 1978-79 লিখে প্রদান করা হয়। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ভূমি ম্যাপের মূলভিত্তি এখনও পাকিস্তান আমলের এস.এ জরিপ। তবে হেডম্যানগণসহ পুরাতন বাসিন্দা প্রভাবশালীদের নিকট পূর্ণাঙ্গ মৌজা ম্যাপ ও ভূমি বৃত্তান্ত রয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব হতেই। The Last Raja of West Pakistan নামক বইয়ে লেখক প্রিয়জিৎ দেবসরকার দাবি করেছেন, আইয়ুব খানের আমলে পরিচালিত ভূমি সংস্কার তথা জরিপে পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত প্রভুদের নজিরবিহীন সুবিধা প্রদান করা হয়েছিলো, একক নামে সেচের জমি ৫০০ একর এবং সেচ বিহীন জমি ১০০০ একর পর্যন্ত রেকর্ড করার সুযোগ প্রদান করা হয়েছিলো। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় পূর্ব পাকিস্তানি রাজাকার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত তথা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্ত প্রভুদের দুই শক্তিশালী প্রধান ও প্রভাবশালী পাহাড়িগণ। অতএব এস.এ জরিপে পার্বত্য চট্টগ্রামে কী কী ঘটেছে সেটার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও সংশোধন ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার সমাধান একেবারেই অসম্ভব!
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট যে, ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এবং পাহাড়ি সামন্ত সমাজের শোষক ও বর্ণবাদী মনোভাবের কারণেই মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের সিংহভাগ ভূমির বৈধ মালিকানা রাষ্ট্রের এবং পাহাড়ি সামন্ত সমাজের। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনা বলতে মূলত হিল রেগুলেশনের ধারা ১৮ এর অধীন প্রণীত ব্যবস্থা, এ ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো সাধারণ প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে কখনো চালু ছিলো না এবং ক্ষুদ্র এই ভূখণ্ডের মধ্যে ১১-১৬টি জাতিসত্তার জন্য সেটা কখনো সম্ভবও না। ব্রিটিশরা জেলা প্রশাসকের অধীনস্থ ভূমি বা খাস থেকে মৌজা রিজার্ভ ধারণা সৃষ্টি করেছিল, দালিলিকভাবে নয়, যা কালে কালে জেলা প্রশাসকগণের কলমের খোঁচায় হার্টিকালচার/রাবার বাগান হিসেবে বিলীন হয়ে গেছে, পুনর্বাসিত বাঙ্গালি কিংবা ভূমিহীন কৃষকগণ বরাদ্দ পেয়েছেন বা দখলে আছেন অতি নগন্য পরিমাণে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি রাস্তাঘাট, খাল/ছড়া, পাহাড়ের পানি নিষ্কাশনের পথ, শ্মশান, পুরাতন ধর্মীয় স্থাপনা, বাজার ইত্যাদি সেই বৃটিশ আমল থেকেই ম্যাপে অনেক বিশদভাবে চিহ্নিত করা আছে। কাপ্তাই হ্রদের আওতায় আছে প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার ভূমি, এছাড়াও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, কর্ণফুলী কাগজ কল, স্থায়ী সেনানিবাসসমূহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামে হাজার হাজার একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়া আছে।
গোষ্ঠীগত প্রথা ও রীতির ভিত্তিতে পৃথিবীর কোথাও ভূমির মালিকানা সৃষ্টি হওয়ার নজির আমার জানা নেই। প্রথা ও রীতির আইনগত স্বীকৃতির মাধ্যমে সম্পদের উত্তরাধিকার তথা Succession of Property নির্ধারিত হয়। যেমন আমাদের দেশের মুসলিম পারিবারিক আইন, হিন্দুদের দায়ভাগ (যেটা আমাদের দেশে বৌদ্ধদের জন্য প্রয়োগ হয়ে আসছে) ও মিতাক্ষরা, খ্রীস্টানদের সগোত্র ও সমগোত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিয়ন্ত্রিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক ২০১৩ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সংক্রান্ত প্রথা ও রীতি’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছে। ঐ বইয়েও মূলতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের ভূমির উত্তরাধিকার নীতিমালা/আইন, প্রথা ও রীতি ব্যতীত কিছু নেই। যেহেতু এদেশে বৌদ্ধদের জন্য বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তরাধিকার আইন বা Succession of Property সংক্রান্ত কোনো আইন নেই, সেহেতু সরকার কর্তৃক ঐ বইটিকে দিকনির্দেশক হিসেবে ধরে নিয়ে দেশের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপযুক্ত প্রতিনিধিগণের সাথে আলোচনা করে তাদের জন্য একটি Succession of Property সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। ভূমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় আইন অনুযায়ী দালিলিক প্রমাণ ও দখলে থাকার উপর, এক্ষেত্রে একটিকে আরেকটি হতে গৌণ করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত রিজার্ভ ফরেস্টসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সকল ভূমি যেন নদীতে ভাসা মরা গরু দখলে নেওয়ার জন্য সবাই অনবরত ঢিল ছোড়াছুড়ি ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত আছে। মজার বিষয় হলো সেই ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি ভাষায় প্রণীত হিল রেগুলেশনের ফাঁকফোকর গলিয়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সামন্ত প্রভুগণ ও জাতিধর্ম নির্বিশেষে পুরো দেশের প্রভাবশালীগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি গ্রাসের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছেন। এর সাথে যখন কাপ্তাই হ্রদ পুনর্বাসনের অনিয়ম, খাস হিসেবে বিবেচিত ভূমিতে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিদের উপর শান্তিবাহিনীর গণহত্যা এবং তাদের কর্তৃক ক্ষেত্র বিশেষে অন্যের ভূমিতে বসতি স্থাপন, ভ্রমাত্মক বন্দোবস্ত ও বহুবিধ ভূমি জালিয়াতি যোগ হয়, তখন সবকিছু মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনার অবস্থা মারাত্মক জঘন্য। অথচ, হিল রেগুলেশন ব্যতীত কোনো ভূমি আইন বলবৎ নেই এবং বিদ্যমান ভূমি ম্যাপের মূল ভিত্তি হলো সত্তরের দশকের জরিপ, তাই হিল রেগুলেশনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ আলোচনা অতিব জরুরি।
হিল রেগুলেশনের শাসন বিধি অংশের ৩৪(১)(খ)(i) ধারায় বলা আছে, রাবার বাগান কিংবা অন্যান্য চাষাবাদের জন্য জেলা প্রশাসক ২৫ একর, বিভাগীয় কমিশনার ১০০ একর পর্যন্ত ভূমি ইজারা দিতে পারবেন। ১০০ একর এর উর্ধ্বে ভূমি ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। ৫০(১) ধারায় বলা আছে একজন পাহাড়ি শহর এলাকার বাইরে হেডম্যান এর অনুমোদনক্রমে ০.৩০ একর বা ৩০ শতাংশ ভূমি বসবাসের জন্য দখল করতে পারবেন, ৫০ (২) ধারায় বলা আছে, ভূমির পরিমাণ তদূর্ধ্ব হলে জেলাপ্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। ৫০ (৩) (ক) ও (খ) ধারা মিলিয়ে বলা আছে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বসবাসের জন্য হেডম্যান কর্তৃক বরাদ্দকৃত জমি ফেরত নেওয়া হলে শুধুমাত্র স্থাপনা বা ঘর এবং দখলদার কর্তৃক রোপিত গাছ ও চারাগাছের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ব্রিটিশরা বিশ শতকের শুরুর মধ্যে (১৯০৯ সাল) হিল রেগুলেশনের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬৬টি বাজার চালু করে। যেগুলোর রাজস্ব আদায় ও ব্যবস্থাপনা সরাসরি জেলা প্রশাসকের অধীন, তিনি সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান কিংবা ভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে বাজারগুলোর রাজস্ব আদায় ও ব্যবস্থাপনা বজায় রাখেন, সূচনালগ্ন থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যানগণ এই বাজারগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন। বাজার ব্যবস্থাপকের স্থানীয় পদবি বাজার চৌধুরী, সেই থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু হেডম্যান পরিবারের নামের সাথে জুড়ে যায় ‘চৌধুরী’ বিশেষণটি। ১৯৩৭ সাল থেকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বাজার ফান্ডবিধিমালা’ নামে বলবৎ আইন দ্বারা এই বাজারগুলো মূলত পরিচালিত হচ্ছে। এই বাজারগুলোর সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রাম জেলা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ বাঙ্গালি স্থায়ী দোকান স্থাপন ও অস্থায়ী বেপারি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। হিল রেগুলেশন অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা থেকে পাড়া প্রধান পর্যন্ত পাহাড়িদের বিশেষ নিয়মে শ্রমে বাধ্য করা এবং পাহাড়ি সামন্ত সমাজের জন্য বাৎসরিক বেগার দেওয়া বৈধ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন টক-শো’তে দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা নিয়ে যে সব বক্তব্য প্রদান করেন, তা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য কোনভাবেই প্রযোজ্য নয়!
হিল রেগুলেশনে The State Acquisition and Tenancy Act, 1950 (East Bengal Act) এর ৯০ (১) ধারা এর মতো সকল শ্রেণির জমি মিলিয়ে কোন ব্যক্তি বা তার পরিবারের ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ৩৭৫ বিঘা বা ১২৩. ৭৫ একর এর মতো! আবার বাংলাদেশ ল্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেশন অর্ডার, ১৯৭২ মোতাবেক ব্যক্তি/পরিবারের নামে যে কোন ধরনের ভূমি ১০০ বিঘা/৩৩ একর বা ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ ও ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৩ মোতাবেক ব্যক্তি/পরিবারের নামে কৃষি জমির মালিকানা সর্বোচ্চ ৬০ বিঘা/১৯.৮ একর এর মতো। এসব সামন্তবাদ বিরোধী নিয়মও পাহাড়ে কার্যকর হতে পারছে না হিল রেগুলেশনের বদৌলতে। সাধারণ পাহাড়িরা ভূমি মালিকানায় এই The State Acquisition and Tenancy Act, 1950 (East Bengal Act) এর ৯৭(১) ধারার সুরক্ষাসহ যাবতীয় সুবিধা ও সুরক্ষা হতে চরমভাবে বঞ্চিত, এসব নিয়ে পাহাড়ি সামন্ত সমাজের মাথাব্যথা তখনো ছিলো না, এখনও নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সন্তু লারমা কিছুটা দরদ দেখিয়েছেন, কিন্তু ঠিকই চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে সাথে সবার আগে সুরক্ষিত হয়ে গেছে সামন্ত প্রভুদের স্বার্থ! চুক্তির (ঘ) অংশের ৩নং ধারায় বলা আছে কোনো পাহাড়ি পরিবার ২ একরের কম জমির মালিক হইবে না। এটা ভালো লাগছে যে, সন্তু লারমা জানেন ভূমিহীন বহু পাহাড়ি পরিবার আছে, যাদের ভূমির কোনো মালিকানা নেই, তাই ভবিষ্যৎ ভূমি জরিপে তাদের ভূমির উপযুক্ত মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য তিনি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ওয়াদা নিলেন। তবে একই চুক্তির একই অংশের ৮ নং ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সামন্ত সমাজ ও পুরো দেশের প্রভাবশালীদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি গ্রাস আসলে অবারিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ শান্তি চুক্তির বাস্তবতা হলো পাহাড়ি ভূমিহীনরা অনেক যদি ও কিন্তুর উপর ঝুলে আছেন, বাঙ্গালি ভূমিহীনদের কোনো উল্লেখ-ই নেই! এই সুযোগে গত ২৭ বছরে সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদসহ বহু আমলা ও মন্ত্রীর নামে বেনামে পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে ওঠেছে বাগান বাড়ি ও পর্যটন কেন্দ্র। জনশ্রুতি আছে, ভূমি ব্যবস্থাপনা জেলা পরিষদের অধীনে দেওয়ার পর হতে জেলা পরিষদের প্রভাবশালী পদে বসতে পারলে ১টি রাবার বাগান প্লট অর্থাৎ কমপক্ষে ২৫ একর যেন নানার বাড়ির মোয়ার মতো প্রাপ্য! শুধুমাত্র জেলা পরিষদের পদে থেকে নিজ ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে এযাবৎ সরকারি ভূমি আত্মসাতের ফিরিস্তি সঠিকভাবে প্রকাশ করা হলে হয়তো চমকপ্রদ সব রহস্য বেরিয়ে আসবে ।
যে বিষয়টি এযাবৎ ডক্টর আনন্দ বিকাশ চাকমা ব্যতীত আজ অবধি কেউ বিশদভাবে আলোচনা করে দেখাননি, সেটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০ বলবৎ রেখে দিলেই পাহাড়িরা ভূমির মালিক হয়ে যাবেন না। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় রাতারাতি প্রায় ২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে সরে আসাও দুষ্কর। তাই বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৮৯ সালে ‘পার্বত্য জেলাসমূহ (আইন রহিত ও প্রয়োগ এবং বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৮৯’ মূলত The Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900 রহিত এবং পার্বত্য জেলাসমূহে কতিপয় প্রচলিত আইনের প্রয়োগ ও উক্ত জেলাসমূহের জন্য কিছু বিশেষ বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণয়ন করা হলেও এই আইনের মধ্যেও সামন্তবাদ রেখে দিতে বাধ্য হয় বিশেষ বিধানের আড়ালে। আবার যেহেতু সামন্ত ভূমি ব্যবস্থা ও দপ্তর বহাল আছে, তাই সামন্ত প্রভুরাও বলছেন, হিল রেগুলেশন বহাল আছে। অন্যদিকে সরকার প্রণীত আইনের ধারা ১৭ মোতাবেক হিল রেগুলেশন বাতিল করে আজ অবধি কোনো বিধি প্রণয়ন করেনি, তবে সরকারের প্রয়োজন হলেই হিল রেগুলেশনের তফসিল সংশোধন ব্যতীত ধারা ৩ মোতাবেক যে কোনো আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রয়োগ করতে পারছে এবং পারবে। অর্থাৎ সামন্তবাদ ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে যেন এক অভিনব বিরোধিতা বিরোধিতা খেলা, মাঝখানে আছে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ জনগণ!
এটা পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন রাজনৈতিক সমস্যা। একেবারে পাড়া বা গ্রাম পর্যায়ের রাজনৈতিক সমঝোতা ব্যতীত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের কয়েকটি পাতা এর সমাধান এনে দেওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সম্মানিত চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় কর্তৃক ২০০৪ সালে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে লিখিত ‘The Land Question and The Chittagong Hill Tracts Accord’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ অনলাইনে পড়েছি, বহু বিস্তারিত আলোচনার পর তিনিও পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমনের জন্য অত্যন্ত প্রান্তিক পুনর্বাসিত বাঙ্গালিকে সরাসরি দোষারোপ করতে পারেননি কিংবা বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মতো কোনো কিছুরও সুপারিশ করেননি। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেও পুনর্বাসনের তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখেননি বিধায় একটি মধ্যবর্তী অবস্থান খুঁজে বের করার প্রতি জোর দিয়েছেন।

ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে যতোক্ষণ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালির অস্তিত্ব টিকে থাকবে ততক্ষণ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা টিকে থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ তথা শান্তি চুক্তি মূলতঃ ব্রিটিশদের আদলে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে আংশিক সায়ত্তশাসনের স্বীকৃতি। যেটার পূর্ণ বাস্তবায়নে মূল বাধা হলো পাহাড়ে বিদ্যমান ১৫ হাজারের অধিক অবৈধ অস্ত্র এবং রাজনৈতিকভাবে প্রধান প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ। ২০১১ সালে এক টিভি সাক্ষাৎকারে সন্তু লারমা দাবি করেছিলেন, ইউপিডিএফকে প্রতিহত করার জন্য তারাও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। আমি অনলাইনে একজন পিসিজেএসএস নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এটা চুক্তির সুস্পষ্ট লংঘন নয় কি? জবাবে তিনি বলেছেন, আমরা সরকারি বাহিনীর উপর কোনো হামলা করছি না এবং করবো না, টার্গেট চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ! তখন আমি পাল্টা প্রশ্ন রেখেছিলাম, ইউপিডিএফ দমন শেষে বা সরকার দমন করে ফেললে আপনাদের নতুন অস্ত্র গুলোর সিদ্ধান্ত কী হবে? তখন তিনি পরবর্তী উত্তর প্রদান ব্যতীত অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। এছাড়া কেএনএফ-সহ বাকি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মোটেই কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। এখন পিনাকী দাদা যেভাবে ৩৫০ কোটি টাকা চাঁদাবাজিকে সাধারণ বানিয়ে এর পিছনের অস্ত্রগুলোর বর্ণনা সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলেন, সেটা কীভাবে সাধারণভাবে দেখা সম্ভব? অথচ শান্তি চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে হয়তো অস্ত্র উদ্ধারে পিসিজেএসএসের সাহায্যও হয়তো পাওয়া সম্ভব! পার্বত্য চট্টগ্রামে জনশ্রুতি আছে, পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ দুটোই ভারতের তৈরি এবং মদদে টিকে থাকলেও বর্তমানে ভারত ইউপিডিএফকে বেশি সহায়তা করছে, পিসিজেএসএস সরকারের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে বেশি আগ্রহী বলে। এখন পিনাকী দাদার মুখেও হঠাৎ করে ইউপিডিএফের পূর্ণ সায়ত্তশাসনের দাবি উচ্চারিত হলে হিসাব মিলাতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে!
সর্বশেষ পিনাকী দাদা অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপনে দেশের সমতল এলাকায় দুটি ডিভিশন জনবল শূন্য হয়ে যাবে বলে যে মত দিয়েছেন, সেই উদ্ভট হিসাব তিনি কোথায় পেলেন? এখানে সাধারণভাবে বুঝা যাচ্ছে, বিদ্যমান জনবল দিয়ে শান্তি চুক্তির আওতায় বন্ধ করা অস্থায়ী কিছু ক্যাম্প অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য হয়তো অস্থায়ীভাবে সচল করা হবে। প্রয়োজন হলে ব্রিগেডগুলোতে সর্বোচ্চ আরো ১টি করে ইউনিট যোগ করে শক্তি বৃদ্ধি করা হবে। এর জন্য সারাদেশ থেকে হয়তো কিছু সংখ্যক সেনাসদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আনার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু তাতে ২টি ডিভিশন কীভাবে খালি হয়ে যেতে পারে? অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ছাড়াও আরাকান আর্মির বর্তমান কর্মকাণ্ড ও মোদীজীর কথিত নিউ নরমাল এবং সেভেন সিস্টার্স পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে শক্তি বৃদ্ধি একান্ত আবশ্যক। সেখানে একাধিক শত্রুর মনোভাবের সাথে পিনাকী দাদার মনোভাব মিলে যাওয়াও চরম আশ্চর্যের বিষয়! সবচেয়ে হাস্যকর হলো, পুরো বয়ান হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে, সেখানে ম্যাজিস্ট্রেসী পাওয়ার ত্যাগ করে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে বলছেন পিনাকী দাদা কাদের পক্ষ থেকে? বর্তমানে অনলাইনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও সুপারিশকে তাৎক্ষণিকভাবে বিরোধিতা করার যে প্রবণতা গড়ে তোলা হচ্ছে, সেটা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করবে। তাই দেশবাসীকে বুঝতে হবে, বিদেশে অবস্থানকারী সোস্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্বগণ এখন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালীন সময়ের মতো ঐক্যবদ্ধ যেমন নন, তেমনি প্রতিটি পোস্টে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার স্বার্থ রক্ষায় ততোটা সতর্কও নন। সবাই এখন গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত স্বার্থে কনটেন্ট তৈরি করে নিজের আখের ঘুচানোতে ব্যস্ত।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।

















